ইসমাইল আলীঃ কয়েক বছর ধরে বেড়ে চলেছে চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিং। বর্তমানে দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই হয়। তবে ৩০ বছর আগে নির্ধারিত হারেই এ বন্দরে বিভিন্ন ধরনের মাশুল (চার্জ) আদায় করা হচ্ছে। এতে চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে চার্জ অনেক কম। যদিও সেবার মানে এ বন্দর দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সম্প্রতি প্রকাশিত ‘কম্পিটিটিভনেস অব সাউথ এশিয়া’স কনটেইনার পোর্টস: এ কম্প্রিহেনসিভ অ্যাসেসমেন্ট অব পারফরম্যান্স, ড্রাইভার্স অ্যান্ড কস্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে বন্দর ব্যবস্থাপনা, কনটেইনার হ্যান্ডলিং, সময় অপচয় ছাড়াও হ্যান্ডলিং চার্জের তুলনা তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে কম চার্জ ভারতের চেন্নাই বন্দরে। সেখানে আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে প্রতিটি ২০ ফুট কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে চার্জ নেওয়া হয় ৬৫ ডলার। চট্টগ্রাম বন্দরে এ চার্জ ৮৫ ডলার। আর ভারতের জওহরলাল নেহরু বন্দরে ২০ ফুট কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে চার্জ নেওয়া হয় ৯৫ ডলার। তবে বিশ্বের অন্যান্য বন্দরে এ চার্জ ১০০-৪০০ ডলার বা তারও বেশি।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক শেয়ার বিজকে বলেন, মূলত ৩০ বছর আগে নির্ধারিত মাশুলেই পরিচালিত হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। এটি নির্ধারণের এখতিয়ার নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের। কয়েক বছর আগে এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। বিষয়টি সেখানে বিবেচনাধীন রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, পাকিস্তানের করাচি ও কাশিম বন্দরে ২০ ফুট কনটেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ নেওয়া হয় ১১৫ ডলার। ভারতের মুন্দ্রা বন্দরে এ চার্জ ১১৬ ডলার, শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরে ১৫১, সিঙ্গাপুর বন্দরে ১৬১ ও ওমানের সালালাহ বন্দরে ১৯৪ ডলার। এছাড়া ২০ ফুট কনটেইনার হ্যান্ডলিং দুবাই বন্দর চার্জ নেয় ২১৫ ডলার, নেদারল্যান্ডসের রটারডাম বন্দর ২৬৮ ও যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস বন্দর ৩৯০ ডলার। সবচেয়ে বেশি চার্জ নেওয়া হয় মালদ্বীপের মালে বন্দরে। ২০ ফুট কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে বন্দরটিতে চার্জ নেওয়া হয় ৪১৫ ডলার।
এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন বন্দরের তুলনায় চট্টগ্রামে কনটেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ মোটামুটি গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে রয়েছে। এটি বাড়ানো নিয়ে কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে। তবে চার্জ বাড়ানোর আগে সেবার মানোন্নয়ন জরুরি। কারণ সেবার মানের দিক থেকে চট্টগ্রাম বন্দর প্রতিযোগীদের তুলনায় এখনও অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তা না হলে আমদানি-রফতানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন কনটেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ নির্ধারণ করা হয় বাজার প্রক্রিয়ায় তথা উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে। এ পদ্ধতিতে বিভিন্ন বন্দরের মধ্যে প্রতিযোগিতা, দরপত্রে অংশগ্রহণকারী কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব ও আন্তর্জাতিক বাজারদর যাচাই করে চার্জ নির্ধারণ করা হয়। পাশের দেশ ভারতেও এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। এজন্য ২০০৫ সালে দেশটিতে একটি নীতিমালা করা হয়েছে। তবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের বন্দরে চার্জ সরাসরি নির্ধারণ করে দেয় সরকার।
বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় দেশ দুটির নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় কনটেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ নির্ধারণ করে থাকে। পাকিস্তানে এ চার্জ নির্ধারণ করে বন্দর ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় আর মালদ্বীপে পরিবহন ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। এতে দেশগুলোয় কনটেইনার হ্যান্ডলিং চার্জে বাজারদরের কোনো প্রভাব থাকে না। যেমন কলম্বো বন্দরে দেশটির নিজস্ব আমদানি-রফতানির কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে চার্জ নেওয়া হয় ১৫১ ডলার। তবে ট্রান্সশিপমেন্ট আকর্ষণের জন্য সেক্ষেত্রে মাত্র ৩৭ ডলার চার্জ নেওয়া হয়।
সূত্র জানায়, কোনো জাহাজ এলে সেটির নোঙর থেকে শুরু করে আমদানি পণ্যের কনটেইনার খালাস এবং আবারও জাহাজটিতে রফতানি কনটেইনার লোড করা পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে মোটা দাগে ৫২ ধরনের মাশুল আদায় করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ৩১ ধরনের মাশুল রয়েছে, যা আদায় হয় ১৯৮৬ সালের গেজেট অনুযায়ী। ১৪ ধরনের মাশুল আদায় হয় ১৯৯০ সালের গেজেট অনুযায়ী।
এছাড়া ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারে যোগ হয় গুদামজাতকরণ, কনটেইনার ও নন-সিপিএ যন্ত্রপাতি ব্যবহার মাশুল। এর বাইরে ১৯৮৯, ১৯৯১, ২০০৩ ও ২০০৪ সালে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কিছু সেবার মাশুল বাড়ানো হয়। এ মাশুল অর্থ মন্ত্রণালয় ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় আলোচনা করে গেজেট আকারে প্রকাশ করে।
জানা গেছে, বিশ্বের বেশিরভাগ বন্দর তিন-চার বছর পরপর মাশুল পুনর্মূল্যায়ন করে। এতে বন্দর ব্যবহারের চার্জ বাড়তেও পারে, আবার কমতেও পারে। তবু এটা নিয়মিত পুনর্মূল্যায়ন হয়। আর আঞ্চলিক দৃষ্টিকোণ থেকে মাশুল নির্ধারণ করে বেশিরভাগ বন্দর। অথচ দীর্ঘ সময়েও পুনর্মূল্যায়ন হয়নি চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল। প্রথম ১৯৮৬ সালে বন্দর ব্যবহারের জন্য বিস্তারিত মাশুল কাঠামো নির্ধারণ করা হয়। ১৯৯০ সালে সেগুলোর মধ্যে বেশকিছু সেবার মাশুল পুনর্র্নিধারণ করা হয়।
এ বিষয়ে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমদানির চেয়ে রফতানি পণ্যে কনটেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ কিছুটা কম। যদিও চট্টগ্রাম বন্দরে এটি সমান নেওয়া হয়। তবে নির্ধারিত সময় পরপর বিভিন্ন দেশে মাশুল পুনর্বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশে ৩০ বছরে এটি পুর্নমূল্যায়ন করা হয়নি। তবে শিগগিরই এ-সংক্রান্ত উদ্যোগ নেওয়া হবে।
কনটেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ : বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন চট্টগ্রাম বন্দরে

Add Comment