ইবিএল সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মো. ছায়েদুর রহমান। পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি তিনি পুঁজিবাজারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন শেয়ার বিজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জুবাইয়া ঝুমা
শেয়ার বিজ: বর্তমান কভিড পরিস্থিতি বিবেচনায় পুঁজিবাজারের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
ছায়েদুর রহমান: আন্তর্জাতিক জরিপ ও গণামাধ্যম বলছে, এখন বিশ্বের শেয়ারবাজারগুলোর মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী আমাদের শেয়ারবাজার। গত দুই মাসে আমাদের পারফরম্যান্স সবচেয়ে ভালো। এছাড়া আমাদের অর্থনীতি বিশেষ করে জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে কিন্তু পুঁজিবাজারের অবদান রয়েছে। পুঁজিবাজার উন্নয়নে বিএসইসি কর্তৃক অনেক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এখানে বিনিয়োগ করে ক্যাপিটাল গেইন করলে ব্যক্তিপর্যায়ের বিনিয়োগকারীদের কোনো ট্যাক্স দিতে হয় না। এটাও একটা বড় কারণ বিনিয়োগাকারীদের আগ্রহ বাড়ার। ফলে এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি বিনিয়োগকারী আসছেন। বাজারের গভীরতা যেমন বেড়েছে, তেমনি বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থাও বেড়েছে। কতিপয় আলোচক তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই ছাড়াই বলেন, বাজার বেড়ে গেছে বিষয়টি সঠিক নয়, কারণ সারাবিশ্বেই পুঁজিবাজার এক বছর ধরে ইতিবাচক ধারায় রয়েছে, বরং বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের আরও অনেক দূর যাওয়ার সুযোগ আছে।
শেয়ার বিজ: কভিড–পরবর্তী সময়ে নতুন বিশ্ব ও নতুন অবস্থা তৈরি হলে সেটা সম্পর্কে আমাদের পুঁজিবাজারের প্রস্তুতি কেমন বলে আপনি মনে করেন?
ছায়েদুর রহমান: দেখুন সময়ের সঙ্গে যুগের পরিবর্তন হচ্ছে, আর সেই পরিবর্তনের চালিকাশক্তি হলো প্রযুক্তি। আধুনিক বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে। আমাদের বাজারও প্রযুক্তিনির্ভর, তবে এখন পুরোপুরি ডিজিটাল হতে পারেনি। তবে উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান আছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাজার ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। এখন বিনিয়োগকারীকে সশরীরে আমাদের ব্রোকারেজ হাউসে এসে লেনদেন করতে হয় না, ইচ্ছা করলে প্রযুক্তির সহযোগিতায় যে কোনো স্থান থেকেই লেনদেনে সম্পৃক্ত থাকতে পারে। অর্থাৎ প্রযুক্তির সুযোগ ব্যবহার করে সবাই সহজেই বাজারের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। বিনিয়োগকারী সশরীরে না এলেও কার্যক্রমে কিন্তু বাধা আসছে না। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকেই তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছেন। একইভাবে শেয়ার কেনাবেচা, টাকা জমা-ওঠানো সব ধরনের কাজই বিনিয়োগকারী সশরীরে না এসেও করতে পারছে। এজন্য করোনার মধ্যেও লেনদেন বৃদ্ধি পেয়েছে। সশরীরে আসার জন্য সময় ব্যয় হতো, যাতায়াত খরচ হতো, কিন্তু প্রযুক্তির কারণে বিনিয়োগকারীদের এখন আর আসার প্রয়োজন হয় না, স্বাস্থ্যঝুঁকিও হয় না। এটা আধুনিকায়নের সুবিধা।
শেয়ার বিজ: বাজার স্থিতিশীল রাখতে ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় ব্রোকারেজ হাউসগুলো কি সঠিক দায়িত্ব পালন করে বলে আপনি মনে করেন?
