বিশ্ববিদ্যালয় সরকারশাসিত নাকি স্বায়ত্তশাসিত

ইমরান লস্কর: জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী শাসনের পতনের পর দেশে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে, এটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকার কত দিন শাসন করবে, তা এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। উপদেষ্টাদের কোনো কোনো বয়ান থেকে শোনা যায়Ñ‘জণগন যতদিন চাইবে ততদিন সরকার থাকবে।’ তবে এরই মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের অভ্যন্তরীণ নানা খাতে সংস্কারের কাজ করছে, যা জাতীর সম্মুখে কার্যত দৃশ্যমান। এই সরকারের প্রতি বিপ্লবোত্তর জনগণের অনেক আশা ও আকাক্সক্ষা রয়েছে। কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারবে, তা আগামী সময় হয়তো বলে দেবে। জনমতহীন গত সরকারের আমলে অবকাঠামোগত কিছু দৃশ্যমান কাজ হয়েছে, যা তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত অসুস্থ শরীরকে ঢাকতে পারেনি। কথায় আছেÑ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না।’ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয়তো পোশাকি কোনো উন্নয়ন বা সংস্কার করবে না, যা দিয়ে জনগণের সামনে তাদের শরীরকে ঢাকতে হবে।

বলা হয়ে থাকে, ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড।’ যে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যতটা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর, সে দেশের মানুষের মেরুদণ্ড ততটা শক্তিশালী। সংস্কারের প্রশ্নে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার খুব জরুরি। সে কাজ এখন চলমান ও প্রক্রিয়াধীন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা, প্রশাসনিক কাঠামোর পরিবর্তন ও সংস্কারের প্রশ্নে জোড়ালো কোনো দৃশ্যত উদ্যোগ চোখে পড়েনি। গত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ব্যবস্থা যেমন ছিল, ঠিক তেমন রেখেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নিয়োগকাজ চলমান। ব্যক্তি উপাচার্যের যোগ্যতা কতটুকু, গবেষণা খাতে পদচারণা কেমন এবং কতটা শিক্ষার্থীবান্ধবÑএসব প্রশ্নের আগে প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের সিস্টেম ও প্রক্রিয়া কেমন? বিশেষ করে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কোন প্রক্রিয়ায় সেতু পাড়ি দিয়ে উপাচার্য নিয়োগ করা হয়?

ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা ছয়টিÑঢাবি, রাবি, চবি, জাবি, বুয়েট ও ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, যা একাত্তরের স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জন করেছে। পাকিস্তান আমলে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য নিয়োগ পেত সরকারের পছন্দের ব্যক্তিরা। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, সরকারের পছন্দের ব্যক্তিরা অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন না, তারা আমলা ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সরকারের আমলা থেকে উপাচার্য নিয়োগ করে ক্যাম্পাস নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করা হতো। তখন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলেন শেরেবাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ ব্যক্তি। কিন্তু বিভিন্ন আন্দোলন, সংগ্রাম ও অস্থিতিশীল দেশে এই দাবি বাস্তবায়িত হয়নি। পরবর্তী সময়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই দাবি ফের সামনে আসে এবং ১৯৭৩ সালে বুয়েট ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকি চারটা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের জন্য সংসদে আলাদা আলাদা অধ্যাদেশ পাস হয়, যা ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ নামে পরিচিত। এই অধ্যাদেশ বলেই স্বাধীন বাংলাদেশে চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় খ্যাতি লাভ করে। প্রশ্ন হলো, এই অধ্যাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে আদতে স্বায়ত্তশাসন আছে কি?
’৭৩-এর অধ্যাদেশে যে স্বায়ত্তশাসনের কথা ব্যক্ত হয়েছে, তা আদতে একটি কাল্পনিক ধারণামাত্র। পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন, ‘কীভাবে?’ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ করে থাকেন রাষ্ট্রপতি, যিনি ক্ষমতাবলে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সুপারিশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নিয়োগ পেয়ে থাকেন। আর রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্বাহী প্রধান হলেন প্রধানমন্ত্রী। একটু খেয়াল করুন, যে রাষ্ট্রপতি নিজে নিয়োগ পায় ক্ষমতাসীন সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে, সে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে। এখানে স্বায়ত্তশাসন থাকল কোথায়? সরকারের পছন্দের শিক্ষক ছাড়া কি উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হবে?

