নিজস্ব প্রতিবেদক: বর্তমান বিশ্বে পরিকল্পনার ধরনই বদলে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রথম বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য, প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ, সমাজতাত্ত্বিক এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, আগে জাতিসংঘের অধীনে একটি ‘কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানিং’ নামে কমিটি ছিল। আমি নিজে এটির সদস্য ছিলাম। বাংলাদেশ থেকে আরও অনেকেই পর্যায়ক্রমে ওই কমিটির সদস্য হয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে সেই কমিটি নামই বদলে গেছে। এটি এখন কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি। কেবল জাতিসংঘ নয়, আমাদের দেশেও পরিকল্পনা কমিশনের কাজের ধরন পাল্টে গেছে। নীতি প্রণয়নে এ কমিশন এখন তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তারা কিছু পরিকল্পনা প্রণয়ন করে ঠিকই, কিন্তু সরকার মূল নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করে অর্থ মন্ত্রণালয়।’
রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডির নিজস্ব কার্যালয়ে গতকাল নিজের আত্মজীবনীমূলক বইয়ের দ্বিতীয় কিস্তি ‘আনট্রাঙ্কুইল রিকালেকশন্স: ফ্রম ডন টু ডার্কনেস’ শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উম্মোচন অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। আত্মজীবনীমূলক এ গ্রন্থে স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত লেখকের কর্মজীবনে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা উল্লেখ করেছেন লেখক।
রেহমান সোবহান বলেন, পরিকল্পনা কমিশন পঞ্চম বার্ষিক পরিকল্পনার মতো কিছু পরিকল্পনা করে। কিন্তু এগুলো প্রণয়নের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানসম্পন্ন লোকবল কমিশনের নেই। তারা এগুলো করে বাইরের বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে কখনও কখনও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) মতো প্রতিষ্ঠান থেকে বিশেষজ্ঞ নিয়ে কাজ করে পরিকল্পনা কমিশন। তবে মূল যে নীতিনির্ধারণের কাজ, সেটা সম্পন্ন করে অর্থ মন্ত্রণালয়। তিনি আরও বলেন, কেবল বাংলাদেশই নয়, ভারতসহ আরও অনেক দেশে নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নের কাজ এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ই সম্পন্ন করে। পরিকল্পনা কমিশনের মাধ্যমে নীতিনির্ধারণের রেওয়াজ একপ্রকার উঠেই গেছে।
প্রথম বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের এই সদস্য বলেন, ‘দেশের উন্নয়নের জন্য নীতি প্রণয়ন সহজ, কিন্তু বাস্তবায়ন করা কঠিন। আমি পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দেখেছি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমলাদের সঙ্গে কমিশনের নীতিনির্ধারকদের দ্বন্দ্ব হতো। তবে এখন আর সেই দ্বন্দ্ব দেখা যায় না। কারণ এখন সবকিছুই আমলাদের হাতে। এখন আর বাইরে থেকে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়ার রেওয়াজ নেই। কাজেই একাডেমিশিয়ানদের সঙ্গে আমলাদের এখন আর দ্বন্দ্বের কোনো সুযোগ নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্বাধীনতার আগে পাকিস্তানে সচিব পর্যায়ে যেসব আমলারা ছিলেন তাদের কিছুটা গুরুগম্ভীরতা ছিল। তারা বেশি বেশি সালামের আশা করতেন। সেই কালচারটা স্বাধীন বাংলাদেশেও চলে এসেছিল স্বাধীনতার পরপর। কিন্তু এ সংস্কৃতি বঙ্গবন্ধু চাননি, আমরাও চাইনি।’ এ সময় তিনি তার প্রকাশিত বই নিয়ে বলেন, ‘এটি একটি আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ। এই গ্রন্থে মূলত উঠে এসেছে রাজনৈতিক অর্থনীতির কথা। বিশেষ করে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনা এবং আমাদের কর্মজীবনের বিষয়গুলো এসেছে এখানে। আমি আসলে এর মাধ্যমে প্রকাশ করতে চেয়েছি তৎকালীন বাংলাদেশের বাস্তবতার বিষয়টি।’
এ সময় সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ও অনুষ্ঠানে সঞ্চালক রওনাক জাহান বলেন, বইটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল, যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তৎকালীন বাংলাদেশ সম্পর্কে জানাবে। বাংলাদেশ এ সময় নিয়ে গবেষণা করতে গেলে দেখা যায়, সে সময়কার কোনো তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায় না। সে জায়গায় বইটি গবেষকদের জন্যও একটি প্রাথমিক দলিল হিসেবে কাজ করবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বইটি একাধারে রাজনৈতিক অর্থনীতি, দেশের ইতিহাস, রেহমান সোবহানের কর্মজীবনকে প্রকাশ করবে। এ বইটি তরুণ প্রজš§কে জানাবে তাদের দেশ সম্পর্কে। কারণ বইটি স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের একটি নিরপেক্ষ উদ্দেশ্যহীনভাবে রচিত বই।’
সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এই বইটি পাঠকদের কাছে একাধারে ইতিহাসের একটি দলিল, রাজনৈতিক অর্থনীতির একটি পুস্তক এবং অর্থনৈতিক বিশেষণের উৎস হিসেবে কাজ করবে। বইটি বর্তমান সময়ের সঙ্গে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।
আলোচনায় দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, বইটিতে একাধিক বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এখানে রাজনৈতিক নেতৃত্ব সমাজতন্ত্রের রাজনৈতিক ধারণা এবং পরিকল্পনা কমিশনের সমাজতন্ত্রের ধারণার বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। বইটিতে অধ্যাপক রেহমান সোবহানের বৃহৎ জীবনের শুধু তিন বছরকে তুলে ধরা হয়েছে। বইটিতে পরিকল্পনা কমিশনের সূত্রপাত, দেশ গঠনে বঙ্গবন্ধুর নীতি এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি লেখকের অগাধ আস্থার বিষয়টি ফুটে উঠেছে, যা পাঠক-গবেষকদের অন্য মাত্রা দেবে।
মোড়ক উম্মোচন অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেনÑজাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল বায়েস, জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক বিদ্যাপীঠের মহাপরিচালক ড. আহরার আহমেদ, রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস বাংলাদেশের (আরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা প্রমুখ।