Print Date & Time : 1 July 2025 Tuesday 1:51 am

বিশ্বমানের হাসপাতালের অভাব বোধ করছেন উচ্চবিত্তরা

মাসুম বিল্লাহ: দেশের উচ্চবিত্ত জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে অনেকাংশেই বিদেশনির্ভর। বিশেষ করে সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডের হাসপাতালে বাংলাদেশিদের চিকিৎসা গ্রহণের হার বেশি। কিন্তু করোনার এ মহামারিকালে কোনো রোগীকে স্থানান্তর করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। আর যেসব রোগীর শরীরে করোনা জটিল রূপ ধারণ করছে, সেসব রোগীর চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতালে যে ধরনের সুবিধা থাকা প্রয়োজন, দেশের খুব কম হাসপাতালেই তা রয়েছে। ফলে করোনা-আক্রান্ত হলে কীভাবে চিকিৎসা নেবেন, সে বিষয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত নাগরিকরা।

করোনায় আক্রান্ত হয়ে এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু হয়েছে। আবার সংক্রমণের পর চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন বেশ কয়েকজন। কিন্তু আক্রান্ত উচ্চবিত্ত শ্রেণির এসব রোগী অন্য সময় বিদেশে চিকিৎসা নিলেও করোনার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক না থাকায় এবার যেতে পারেননি। ফলে অনেকেই উপযুক্ত চিকিৎসা পাননি বলে মনে করছেন। এমন পরিস্থিতিতে দেশে যদি বিশ্বমানের হাসপাতাল থাকত তাহলে চিকিৎসাসেবার উন্নয়নের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ অর্থও দেশে থাকত।

সরকারি খাতে দেশে সবচেয়ে বড় হাসপাতাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এখানেই সবচেয়ে বেশি রোগীর চিকিৎসা হয়। কিন্তু রোগীর চাপ বেশি থাকা ও পরিচ্ছন্নতার অভাব থাকায় একটু সচ্ছল মানুষজন এ হাসপাতাল এড়িয়ে চলতে চান। যদিও এ হাসপাতালের চিকিৎসা সরঞ্জাম আধুনিক মানের, কিন্তু দক্ষ জনবলের অভাবে সেগুলোর প্রকৃত সুফল পাওয়া যায় না। পাশাপাশি হাসপাতালটিতে প্রতিদিন যত রোগী সেবা নিতে আসেন, তাদের অনুপাতে চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয়সহ অন্যান্য জনবলের ব্যাপক ঘাটতি বিদ্যমান। হাসপাতালটিতে করোনা ইউনিট খোলা হলেও সেখানে উচ্চবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্তদের চিকিৎসা নেওয়ার হার কম।

আর দ্বিতীয় বৃহত্তম সরকারি হাসপাতাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)। দুই হাজার ৩০০ শয্যার এ হাসপাতালে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও শুরুর দিকে দীর্ঘদিন করোনা চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। এখানেও আধুনিক মানের সরঞ্জাম আছে। কিন্তু এসব হাসপাতাল সেবাদানে সব শ্রেণির আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়নি। তাই সহজে সেবাপ্রাপ্তির মাধ্যম হিসেবে বেসরকারি হাসপাতালকে বেছে নেন পয়সাওয়ালারা।

এ বিষয়ে বেরসকারি খাতের মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘করোনা মহামারিতে উন্নত রাষ্ট্রগুলোও হিমশিম খেয়েছে। তবে এ পরিস্থিতিতে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত হয়েছে। এখন সময় হয়েছে স্বাস্থ্য খাত ঢেলে সাজানোর। এজন্য সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসা কাজে জড়িত সরকারি ও বেসরকারি খাতের হাসপাতালগুলোকে একটি মানদণ্ডের আওতায় এনে পরিচালনা করা প্রয়োজন। এটির ঘাটতিতে করোনাকালেও দুর্নীতি ও অনিয়ম হচ্ছে। সরকারও তো অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে, আরও বরাদ্দ প্রয়োজন। কিন্তু যারা বাস্তবায়নের কাজ করছে, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। এটি করা গেলে বিশ্বমানের স্বাস্থ্যসেবা দেশেই পাওয়া সম্ভব।

