মো. জিল্লুর রহমান: স্কটল্যান্ডের রাজধানী গ্লাসগোতে ব্রিটেনের আয়োজনে (সহ-আয়োজক ইতালি) গতকাল শুরু হয়েছে জলবায়ু সম্মেলন ‘কপ-২৬’। এটি চলবে চলতি মাসের ১২ তারিখ পর্যন্ত। এখন বিশ্বের পরিবেশবাদী সবার দৃষ্টি জাতিসংঘের এ বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের দিকে। অবশ্য ‘কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ’কে সংক্ষেপে ‘কপ’ বলা হয় এবং জাতিসংঘের উদ্যোগে গঠিত কপের প্রথম সম্মেলন (কপ১) ১৯৯৫ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এবার হচ্ছে ২৬তম সম্মেলন, এজন্য একে কপ২৬ বলা হয়েছে। ২০১৫ সালের প্যারিস সম্মেলনের পর এটি সবচেয়ে বড় জলবায়ু সম্মেলন। গত বছর হওয়ার কথা থাকলেও করোনা মহামারির কারণে এক বছর পিছিয়ে এ বছর সম্মেলন হচ্ছে। এতে ২০০ দেশের ১২০ জন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানসহ প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন। বলা হচ্ছে, এ সম্মেলনে ৩০ হাজারের বেশি মানুষ অংশ নেবে। এর মধ্যে বিশ্বনেতারা ছাড়াও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী, পরিবেশবাদী কর্মী, সাংবাদিক ও ব্যবসায়ীরাও থাকবেন।
গ্লাসগো সম্মেলনে আলোচনার জন্য এরই মধ্যে জাতিসংঘের একদল বিজ্ঞানী জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার উপায় খুঁজে বের করতে একটি রিপোর্ট তৈরি করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত জাতিসংঘের আন্তঃসরকার কমিটি বা আইপিসিসি নামে কমিটিতে বিজ্ঞানী দলটি কাজ করে। তারা প্রতি ছয়-সাত বছর পরপর জলবায়ু পরিবর্তনের নানা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করে এ ধরনের রিপোর্ট তৈরি করে। এবারের রিপোর্টে বিশ্বে কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনার ওপর সুপারিশ করা হয়েছে। বিশেষ করে কয়লার ব্যবহার বন্ধের ব্যাপারেই জোরালো সুপারিশ করা হয়েছে। গ্লাসগো সম্মেলনের অন্যতম প্রধান একটি চ্যালেঞ্জ ও অঙ্গীকার হলো কয়লার ব্যবহারের অবসান ঘটানো ও এর কৌশল নির্ধারণ।
বিশ্বের কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ সবচেয়ে ক্ষতিকর ও নোংরা জ্বালানি হিসেবে বিবেচিত, যা বিষাক্ত নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার অক্সাইড, পিএম ২.৫, কয়লার ছাই ও এসিড নির্মাণের মাধ্যমে বায়ু ও পানিদূষণে বড় ভূমিকা পালন করে। এছাড়া পারদ, সিসা ও ক্রোমিয়ামের মতো ভারী ধাতু নির্গমন করে, যা দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে শুরু করে অকাল মৃত্যুরও কারণ। এই বিবেচনায় এটি পরিবেশের জন্য বিপর্যয়কর একটি পরিকল্পনাও। সারা পৃথিবীতে মোট যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, তার ৩৮ শতাংশ আসে কয়লা থেকে। এটিই বিদ্যুতের সবচেয়ে বড় উৎস। গত ২০ বছরে কয়লা ও বিদ্যুতের এই মধুর সম্পর্ক বন্ধ করা যায়নি। যদিও গ্যাস ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির মতো অনেক বিকল্প মানুষের সামনে এসেছে, কিন্তু কয়লা ছাড়তে চায় না কোনো দেশ।
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনকারী দেশের তালিকায় সবার ওপরে রয়েছে চীন আর যুক্তরাষ্ট্র। জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় কার্বন গ্যাস নির্গমন কমানোর কোনো উদ্যোগই সফল হবে না, যদি এই দুটো দেশকে কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করা না যায়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র যে পরিমাণ কার্বন নির্গমন করছে, চীন বাতাসে ছড়াচ্ছে তার দ্বিগুণ গ্যাস। তবে ঐতিহাসিকভাবে বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি গ্যাস নির্গমন ঘটিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিদ্যুৎ বা শক্তি তৈরির জন্য যখন জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো হয়, তখন সেখান থেকে বাতাসে মেশে বিভিন্ন কার্বন গ্যাস, যার বেশিরভাগই কার্বন ডাই-অক্সাইড। এসব গ্যাস সূর্যের আলো থেকে তাপ ধরে রাখে। ফলে বাড়তে থাকে পৃথিবীর তাপমাত্রা। এই বাড়তি তাপমাত্রাই বদলে দিচ্ছে জলবায়ু; একদিকে বরফ গলে যাচ্ছে, অন্যদিকে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। চরম উষ্ণ আবহাওয়া ডেকে আনছে নীরব মৃত্যু আর সভ্যতার ধ্বংস।