বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

কাজী ফারহানা ইসলাম: জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বে একটি নিয়মিত ঘটনা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা নামে পরিচিত।

জলবায়ু বলতে আমরা কোনো এলকা বা ভৌগোলিক অঞ্চলের ৩০-৩৫ বছরের গড় আবহাওয়াকে বুঝি। বিজ্ঞানের ভাষায় একে গ্রিনহাউস প্রভাবও বলা হয়ে থাকে।

জলবায়ু পরিবর্তন কয়েকটি নিয়ামকের ওপর নির্ভর করে, যেমনÑভূত্বক গঠনের পাততত্ত্ব, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, জৈব প্রক্রিয়া এবং পৃথিবী কর্তৃক সৌর বিকিরণের পরিবর্তন প্রভৃতি।

বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে নানা রকমের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যেমনÑঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, সাইক্লোন, খরা, জলোচ্ছ্বাস, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, আকস্মিক বন্যা প্রভৃতি। এর ফলে মানব ও প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে প্রতিবছরই কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতায় সৃষ্ট সমস্যার হুমকির মুখে পড়েছে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ।

জলবায়ুর পরিবর্তন-সংক্রান্ত আন্তঃসরকার কমিটি বা আইপিসিসির এক গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্টে বলা হয়েছে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এখন যে চরম তাপপ্রবাহ, প্রচণ্ড ভারী বৃষ্টি, খরা বা সাইক্লোন হতে দেখা যাচ্ছে, তাতে জলবায়ুর এই পরিবর্তন স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।

শিল্পযুগের আগে পৃথিবীপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা যা ছিল, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে সেই তাপমাত্রা এক দশমিক শূন্য পাঁচ ডিগ্রি বৃদ্ধি পাবে। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য আগে যতটা সময় লাগতে পারে বলে ধারণা করা হয়েছিল, এখন বলা হচ্ছে তার ১০ বছর আগেই সেটা ঘটে যাবে।

জাতিসংঘ বলেছে, এর ফলে বিশ্বে চরম আবহাওয়া পরিস্থিতি তৈরি হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, একমাত্র কার্বন নির্গমনের মাত্রা কমিয়ে আনার মাধ্যমে এই পরিবর্তনের গতি কমানো সম্ভব।

আইপিসিসি রিপোর্ট যে মূল বিষয়গুলো তুলে ধরেছে: ২০১১ থেকে ২০২০ এই এক দশক সময়কালে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ১৮৫০-১৯০০ এই সময়কালের থেকে এক দশমিক শূন্য ৯ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে।

১৮৫০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত থাকা রেকর্ড অনুযায়ী গত পাঁচ বছর ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে উষ্ণতম।

১৯০১-১৯৭১ সময়কালের সঙ্গে সমুদ্রের পানির স্তরের উচ্চতার সাম্প্রতিক তিনগুণ হার বৃদ্ধি পেয়েছে।

গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী হিমবাহগুলো গলে যাওয়া এবং আর্কটিকে সামুদ্রিক বরফস্তর কমে যাওয়াÑএ দুটির পেছনে যে মানুষ দায়ী, তার সম্ভাবনা জোরালো (৯০ শতাংশ)

এটা এখন প্রায় নিশ্চিত, গত শতকের পঞ্চাশের দশকের পর থেকে অতিরিক্ত গরম পড়া এবং তাপপ্রবাহ অনেক বেশি ঘনঘন ঘটছে, কিন্তু অন্যদিকে ঠাণ্ডা পড়ার তীব্রতা কমে যাচ্ছে এবং তা ঘনঘন হচ্ছে না।

রিপোর্টে জাতিসংঘের বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের কর্মকাণ্ড পরিবেশের ওপর যে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে, তা মানবসমাজের জন্যএকটি লাল সংকেত।

রিপোর্ট প্রণেতারা আরও বলছেন, এ শতাব্দীর শেষ নাগাদ সমুদ্রের পানির স্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির পরিমাণ দুই মিটারের কাছাকাছি চলে যাওয়ার শঙ্কা এখন উড়িয়ে দেয়া যাবে না।

তবে রিপোর্টে এ কথাও বলা হয়েছে যে, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও মিথেনের মতো গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বড় আকারে কমাতে পারলে তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে স্থিতিশীল অবস্থায় আনা যাবে। এমন নতুন আশাবাদের সৃষ্টিও হয়েছে।

আগামী দশকগুলোয় সমগ্র বিশ্ববাসীকে জলবায়ু পরিবর্তন নামক চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর সম্মুখীন হতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত প্রভাব মূল্যায়নের জন্য ১৯৮৮ সালে গঠিত Intergovernmental Panel on Climate Change (IPCC) -এর চতুর্থ মূল্যায়ন রিপোর্ট অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তা ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ধারণা করা হচ্ছে, ২১০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা ১.১-৬.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বহু প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীর বসবাসের অনুকূল পরিবেশও ধ্বংস হয়ে যাবে।

২০৮০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৩৪ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে ধারণা করে হচ্ছে। বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, মিশর, ভিয়েতনাম, ফিজি, কিরিবাতি প্রভৃতি দেশের উপকূলীয় অঞ্চল সমুদ্রে বিলীন হয়ে যেতে পারে। কৃষিজমি লবণাক্ত হয়ে উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পাবে এবং কোনো কোনো অঞ্চলে বন্যার প্রবণতা বেড়ে যাবে, আবার কোনো কোনো অঞ্চলে বন্যার প্রবণতা কমে যাবে। ঘূর্ণিঝড় ও খরার প্রবণতা দেখা দেবে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাবে এবং সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে। মাটির উর্বরতা হ্রাস ও প্রাকৃতিক জলাশয়ের উৎস বিনষ্ট হয়ে যাবে। ওজোন স্তরের কার্যক্রম নষ্ট হয়ে যাওয়া ও সমুদ্রে অক্সিজেন দ্রবীভূত হওয়ার পরিমাণ হ্রাস হয়ে যাওয়ার মতো বিভিন্ন ধরনের হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে বিশ্ববাসী।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সমস্যাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে দেশগুলোর সরকারকে বলা হচ্ছে, বর্তমান শতকের মাঝামাঝি অর্থাৎ ২০৫০ সাল নাগাদ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। অর্থাৎ যে পরিমাণ গ্যাস নিঃসরিত হবে, তাতে বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে পরিবেশে ভারসাম্য সৃষ্টি করতে হবে। তাছাড়া যেসব কারণে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও ক্ষতিকর গ্যাসের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সেসব জিনিস ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। জমিতে কীটনাশক ব্যবহারের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। প্যাকেটজাত খাবারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। তবেই তাপমাত্রা বৃদ্ধির দ্রুত গতিকে কমিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব বলে আশা করা যায়।

শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

kfislam29@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০