Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 11:49 pm

বিশ্বের পথে একাকী

যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো অঙ্গরাজ্যের ভেইল শহরের বাসিন্দা জেনিফার। তার মা ছিলেন ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট, বাবা এভিয়েশন কর্মকর্তা। কর্মসূত্রে তার জীবনের অনেক সময় কেটেছে ভ্রমণ করে, বিশেষ করে উড়োজাহাজে চড়ে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর বিশ্বের চার মহাদেশের ৯টি দেশ তিনি ভ্রমণ করেছেন, একাকী। আজ থাকছে তার ভারত ভ্রমণের গল্প

ভারত: মার্চ ২৩-২৭, ২০০৮
পাঁচ দিনের জন্য ভারতে এসেছি। এই দেশের খাবার, আবহাওয়া, মানুষ, প্রাকৃতিক দৃশ্য প্রভৃতিকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমি সাধারণত ব্যাকপ্যাক ব্যবহার করি না। তবে ভারতে এসে সেই যে পিঠে ব্যাগ উঠিয়েছি আর নামাচ্ছি না। নিজেকে হিপ্পির মতো মনে হচ্ছে।
আজ ২৪ মার্চ কেরালার ঠেকেড্ডি স্টেশনের কাছে একটি ইন্টারনেট ক্যাফেতে বসে আছি। এখন পর্যন্ত মশা কিংবা সাপের কামড় খাইনি। আমার গাইড অ্যান্টনি বেশ ভালোই সামলাচ্ছে সবকিছু। সব ধরনের পরিবেশ সম্পর্কে আমাকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিচ্ছে ও।
পরদিন বিস্ময়কর একটি দিন কাটাই রাস্তায়। ভোরে আজানের ধ্বনিতে ঘুম ভাঙে। একটু পর মন্দিরের কাঁসর ঘণ্টা শুনতে পাই। কিছুক্ষণ পরে চার্চের ঢং ঢং। আমি সাধারণত লম্বা সফরে গাড়ি বেছে নিই। আজ অবশ্য মোটরসাইকেলে চষে বেড়াচ্ছি অনেক জায়গা। এখানকার ড্রাইভিংকে এক ধরনের উš§াদনা বলা চলেÑঅনেক মানুষ, অনেক সাইকেল, মোটরসাইকেল, ট্রাক, ভ্যান, অটোরিকশা, বাস সবখানে। ছোট একটি মোটরসাইকেলের সামনে বসা ছেলে, তার পেছনে মেয়ে, এরপর ড্রাইভার বাবা, এরপর আরও একটি মেয়ে এবং সবশেষে মা। বাতাসে উড়ছে মায়ের শাড়ির আঁচল। অদ্ভুত সুন্দর! কাদা, পাথর, গর্ত, গরুÑকী নেই রাস্তায়? রাস্তার মাঝখানে গরুগুলো ড্যামকেয়ার ভাব নিয়ে বসে থাকে। আমার মনে হয়, ওরা জানে ভূরিভোজ হিসেবে ওদেরকে কেউ বেছে নেবে না! সরু রাস্তা, রং সাইড দিয়ে ইচ্ছামতো গাড়ি চলছে, সজোরে। নেই কোনো সাইন। ফুল স্পিডে বাস আসছে, এর আগেই কেমনভাবে যেন দ্রুত মানুষ রাস্তা পার হচ্ছে। হ্যাঁ সত্যি বলছি। চিৎকার-চেঁচামেচিতে কানে তালা লেগে যায়। তবে ভীষণ উপভোগ করছি এই নতুন পরিবেশ। আমার মনে হয়, ভারতের এই অ্যাডভেঞ্চার ট্রিপকে খেলাধুলার অংশ করা যায়।
যাই হোক ২০ কিলোমিটার পথ এক ঘণ্টায় পাড়ি দিয়ে মুন্নারে চলে আসি। একসময় মনে হয় এখানে রাস্তা ছিল, এখন শুধুই ফুটপাত, পাথর, কাদা, গর্ত, গরু। আঁকাবাঁকা। দুই সেকেন্ড পরপর অ্যান্টনি হর্ন দিচ্ছিল। মুন্নারে যতদূর চোখ যায় কেবল চা বাগান। দুপুরের খাবার এখানকার একটি রিসোর্টে সারি। এরপর ১৯৭৩ সালে তৈরি একটি ইন্ডিয়ান জিপে লাফ দিয়ে উঠে বসি। ফোরহুইলারটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আট হাজার ২০০ ফুট ওপর দিয়ে চলছে। গতকাল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২০০ ফুট নিচে অ্যাপেলিতে সময় কাটিয়েছি। যাই হোক, রাস্তার পাশে কোনো বেষ্টনী নেই, শুধু ছয় ইঞ্চি পুরু মাটি। জিপে কোনো জানালা নেই, সিটবেল্টও নেই। ছোট একটি দরজা রয়েছে। আজ আমার ২৮তম বছরের শেষ দিন। আজই হয়তো থেমে যাবে জীবনের পথচলা। না তেমনটি ঘটেনি, বরং উল্টোটি ঘটেছে। এখানে এসে আমি যেন নবজীবন খুঁজে পেয়েছি। যদিও তিন ঘণ্টার সেই যাত্রা ছিল হয়তো জীবনের সবচেয়ে ঝুঁকিময় কাজ। সেই হƒৎস্পন্দন, সেই ব্রেক কষা ও হর্ন আজও কানে বাজে। এত হর্ন জিন্দেগিতেও শুনিনি।
১৮ বছর বয়সে ভেবেছিলামÑএই জীবনে কোন বিষয়টি উপভোগ করব সবার আগে। এই তালিকায় ছিল হোয়াইট হাউজে ঘুরে বেড়ানো, নিজের আঁকা চিত্রকর্ম বিক্রি করা ও ভারতে গিয়ে হাতির পিঠে চড়া। সার্থক আমার সব স্বপ্ন। ভারত ভ্রমণের শেষ দিন হাতির পিঠে চড়ি। আনন্দে চোখ ভিজে ওঠে। হাতির পিঠে চড়ে আধা ঘণ্টা জঙ্গলে বেড়াই।
যুক্তরাস্ট্রের বাইরে একাকী ঘুরে
বেড়াতে চাইলে প্যারিস কিংবা রোমের কথা ভুলে যান, চলে যান কেরালায়। আবারও আসব ভারতে। হয়তো এখানে একটি বাড়ি কিনব, কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বসব।

ভাষান্তর: রতন কুমার দাস