থ্রি ইডিয়টসের জয় লবোর সেই ‘ও ছঁরঃ’ উক্তিটি এখন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মগজে গেঁথে গেছে। শহরে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলা প্রতিযোগিতায় মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছে একদল শিক্ষার্থী। যোগ্যতমের টিকে থাকার লড়াইয়ে যারা নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে পারছে না, হতাশা হয়ে যাচ্ছে তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। ৪ লাখের বেশি পরীক্ষার্থীদের মধ্য থেকে ২ হাজার ৫০০ জনকে যখন নির্বাচিত করা হবে তখন ৩ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০ জনকে ব্যর্থ হতেই হবে। কিন্তু ব্যর্থতাকে মেনে নেয়ার ক্ষমতা প্রতিটি পরীক্ষার্থীর সমান নয়। তাই অনিশ্চয়তার স্টিম রোলারে পড়ে একদল শিক্ষার্থী বেছে নেয় আত্মহনের পথ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আত্মহত্যা প্রবণতার ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের পরিচালিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, দেশে ২০২২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের ৫৩২ জন, ২০২১ সালে ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ও ২০২০ সালে ৭৯ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। অর্থাৎ প্রতি বছরই এ সংখ্যাটি বাড়ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলোর তিনজন শিক্ষার্থীর এভাবে চলে যাওয়া দেখিয়ে দিচ্ছে আমাদের সমাজব্যবস্থা ও শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিগুলোকে। এসএসসি, এইচএসসি ও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির ফলাফলের পর প্রতি বছর অনেক শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। ভালো ফলাফল করার পারিবারিক ও সামাজিক অসহ্য চাপে পিষ্ট হয়ে থাকে তারা এই পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। জিপিএ-৫ এর এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বের হয়ে কবে সমাজ শিক্ষার্থীদের শিক্ষা, মূল্যবোধ ও দক্ষ হওয়ার জন্য তাগাদা দেবে তা এখন সময়ের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
আত্মহননের মতো সমস্যা দূর করতে সবার আগে প্রয়োজন কারণগুলো চিহ্নিত করা। শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে পড়াশোনার চাপ, বাবা-মায়ের অধিক প্রত্যাশা, ভালো ফলাফল করতে না পারা, আর্থিক অসচ্ছলতা, অসুস্থতা, ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব, নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে না পারা, পারিবারিক অশান্তি ও কলহ বা প্রেমঘটিত কারণগুলো প্রধান। আত্মহত্যার কারণ দর্শাতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাহবুব কায়সার স্যার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, “আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সিলেবাস, কারিকুলাম যতটা ইতিহাস ঐতিহ্য ও অর্থ ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট জ্ঞান চর্চার দিকে মনো নিবিষ্ট, তার সিকিভাগও জীবনঘনিষ্ঠ নয়। সমাজে মনোবৈকল্য বাড়ছে। তার অন্যতম প্রধান কারণ, আর্থ-সামাজিক বৈষম্যে, আদর্শিক চিন্তা দর্শনের ব্যবধান, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা, মর্যাদাকাঠামোর অসম তারতম্য, বর্তমানের নিরাপত্তাহীনতা ও ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা, চোখ ঝলসানো পুঁজির চাকচিক্য ও মরীচিকার হাতছানি, ভোগবাদী ও লোভাতুর জীবন চিন্তার ব্যাপ্তি, সামাজিক মর্যাদা কাঠামোর ও পরিবারের প্রত্যাশার অসম চাপ ইত্যাদি।”
বিভিন্ন জায়গা থেকে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসায় নতুন পরিবেশে থাপ খাইয়ে উঠতে পারে না। অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ায় শিক্ষার্থীরা উপর্যুক্ত দিকনির্দেশনা থেকেও এ সময় বঞ্চিত হয়। হলে থাকা শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন কর্তৃক নির্যাতিত হয়, যা তাদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। এর ওপরে আছে আর্থিকভাবে অসচ্ছলতা। তার ওপর এ সময় বাড়ি থেকে টাকা নেয়ার বদলে টাকা দেয়ার তাগাদা অনুভব করে তারা। পড়াশোনায় আশানরূপ ফলাফল করতে না পারা বা চাকরির পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনিশ্চিত করে তোলা আর এই অনিশ্চয়তায় তাদের মধ্যে তৈরি করে দীর্ঘদিনের হতাশা।
আত্মহত্যার চেষ্টা করা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে জানা যায় নিজেকে সবার থেকে ছোট মনে করা, কারও সঙ্গে মিশতে না পারা, আশপাশের মানুষের কটূক্তি ও আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য তিনি এমন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
এ সমস্যা দূরীকরণে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্যনীতি-২০২২ এর গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীদের জন্য কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক আরও আন্তরিক করার দ্বারা শিক্ষার্থীদের অভিভাবকশূন্যতা দূর করা যেতে পারে। আর্থিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বৃত্তির আওতায় আনা অপরিহার্য। হলগুলোতে কোনো ছেলে-মেয়ে যেন র্যাগিংয়ের শিকার না হয় হল ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সে বিষয়ে কঠোর নজরদারি করতে হবে। চাকরিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীদের জন্য সুদমুক্ত স্টুডেন্ট লোনের ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের এসব ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় হয়তো অন্ধকারে চলে যাওয়া সম্ভাবনাময় ছাত্র-ছাত্রীগুলোকে আত্মহত্যার ছোবল থেকে রক্ষা করতে পারে।
জিনিয়া ফেরদৌস জুঁই
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়