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ছাত্ররাই সব কালো সিস্টেম ভেঙে দিতে সক্ষম। রাষ্ট্রের সরকার হচ্ছে ক্ষমতার রাক্ষস, অর্থের ভক্ষক। যে সরকার যখন ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করে, সে সরকার আর ক্ষমতা ছাড়তে চায় না, রাজকীয় মসনদকে নিজেদের পৈতৃক সম্পত্তি ভাবতে শুরু করে। রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, ‘এটা মানবজাতির সহজাত বৈশিষ্ট্য, যা জঘন্যতর খারাপ।’ রুশ বিপ্লব থেকে শুরু করে চীনা বিপ্লব, জাপানের জেঙ্গারুনদের বিপ্লব থেকে জুলাই অভ্যুত্থানÑসবকটি সরকার পতনের কাজ ছাত্ররাই করেছে। এজন্য যেকোনো সরকারের প্রথম ভয় থাকে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ওপর’, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটি ক্যাম্পাসে নিজেদের আধিপত্য ও কর্তৃত্ব কায়েম করতে চায়। বড় আশ্চর্যজনক বিষয়, ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে একটা আইনি ফাঁকফোকর রাখা আছে, যার মাধ্যমে পছন্দের ব্যক্তি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক শাসনকাজ সম্পাদন করা যেতে পারে, যা ঘুরেফিরে পাকিস্তানি আমলের মতোই।

বিশ্ববিদ্যালয় হলো একটি স্বাধীন ও মুক্ত জায়গা, যেখানে মুক্ত আলাচনা ও ভিন্নমত চর্চা হবে। সেই মুক্ত চর্চার জায়গাটা রুদ্ধ করে দিলে জাতির মুক্তি মেলা অসম্ভব। অন্তত আর যাই হোক, জ্ঞানচর্চা হবে না। জ্ঞানের ঢেউ সাগরের স্রোতের তরঙ্গের মতো, তাকে থামানো যায় না। অথচ ক্ষমতাসীন সরকারের লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি ও শিক্ষকরাজনীতির কারণে ক্যাম্পাসে ‘ছাত্র থেকে শিক্ষক’ কেউই ভিন্নমত পোষণ ও লালন করতে পারেনি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বৃহৎ পরিসরে এই চরম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে গত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী আমলে। কোনো ছাত্র যদি ভিন্নমত পোষণ করতেন, কোনো শিক্ষক যদি গঠনমূলক সমালোচনা করতেনÑসরকারশাসিত ছাত্র ও শিক্ষকরা তাদের লাঞ্ছিত ও অপমানিত করতেন। এটা একমাত্র সম্ভব হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে, যার প্রধান হলেন উপাচার্য।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন ঘটিয়ে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উপাচার্য নিয়োগ এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে যোগ্য ও ছাত্রবান্ধব শিক্ষককই হয়তো নিয়োগ দেয়া হয়েছে, কিন্তু এই সরকার কি আর আজš§ থেকে যাবে? অন্য কোনো রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে এই উপাচার্যদের রাখবে বলে আপনাদের ধারণা? তাই দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা হলোÑসিস্টেমের সংস্কার ও পরিবর্তন।

অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকার সংবিধান সংস্কারের কথাও বলছেন। স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কীভাবে পুরোপুরি স্বায়ত্তশাসনের আওতায় আনা যায়, যেখানে কোনো রাজনৈতিক সরকার চাইলেই তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে উপাচার্যের আসনে বসাতে না পারে, সেদিক বিবেচনা করে ’৭৩-এর অধ্যাদেশ সংস্কার করা উচিত। অন্যথায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা আজš§ রাজনৈতিক কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে থাকবে। শিক্ষার মুক্তি না মিললে এ বাংলাদেশি জাতির মুক্তি মিলবে না। স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় হলো স্বাধীন দেশের মধ্যে আরেকটা স্বাধীন ছোট ভূখণ্ড, যে ভূখণ্ড নিজেদের আইনে চলবে, অর্থায়ন করবে জনগণের জাতীয় বাজেট থেকে। আমি মনে করি, দেশের সব দুর্নীতি ও লেজুড়বৃত্তিক সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে যুগোপযোগী ও গ্রহণযোগ্য সংস্কার করা উচিত। এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকারÑব্যক্তি পরিবর্তনই সংস্কার নয়, সিস্টেম পরিবর্তনই আসল সংস্কার, যা টেকসই। যদি তা না করা হয়, তবে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় সরকারশাসিতই থেকে যাবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০