ছায়েদুর রহমান: আপনি বলছেন আমরা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছি কি না, ব্রোকারেজ হাউসগুলো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে কি না না করলে বিনিয়োগকারীরা কিন্তু অভিযোগ করত। হয়তো টুকটাক কিছু অভিযোগ আসে, তবে খুব দ্রুতই তা সমাধান করা হয়। সেগুলো ধরার মধ্যে নয়। এখন ব্রোকারেজ হাউসগুলো নিয়ে বিনিয়োগকারীদের সুনির্দিষ্ট বড় কোনো অভিযোগ নেই। তার মানে সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে সতর্ক ও দায়িত্বশীল। আমরা তো ব্রোকার হিসেবে বিনিয়োগকারীদের নিরবচ্ছিন্ন সেবা দিয়ে যাচ্ছি। তবে শেয়ার কেনাবেচা ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা আইনগতভাবে তাদের কোনো পরামর্শ দিতে পারি না। মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ পরামর্শক হিসেবে কাজ করার সুযোগ বা অধিকার আছে। তারা বিনিয়োগকারীদের হিসাব পরিচালনা করতে পারেন। ব্রোকাররা সব সময় বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে আসছে এবং তাদের স্বার্থ রক্ষা করাই আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য।
এখানে একটা বিষয় বলতে হয়Ñপুঁজিবাজার কখনও স্থিতিশীল হয় না। পুঁজিবাজার সব সময় গতিশীল থাকে। পুঁজিবাজার যদি স্থিতিশীল হয় তাহলে তো থেমে যাবে। তাহলে বিনিয়োগকারীরা লাভবান হবে না। স্থিতিশীল বাজারে তো লাভ-লোকসান থাকে না। চলমান বা গতিশীল বাজারেই লাভ-লোকসানের হিসাব থাকে।
শেয়ার বিজ: বাজারের উত্থানের পর হঠাৎ পড়ে গেলে কারসাজির অভিযোগ আসে বারবার এ বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?
ছায়েদুর রহমান: আমি এটাকে যথার্থ মনে করি না। কেন দেখেনÑবাজারটা গতিশীল। যেটা আমি আগেও বলেছি। বাজার ওঠানামা করবে, এটাই স্বাভাবিক। বাজার খালি ওপরে উঠতে উঠতে আকাশচুম্বী হবে, এটা প্রত্যাশা করাটা হবে ভুল। বাজার মাঝে মাঝে সংশোধন হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক কোনো লেনদেন বা পরিবর্তন হলে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সেটা খতিয়ে দেখে এবং ব্যবস্থা নেয়। ঢালাওভাবে কারসাজি বলাটা মোটেও যথার্থ নয়, এটা উন্নয়নের জন্য প্রতিবন্ধকতা। কোনো তথ্য-উপাত্ত ছাড়া কারসাজি, একটা বাক্য আপনি বলে চলে গেলেন, অথচ এটার কোনো ব্যাখ্যা দিলেন না এতে বাজার নষ্ট হয় এবং বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এজন্য কারসাজির কোনো প্রসঙ্গ বলতে হলে সুনির্দিষ্ট করে বলতে হবে। কোনো উল্টোপাল্টা কমেন্টস করা থেকে সংশ্লিষ্টদের বিরত থাকা উচিত। আমাদের পুঁজিবাজার নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। তথ্য-উপাত্ত ছাড়া কথা বলা উচিত নয়।
শেয়ার বিজ: বাজারে ব্যাংক, বিমাসহ মৌলভিত্তির শেয়ার কি পর্যাপ্ত আছে বলে আপনি মনে করেন?
ছায়েদুর রহমান: আসলে ‘পর্যাপ্ত’ শব্দটা সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল। আমাদের একসময় মানুষ ছিল সাত কোটি, এখন বলে ১৮ কোটি। ফলে সব দিকে চাহিদা বাড়ছে, ব্যবসা-বাণিজ্য বড় হচ্ছে, পুঁজিবাজারও বড় হচ্ছে, বিনিয়োগকারী বাড়ছে। এটা কিন্তু সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত অবস্থা। এখানে ভালো শেয়ার কতগুলো আছে, আগে কতগুলো ছিল, এটা সময়ের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে কথা বলা উচিত। আমরা মনে করি, আরও বড় বড় শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি প্রয়োজন। তাহলে বাজারের গভীরতা আরও বৃদ্ধি পাবে, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী বাড়বে। এজন্য প্রয়োজনীয় আইন সহায়তা দরকার।
শেয়ার বিজ: অনেক দিন ধরে সরকারি কোম্পানির শেয়ার বাজারে আসার কথা, কিন্তু আসছে না। এটা নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?