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করা ১০টি দেশের তালিকায় বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে প্রায় আড়াই গুণ বেশি গ্যাস নির্গমন করেছে চীন। এ তালিকায় চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পরেই রয়েছে ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইন্দোনেশিয়া, রাশিয়া, ব্রাজিল, জাপান, ইরান ও সৌদি আরব। বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় থাকা কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গমনে ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যায় চীন। ২০১৯ সালে চীনের নির্গমন দাঁড়ায় এক হাজার ৪১০ কোটি মেট্রিক টন, যা বিশ্বের মোট নির্গমনের চার ভাগের এক ভাগ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নির্গমন ছিল ৫৭০ কোটি টন, যা বিশ্বের মোট নির্গমনের ১১ শতাংশ। এর পরের অবস্থানে থাকা ভারত ছয় দশমিক ছয় শতাংশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্গমন ছিল ছয় দশমিক চার শতাংশ।
কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য অনেক বিনিয়োগ দরকার। যেমন কয়লার ওপর নির্ভরতা কমিয়ে সোলার বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতে অনেক পুঁজি প্রয়োজন। আবহাওয়ার নেতিবাচক আচরণের সঙ্গে খাপ খাওয়াতেও অনেক অর্থ দরকার। উপকূলীয় বাঁধ শক্ত করতে বিনিয়োগ প্রয়োজন। সেইসঙ্গে উন্নয়নশীল দেশের জন্য ক্ষতিপূরণের জন্যও বিপুল অর্থ দরকার। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রধান উৎস শিল্পোন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ক্ষতিকর গ্যাস নিঃসরণ কমানো ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় আর্থিক সহায়তার যেসব অঙ্গীকার করেছিল, সেগুলো পূরণ না হওয়ার কারণেও এই বৈশ্বিক আলোচনায় আস্থার ঘাটতি বিশেষ সমস্যা হয়ে আছে। শিল্পোন্নত দেশগুলো ২০০৯ সালে অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ২০২০ সাল নাগাদ উন্নয়নশীল দেশগুলোয় তাদের বার্ষিক সাহায্যের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি যথাযথভাবে পূরণ হয়নি। উন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক সহযোগিতা-বিষয়ক জোট ওইসিডির হিসাবে সর্বশেষ ২০১৯ সালেও ধনী দেশগুলো দিয়েছে মাত্র আট বিলিয়ন ডলার। আগের বছরগুলোয় এর পরিমাণ ছিল আরও কম। সম্প্রতি জাতিসংঘ হতাশা ব্যক্ত করে বলেছে, এই প্রতিশ্রুতি যথাযথভাবে রক্ষা করা হয়নি। ফলে এই প্রতিশ্রুতির মাত্রা বাড়ানোর জন্য ধনী দেশগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগ করা দরকার।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এমনিতেই বিশ্বব্যাপী অপ্রচলিত হয়ে পড়ছে এবং চীন, জাপান, ভারত ও যুক্তরাজ্য এরই মধ্যে তাদের নিজ দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিষিদ্ধ করেছে। অথচ তারা বিভিন্ন দেশে কয়লা বিদ্যুৎ সম্প্রসারণে প্রচুর বিনিয়োগ করছে, যেখানে নবায়নযোগ্য শক্তি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কম খরচে বিকল্প হিসেবে পরিকল্পিত কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোকে প্রতিস্থাপন করতে পারে। জার্মানি বিশ্বের অন্যতম কয়লা ভোক্তা। সম্প্রতি তারা ঘোষণা করেছে নবায়নযোগ্য শক্তি প্রতিস্থাপন করে ধীরে ধীরে তার ৮৪টি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেবে। অন্যদিকে সম্প্রতি চীনের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছেন, চীন আর দেশের বাইরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বানাবে না এবং এটা ইতিবাচক অগ্রগতি।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিপর্যয় এড়াতে হলে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির গতি কমিয়ে আনতে হবে। সেজন্য কমাতে হবে কার্বন গ্যাস নির্গমন। ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তিতে বিশ্বনেতারাও তাতে একমত হয়েছিলেন। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলনে মিলিত হচ্ছেন বিশ্বনেতারা। ২০৩০ সালের মধ্যে কোন দেশ কার্বন নির্গমন কতটা কমাবে, সেই পরিকল্পনা সেখানে তুলে ধরার কথা। আর যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারতসহ সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গমনকারী দেশগুলো কী পরিকল্পনা দেয়, সেটা থাকবে সবার মনোযোগের কেন্দ্রে।
এবারের জলবায়ু সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যোগ দিচ্ছেন। তবে গ্লাসগোয় যাচ্ছেন না চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। জিনপিং কিংবা পুতিনের অনুপস্থিতি সম্মেলনে বড় কোনো প্রভাব ফেলবে না। সব দেশের রাষ্ট্র কিংবা সরকারপ্রধানেরা সম্মেলনে যোগ দেবেন না, এটাই স্বাভাবিক। তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অবশ্যই এসব দেশের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। কপ২৬ সম্মেলনে চীন কী কী প্রতিশ্রুতি দেয়, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ মুহূর্তে চীনই এক নম্বর কার্বন নিঃসরণকারী দেশ। শুধু নিজের দেশেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন জায়গাতেই তারা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ করেছে। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ উন্নত দেশগুলোর চেয়ে কম। অতীতে যে মাত্রায় নিঃসরণ হয়েছে, সেজন্য এসব দেশের দায় নিতান্তই কম। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণতি তাদেরই বেশি পোহাতে হচ্ছে।
গ্লাসগোর কপ২৬ জলবায়ু সম্মেলন সামনে রেখে জাতিসংঘের ‘ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’-বিষয়ক কমিটি সতর্ক করে বলেছে, এই সম্মেলনের ব্যর্থতা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। ভেঙে পড়তে পারে বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা। দেশগুলো গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন কমাতে সফল না হলে ক্রমবর্ধমান অভিবাসন ও খাদ্যসংকট বিশ্বজুড়ে সংঘাত ও বিশৃঙ্খলার কারণ হতে পারে। কমিটি আরও বলছে, ‘বছরের পর বছর ধরে আমরা স্থিতিশীল রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তুলেছি। বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা ধরে রেখেছি। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুতদের স্রোত এই শৃঙ্খলাকে হুমকিতে ফেলেছে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কার্যকর ও ঐক্যবদ্ধ উপায় খুঁজতে ব্যর্থতা মানে খাবারের প্রাপ্যতা কমে আসা, যা বিশ্বজুড়ে আরও বেশি মানুষকে ঝুঁকিতে ফেলবে। এই পরিস্থিতি আমাদের তৈরি পুরো রাষ্ট্রকাঠামো ধ্বংস করে দিতে পারে।’
বিজ্ঞানীরা জোর দিয়ে বলছেন শিল্পবিপ্লব-পূর্ববর্তী বিশ্বের তাপমাত্রার তুলনায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে পারলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয়কর প্রভাব থেকে বাঁচা যাবে। এছাড়া ইলেকট্রিক কার বা ব্যাটারিচালিত গাড়ির ব্যবহার দ্রুত বাড়ানো, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথ থেকে দ্রুত সরে আসা, গাছ কাটার মাত্রা কমানো ও অধিক বৃক্ষ রোপণ, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আরও মানুষকে রক্ষা করা এবং তার জন্য উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ ও অন্যান্য প্রতিরক্ষা জোরালো করার ওপর জোর দিতে হবে। তবে এগুলো নির্ভর করছে উন্নত দেশগুলোর সঠিক পরিকল্পনা ও কর্মকৌশলের ওপর এবং এটাই এ সম্মেলনের বড় চ্যালেঞ্জ।
ব্যাংক কর্মকর্তা ও ফ্রিল্যান্স লেখক
zrbbbp@gmail.com