বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার দায় কার

মো. সাইফুল মিয়া: আমাদের দেশে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা খুব নগণ্য। শিক্ষার্থীর তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংখ্যা কম হওয়ার কারণে প্রতিযোগিতাও অনেক। এ জন্য শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষায় নামতে হয়। শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আসন নিশ্চিত করতে কতটা পরিশ্রম, ত্যাগ ও সংগ্রাম  করতে হয়, তা একজন শিক্ষার্থী ছাড়া কেউ জানে না। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ মেধাবী বলা হয়। এ মেধাবী শিক্ষার্থীদের ঘিরে পরিবার, দেশ ও জাতির অনেক স্বপ্ন থাকে। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে তারা দেশ ও জাতিকে আলোকিত করবে। অথচ এসব শিক্ষার্থীর যখন হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে নিজের গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে, তখন ব্যাপারটা উল্টো হয়ে যায়। করোনা সংক্রমণের সময়ে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যাও লাগামহীনভাবে বেড়েছে। এতে ভেঙে যায় দেশ ও পরিবারের স্বপ্ন। সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্ধশতাধিক জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা এবং অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণের ভিত্তিতে আত্মহত্যা-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। তাদের মতে, ২০২১ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্বিবিদ্যালয়ে ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এ সংবাদটি দেশ ও জাতির জন্য মোটেই সুখকর ব্যাপর নয়। মোট আত্মহত্যার ঘটনার মধ্যে শতকরা ৬১.৩৯ শতাংশ শিক্ষার্থীই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের। এ ছাড়া মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ জন, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ জন এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।

আত্মহত্যার পেছনে প্রধান কারণগুলো হলোÑসম্পর্কের অবনতি, পারিবারিক জটিলতা, পড়াশোনা নিয়ে হতাশা এবং আর্থিক সংকট। এর মধ্যে সম্পর্কের অবনতির কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে; যা শতকরা হিসাবে মোট আত্মহত্যার ২৪.৭৫ ভাগ। আমাদের দেশের সমবয়সী বিয়ে হাতেগোনা কয়েকটা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সমবয়সী সম্পর্কের বেশিরভাগ ফলাফল শূন্য থাকে। সাধারণত আমাদের পরিবারের মেয়ে সন্তানকে অনার্স পড়ার সময় বিয়ে দিয়ে দেয়। তারপরই পারিবারিক সমস্যার কারণে ১৯.৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। করোনায় মানুষের জীবন ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে। বেড়ে গেছে সামাজিক, আর্থিক ও পারিবারিক চাপ। আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া অধিকাংশ শিক্ষার্থী নিন্মবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের। একটা শিক্ষার্থীর অনার্স পর্যায়ে এসেও যখন বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে পড়াশোনা করতে হয়, তখন সহজেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা কাজ করে। অনার্সপড়ুয়া তৃতীয় এবং চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার তুলনামূলক বেশি, যা ৩৬.৬৩ শতাংশ। এ সময় শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ারকেন্দ্রিক সামাজিক চাপ বেশি থাকে এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার কারণে তাদের মধ্যে হতাশার ছাপ বেশি দেখা যায়। এ ছাড়া মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ১৫.৮৪ শতাংশ, পড়াশোনা-সংক্রান্ত কারণে ১০.৮৯, আর্থিক সমস্যায় ৪.৯৫, মাদকাসক্ত হয়ে ১.৯৮ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণে ২১.৭৮ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। ২০২১ সালে আত্মহত্যা বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ, দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষার্থীদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, দুশ্চিন্তা, বন্ধুবান্ধব থেকে দূরত্ব ও হতাশায় সময় পার করছে। যার কারণে সহজে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে।

মনে রাখতে হবে, মানুষ মরণশীল। ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে কেউই স্থায়ী নয়। দুনিয়ার টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদ, পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব সবাইকে ছেড়ে একদিন পাড়ি জমাতে হবে ওপাড়ে। তবে অসময়ে ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দেয়া কাম্য নয়। অভাব, অপ্রাপ্তি জীবনেরই অংশ। তাই বলে ভেঙে পড়লে চলবে না। সাহসের সঙ্গে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। মেধা ও যোগ্যতা থাকলে জীবনের একটা সময় সাফল্য আসবেই। শুরু উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

শিক্ষার্থীরা দেশের আগামী কর্ণধার। আজকের শিক্ষার্থীরাই একসময় দেশ পরিচালনা করবে। তাই শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে হলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। শিক্ষকদের বন্ধুসুলভ ব্যবহার করতে হবে। শিক্ষার্থীদের সফলতার মতো ব্যর্থতাকে মেনে নেয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। আত্মহত্যার উপকরণ, যেমন ঘুমের ওষুধ, কীটনাশকের সহজলভ্যতা কমাতে হবে। অনেক পরিবারে মা-বাবা ব্যস্ততার কারণে সন্তানকে সময় দিতে পারে না। এ জন্য পারিবারিক বন্ধনগুলো দৃঢ় করতে হবে আর পরিবারে প্রত্যেকের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে। গণমাধ্যমে আত্মহত্যার কুফল সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে কোনো আত্মহত্যার ঘটনাকে খুব মহৎ করে দেখানোর চেষ্টা করা যাবে না। শিক্ষার্থীদের অলস সময় পার করে দেয়া যাবে না। সৃজনশীল ও কর্মমুখী কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে। পর্যাপ্ত সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। শিশুকাল থেকেই ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। সব ধর্ম আত্মহত্যাকে ঘৃণ্যতম মহাপাপ বলে আখ্যায়িত করেছে। 

পাশাপাশি দীর্ঘদিনব্যাপী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। সর্বোপরি, নিজেকে ভালোবাসতে হবে।

শিক্ষার্থী

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০