ছায়েদুর রহমান: দেখুন যে কোনো প্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্ত হতে হলে অনেক নিয়মকানুন মেনে তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। এগুলো সম্পন্ন না করে কোনো কোম্পানি আসতে পারবে না। সেক্ষেত্রে আইনকানুনের বিষয়টাকে গুরত্ব দিতে হবে। আর সরকারি কোম্পানিগুলোর অনেক রকমের ইন্টারনাল জটিলতা ও বিধিবিধানের পরিপালন এবং ফরমালিটিজ থাকে। সেগুলো সম্পন্ন না করে তো তারা আসতে পারছে না। এ জায়গাগুলোয় সংশ্লিষ্টরা কাজ করছেন বলে মনে করি। এখানে অনেক দিন ধরে যে কোম্পানি আসছে না, সেটাও কিন্তু পুরোপুরি সঠিক নয়। কোনো কোম্পানি আগ্রহ প্রকাশ করলে এবং সব নিয়মকানুন পালন করলে বিএসইসি তাকে তালিকাভুক্ত হতে অনুমতি দেয়। আবার কেউ যদি বাজারে আসতে না চায়, তাকে জোর করে তালিকাভুক্ত করা যাবে না। তবে আর্থিক খাত ও টেলিকম খাতের কোম্পানিগুলো ছাড়া অন্য কোনো খাতের কিন্তু বাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
শেয়ার বিজ: বাজার স্থিতিশীল রাখতে বর্তমান কমিশন কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখছে বলে আপনি মনে করেন?
ছায়েদুর রহমান: আমি শুরুতেই বলেছিলাম, পুঁজিবাজার স্থিতিশীল নয়, গতিশীল। গত এক বছরের কার্যকলাপ যদি বিবেচনা করি তাহলে দেখতে হবে কমিশন অনেকগুলো উদ্যোগ নিয়েছে এবং সেগুলো খুব ভালোভাবে বাস্তবায়নও করতে পেরেছে। এর ফলে কিন্তু বাজারে গতিশীলতা এসেছে। আমি বলব তারা (বিএসইসি) অত্যন্ত সফল। তারা যে প্রত্যাশার কথা শুনিয়েছেন, সেগুলোর মধ্যে অনেকগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে এবং অবশিষ্টগুলো সামনের দিনে বাস্তবায়িত করবেন। এতে বাজার এগিয়ে যাবে। আশা করি এই কমিশন বাজারকে আরও শক্তিশালী ও বিনিয়োগযোগ্য আস্থার জায়গা তৈরি করতে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
শেয়ার বিজ: গত জুলাই মাসে বিও অ্যাকাউন্ট পাঁচ লাখেরও বেশি বন্ধ হয়েছেÑএর কারণ আপনি কী মনে করেন? বিনিয়োগকারীরা কি মার্কেট থেকে চলে যাচ্ছেন?
ছায়েদুর রহমান: সংখ্যাটা নিয়ে হয়তো কারেকশন আছে। তবে একশ্রেণির বিনিয়োগকারী আছেন, যারা শুধু আইপিও আবেদন করেন এবং যারা একাধিক বিও ব্যবহার করেন। কিন্তু অইপিও শেয়ার বরাদ্দের নিয়ম পরিবর্তন হওয়ায় তারা এখন আর শুধু আইপিওর জন্য বিও হিসাব রাখা লাভজনক মনে করছেন না। সেগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোনো বিনিয়োগকারী বাজার থেকে চলে যাননি, বরং নতুন বিনিয়োগকারী বাজারে এসেছেন বলেই কিন্তু বাজারটা এখন আগের তুলনায় অনেক গভীর ও শক্তিশালী। লেনদেনও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা আশা করছি, বাজারের এ গতিধারা বলবৎ থাকবে, লেনদেন চার থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকায় যাবে এবং বড় বড় শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত হবে, ইনডেক্সও অনেক দূর যাবে।
শেয়ার বিজ: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
ছায়েদুর রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ।