বিশ্ব কিডনি দিবস: বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট

মাসুদ ইকবাল: কিডনি আমাদের শরীরের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অঙ্গ। বিপাকের মাধ্যমে রক্তে জমে যাওয়া বর্জ্যপদার্থ, যেমন ইউরিয়া ও ক্রিয়েটিনিন প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করা এর প্রধান কাজ। এছাড়া শরীরের পানি ও লবণের সমতা রক্ষা করা, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা, রক্তে অম্ল ও ক্ষারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা এবং প্রয়োজনীয় হরমোন, যেমন ইরিথ্রপয়েটিন, ভিটামিন ডি, রেনিন ইত্যাদি তৈরি করা এর কাজ। সাধারণত কিডনি হঠাৎ করে বিকল হতে পারে, আবার সময় নিয়ে ধীরে ধীরেও হতে পারে। একটি কিডনি যদি ঠিক থাকে বা দুটি কিডনির কিছু না কিছু ঠিক থাকে, তাহলেও কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। সাধারণত কিডনির অর্ধেকের বেশি কার্যক্ষমতা কমে গেলে কিডনি বিকলের কিছু লক্ষণ দেখা যায়। আবার সবার ক্ষেত্রে একই লক্ষণ থাকেও না। লক্ষণগুলোর মধ্যে অতিরিক্ত দুর্বলতাবোধ বা কাজকর্ম না করলেও শরীর দুর্বল লাগা, বারবার প্রস্রাবের বেগ হওয়া, বিশেষ করে রাতে, ত্বকে চুলকানি, বমি ভাব/বমি হওয়া, ক্ষুধামান্দ্য, প্রস্রাব কমে যাওয়া/বন্ধ হয়ে যাওয়া, শরীর ফুলে যাওয়া, শ্বাস নিতে অসুবিধা হওয়া, রক্তচাপ বৃদ্ধি, রক্তশূন্যতা, অনিদ্রা, স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া, খিঁচুনি হওয়া বা জ্ঞান লোপ পাওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে।

অসংক্রামক রোগের মধ্যে কিডনি রোগ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারণা করা হয়, বর্তমানে দেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ কোনো না কোনো কিডনি রোগে ভুগছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, আমাদের দেশে প্রতি বছর ২৫ হাজার রোগীর ডায়রিয়া, বমি, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, প্রসবকালীন জটিলতা, ম্যালেরিয়া ও বিভিন্ন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় হঠাৎ করে কিডনি অকেজো হয়ে যায়। এগুলোর সঠিক চিকিৎসা দিতে পারলে শতকরা ৭০ ভাগ ক্ষেত্রে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা সম্ভব। পানিশূন্যতার জন্য যথাসময়ে স্যালাইন দেয়া, রক্তক্ষরণ হলে অতি দ্রুত রক্ত দেয়া, ইনফেকশন হলে যথাযথ চিকিৎসা নিতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করতে হবে। কারণ এই আকস্মিক কিডনি রোগ শুরুতেই প্রতিরোধ করা না গেলে ভবিষ্যতে তা ক্রনিক কিডনি ডিজিজে রূপান্তরিত হয়ে থাকে।

বর্তমানে আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় ৫০ হাজার রোগী দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, এর মধ্যে ৩০ হাজার রোগীর কিডনি একসময় সম্পূর্ণ বিকল হয়ে যায়, তখন ডায়ালাইসিস কিংবা কিডনি সংযোজন ছাড়া বাঁচার আর কোনো উপায় থাকে না এবং উভয় চিকিৎসা পদ্ধতি বেশ ব্যয়বহুল, ফলে শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ রোগী কিছুদিনের মধ্যে মৃত্যুবরণ করে। দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগের একমাত্র চিকিৎসা হলো কিডনি প্রতিস্থাপন এবং এর জন্য কিডনিদাতার প্রয়োজন হয়। তবে যাদের পরিবারে কিডনিদাতা নেই, তাদের ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির অঙ্গদান একটি সমাধান। কিন্তু মৃত ব্যক্তির অঙ্গদানের সংস্কৃতি আমাদের সমাজে গড়ে ওঠেনি এখনও। এর ফলে কিডনি প্রতিস্থাপনও সহজলভ্য নয়। উপরন্তু ট্রান্সপ্লান্ট-পরবর্তী প্রতি বছর ১-১ দশমিক ৫ লাখ টাকা প্রয়োজন হয়ে থাকে, যা বেশ ব্যয়বহুল। এছাড়া ডায়ালাইসিস চিকিৎসা পদ্ধতিও বেশ ব্যয়বহুল। একজন রোগীর ডায়ালাইসিস করতে প্রতি বছর দু-তিন লাখ টাকার প্রয়োজন হয় এবং শতকরা ৯৫ ভাগ রোগীর এই ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব নয়, ফলে সঠিক চিকিৎসার অভাবে তারা ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়।

বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ৮৫০ মিলিয়ন মানুষ বিভিন্ন ধরনের কিডনি রোগে ভুগছে। সর্বমোট জনসংখ্যার অনুপাতে এর প্রকোপ ১১-১৩ শতাংশ। প্রতি বছর ২ দশমিক ৪ মিলিয়ন মানুষ দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগ এবং ১ দশমিক ৭ মিলিয়ন মানুষ আকস্মিক কিডনি রোগে মৃত্যুবরণ করে। ২০৪০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী অসংক্রামক রোগের মৃত্যুর কারণ হিসেবে কিডনি রোগ পঞ্চম স্থানে উঠে আসবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগের (ক্রনিক কিডনি ডিজিজ) প্রধান কারণগুলোর মধ্যে  অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও নেফ্রাইটিস বা কিডনির প্রদাহজনিত রোগ অন্যতম।

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কিডনি রোগ প্রতিরোধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং একটু সচেতন হলেই শতকরা ৫০ ভাগ ক্ষেত্রে কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা সম্ভব। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, স্থূলতা কমানো, লবণ কম খাওয়া, ধূমপান পরিহার করা, নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম, স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত পানি পান করা, ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত ব্যথানাশক ওষুধ ও অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ না করা, নিয়মিত কিডনির কার্যকারিতা পরীক্ষা করা এবং সর্বোপরি সুস্থ জীবনধারা চর্চার মধ্যমে কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

প্রতিবছর মার্চ মাসের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার বিশ্ব কিডনি দিবস পালন করা হয়। ২০০৬ সালে প্রথম ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব নেফ্রলজি (ওঝঘ) এবং ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব কিডনি ফাউন্ডেশনের (ওঋকউ) উদ্যোগে ৬৬টি দেশে বিশ্ব কিডনি দিবস পালন শুরু করা হয়। কিডনি রোগের ক্রমবর্ধমান বিস্তার ও প্রকোপ হ্রাসকল্পে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টি করাই এর লক্ষ্য। কিডনি রোগ প্রতিরোধে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রতি বছর এই দিবসটি পালিত হচ্ছে।

এ বছরের প্রতিপাদ্য হলো ‘সুস্থ কিডনি সবার জন্য জ্ঞানের সেতুবন্ধে সাফল্য’। শুধু জনগণের সচেতনতা নয়, সেইসঙ্গে ডাক্তার, সেবিকা ও জনস্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে জড়িত স্বাস্থ্যকর্মী এবং বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কিডনি রোগের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা এ দিবসের লক্ষ্য। 

অধ্যাপক ও নেফ্রোলজি বিভাগীয় প্রধান

এনআইকেডিইউ, ঢাকা

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০