এদিকে উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ বেসরকারি হাসপাতালের শরণাপন্ন হলেও দেশে বিশ্বমানের কোনো বেসরকারি হাসপাতালও নেই। বর্তমানে আধুনিক বেসরকারি হাসপাতালের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এভারকেয়ার (সাবেক অ্যাপোলো), পান্থপথের স্কয়ার ও গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতাল। কিন্তু এসব হাসপাতালের মানও বিশ্বমানের নয়। এগুলোর মান ভারতের মধ্যম শ্রেণির বেসরকারি হাসপাতালের সমান বলে সেবাগ্রহীতাদের অভিমত। তাই দেশের উচ্চবিত্তদের বড় অংশই চিকিৎসায় আস্থা রাখেন বিদেশি হাসপাতালের ওপর। কিন্তু করোনার এ সময়ে বিদেশ যাওয়া অত্যন্ত দুরূহ। এমন পরিস্থিতিতে দেশে যদি সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ বা থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদের মতো হাসপাতাল থাকত, তাহলে অনেকেই চিকিৎসা নিতে পারতেন বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন।

স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতির বিষয়ে জানতে চাইলে এনভয় গ্রুপের পরিচালক ও সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মূর্শেদী শেয়ার বিজকে বলেন, আমাদের জনসংখ্যার অনুপাতে স্বাস্থ্যসেবায় ঘাটতি আছে। তবে সরকারের ত্রুটির কমতি আছে বলে মনে হয় না। তবে দেশে এখন বেসরকারি খাতে বেশকিছু ভালো হাসপাতাল হয়েছে। এ ধরনের বা এর চেয়ে ভালো মানের আরও হাসপাতাল হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি দেশীয় সেবার প্রতি যাতে মানুষ আস্থাশীল হয়, সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তবে এটা সত্য, করোনা সারা বিশ্বের জন্যই একটি নতুন পরিস্থিতি। স্বাস্থ্যসেবায় যারা আধুনিকতার দাবিদার তারাও এ মহামারি মোকাবিলায় নাস্তানাবুদ হয়েছেন। কাজেই খুব উন্নত মানের চিকিৎসাসেবার দাবিদার রাষ্ট্রও যে মহামারি মোকাবিলায় ভালো করেছে, এমনটি বলার সুযোগ নেই।

এদিকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে এরই মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন বেশ কয়েকজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। তাদের মধ্যে দু-একজন হাসপাতালের উদ্যোক্তাও রয়েছেন। মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে একজন সমরিতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক সংসদ সদস্য মকবুল হোসেন। যদিও তার চিকিৎসা চলছিল সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। করোনা-আক্রান্ত হয়ে গতকাল মৃত্যুবরণ করেন যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুল। তিনি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এছাড়া ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান ও নির্মাণ খাতের অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান মোনেম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল মোনেমও এই মহামারিকালে মৃত্যুবরণ করেছেন, যদিও তারা করোনা-আক্রান্ত ছিলেন না। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত মাসে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি রাজধানীর স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এছাড়া জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, এপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর সহধর্মিণী শিক্ষানুরাগী নিলুফার মঞ্জুরসহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির পাশাপাশি সরকারের বড় আমলা, বিভিন্ন হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক, পুলিশ সদস্যসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন। এছাড়া এমন আরও অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন, যাদের বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার সামর্থ্য ছিল। কিন্তু করোনার কারণে তারা বিদেশ যেতে পারেননি, আবার দেশের হাসপাতালেও আস্থা রাখতে পারেনি।

দেশের স্বাস্থ্যকাঠামো নিয়ে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইনন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি শামস মাহমুদ শেয়ার বিজকে বলেন, স্বাস্থ্যসেবার প্রাথমিক ধাপে সরকারের পরিকল্পনার সুফল পাওয়া যাচ্ছে। তবে চিকিৎসার সর্বোচ্চ ধাপে সেবা নিশ্চিতে আন্তঃবিভাগ সমন্বয় প্রয়োজন। আমাদের চিকিৎসকদের সংগঠনগুলো স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে মাঝে মাঝেই বিব্রতকর পরিবেশ তৈরি করে। এখানে নজর দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। চিকিৎসাকাজে জড়িত অন্যান্য খাতের জনবল, যেমন নার্স, টেকনিশিয়ান ও ফার্মাসিস্টদের দক্ষতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এজন্য স্বাস্থ্যসেবায় বেসরকারি খাতের বড় বিনিয়োগ ও বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না। আবার বাইরের দেশ থেকে জনবল আনলে ব্যয় বেড়ে যাবে। ফলে মানুষ চিকিৎসা নিতে পারবে না। সরকার এ খাতে অবকাঠামোসহ ইউটিলিটি সেবায় বিশেষ ছাড় দিলে অনেকেই এগিয়ে আসবে, যাতে চিকিৎসা খরচ সহনীয় পর্যায়ে থাকে।