দুই চোখে স্বপ্নের ঝলকানি। বুকভরা সাহস। যেন বিশ্বজয় করার জন্য একেক জন সৈনিকের মতো সদা প্রস্তুত। ক্লাসের বাইরে বন্ধুদের সঙ্গে জমপেশ আড্ডা। রঙিন খামের চিঠির মতো ভবিষ্যৎ নিয়ে কত শত স্বপ্ন! বলছি বিশ্ববিদ্যালয় সদ্য চান্সপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের কথা যারা ভর্তিযুদ্ধে জয়ী হয়ে পা রাখে বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনায়। তখন তাদের জীবন একটি ফুটন্ত গোলাপের মতোই স্নিগ্ধ। কিন্তু এখানে র্যাগিং আতঙ্ক তাদের প্রথম বর্ষের বর্ণিল জীবনকে বর্ণহীন করে দেয়। নবীন শিক্ষার্থীরা শুরুতে সিনিয়রদের নিয়ে অনেক বেশি ভীত শঙ্কিত থাকে। কারাগারে আসামিরাও হয়তো পুলিশের ভয়ে এতটা শঙ্কিত থাকে না। র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে অসংখ্য শিক্ষার্থীর স্বপ্ন ভেঙে কাচের গ্লাসের মতো টুকরো টুকরো হয়ে যায় নিমিষেই। সম্প্রতি শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী র্যাগিংয়ের অভিযোগ উঠেছে। কিছু দিনের মধ্যেই দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নবীনদের ক্লাস শুরু হবে। একই সঙ্গে তখন পরিচিতি পর্বের নামে শুরু হবে র্যাগিং অপসংস্কৃতি। এসব র্যাগিংয়ের ধরন এতটাই ভয়াবহ ও মারাত্মক যে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা কখনও কখনও আত্মহননের পথ পর্যন্ত বেছে নেয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পা ফেলতে না ফেলতেই শিক্ষার্থীদের ম্যানার শেখানোর নাম করে শারীরিক অত্যাচার, মানসিক ভাবে হেয়প্রতিপন্ন করা, বিবস্ত্র অবস্থায় ছবি বা ভিডিও ধারণ, আপত্তিকর কাজ করতে বাধ্য করা এবং লাঞ্ছিত করা আজকাল যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ চিত্র। সিনিয়ররা র্যাগিংকে ‘ম্যানার শেখানো’ বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তাহলে নবীন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গালাগালি করা, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করতে বাধ্য করা, মেয়ে শিক্ষার্থীদের অশোভন উপায়ে প্রেমের প্রস্তাব দেয়া, ছেলেদের মাধ্যমে নেশাদ্রব্য আদান প্রদান করা কি ম্যানারের অন্তর্ভুক্ত? সবার সামনে এরকম ভয়াবহ আচরণের বাইরেও ব্যক্তিগতভাবে অনেকেরে রুমে ডেকে দরজা জানালা বন্ধ করে অমানবিক নির্জাতন করার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব বিষয় বাইরে আসে না। কারণ ভয়ভীতি প্রদর্শন করে এসব ভয়ংকর অত্যাচারের কথা গোপন রাখতে বাধ্য করা হয়। এমতাবস্থায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে, পড়াশোনার গতি হারিয়ে ফেলে এবং ক্যাম্পাসে ফিরতে ভয় পায়। তাদের স্বপ্ন ভঙ্গের অব্যক্ত অনুভূতি ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী এবং পরিবার ছাড়া আর কেউ প্রকৃতপক্ষে উপলব্ধি করতে পারে না। র্যাগিংয়ের পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ঢিলেমি সবচেয়ে বড় কারণ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিশ্বিবদ্যালয় কর্তৃপক্ষ র্যাগিংয়ের অভিযোগকে সেভাবে গুরুত্ব দেন না। র্যাগিং বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণের কথা শোনা গেলেও সত্যিকার অর্থে সেটা কার্যকর হয় না। এখন পর্যন্ত র্যাগিংয়ের মাধ্যমে যত ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে এর সঙ্গে বিভিন্ন প্রভাবশালী সংগঠনের সদস্যদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রে নবীন শিক্ষার্থীদের ব্রেইন ওয়াশ করে নিজ দলে ঢুকানোর অপচেষ্টা স্বরূপ র্যাগিংকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়। অত্যধিক চাপে পড়লে প্রশাসন দায় এড়াতে তাদের সাধারণত সাময়িক বহিষ্কার করেন, যা অপরাধীদের কাছে কোনো শাস্তির মধ্যেই পড়ে না। এতে তারা পরে আরও ভয়াবহ কাণ্ড ঘটায়। বিশেষত মেয়ে শিক্ষার্থীদের যৌন হেনস্তা করার মতো ঘটনা তো বর্তমানে নিত্য দিনের চিত্র। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অন্যুায়ী তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিত তাহলে ক্যাম্পাস থেকে র্যাগিং ডাইনোসরের মতো বিলুপ্ত হয়ে যেত। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি একজন ছাত্রী র্যাগিংয়ের ঘটনায় অপরাধীদের আজীবন বহিষ্কার করেছে, যা নিঃসন্দেহে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এতে ওই ক্যাম্পাসে র্যাগিংয়ের ঘটনা অকল্পনীয়ভাবে কমবে। শিক্ষাঙ্গন থেকে র্যাগিংয়ে বিষবাষ্প দূর করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কঠোর অবস্থান এবং সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয় মুক্ত জ্ঞান চর্চার লীলাভূমি। এখানে সিনিয়র, জুনিয়র সম্পর্ক হবে অত্যন্ত সৌহার্দপূর্ণ। এতে সবাই মিলে পড়াশোনা, সহশিক্ষা কার্যক্রম এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের মাধ্যমে জ্ঞানের নতুন নতুন রাজ্য তৈরি করতে সক্ষম হবে এবং দেশ ও জাতিকে সমৃদ্ধ করতে পারবে। অন্যদিকে, র্যাগিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ভালো কার্যক্রমের অন্তরায় যা জুনিয়রদের জ্ঞান চর্চায় অংশগ্রহণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং বন্ধে প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ নেয়া এখন সময়ের দাবি।
উম্মে সুমাইয়া ইয়াসমিন
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়