মো. আতিকুর রহমান: সারাবিশ্বে ২২ সেপ্টেম্বর গাড়িমুক্ত দিবস পালন করা হয়। গত শতকের সত্তরের দশকে যখন বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকট দেখা দেয়, সে সময় এই দিবসটির ব্যাপকতা লাভ করে। পরবর্তী সময় নব্বইয়ের দশকে এই উদ্যোগের আরও প্রসার ঘটে। বর্তমানে প্রায় চার হাজার শহরে বিশ্ব গাড়িমুক্ত দিবস পালন করা হয়। বাংলাদেশে ২০০৬ সাল থেকে বেসরকারি উদ্যোগে বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস পালন শুরু হয়। এই দিবসে মানুষকে একটা দিন গাড়ি বাদ দিয়ে হাঁটা এবং সাইকেল ও গণপরিবহন ব্যবহারে উৎসাহিত করা হয়। সারাবিশ্বে ব্যক্তিগত গাড়ির ভয়াবহতা অনুভব করে তা নিয়ন্ত্রণে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২২ সেপ্টেম্বর বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস উদ্যাপন অন্যতম।
প্রতিটি শহর গড়ে ওঠার পেছনে একটি দর্শন থাকে, যার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে শহরের মানুষের সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, মানবিকতা, জীবনাচরণ, উন্নয়ন পরিকল্পনা ও শহরটির ভবিষ্যৎ। ঢাকাকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এ দিকটায় খুব বেশি দৃষ্টি দেয়া হয়নি। আর এই প্রতিদিন ত্রুটি নিয়েই বড় হচ্ছে ঢাকা। চীনের দুঃখ যেমন হোয়াংহো নদী, ঢাকার দুঃখ তেমনি যানজট। হোয়াংহো নদীর কারণে যেমন চীনের জনগণের জীবনে অবর্ণনীয় দুঃখ-দুদর্শা নেমে এসেছে, ঠিক তেমনি ঢাকার যানজট নগরবাসীর জীবনে এক অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যানজটের কারণে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে দেশ। এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বিগত দিনগুলোয় বিপুল ব্যয়ে পরিবহন পরিকল্পনা ও নগর পরিকল্পনার নানা উদ্যোগ এবং বিভিন্ন সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ করা হলেও এর কোনো সুফল পায়নি নগরবাসী।
২০১০ সালের পর যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, এর মধ্যে উড়ালসড়কই বেশি। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান উড়ালসড়ক, মগবাজার-মৌচাক উড়ালসড়ক, বনানী ওভারপাস, মিরপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত জিল্লুর রহমান উড়ালসড়ক, বিজয় সরণি উড়ালসড়ক ও কুড়িল উড়ালসড়ক রয়েছে। এসব উড়ালসড়কের সম্মিলিত দৈর্ঘ্য ২৭ কিলোমিটার। ব্যয় হয়েছে সব মিলিয়ে প্রায় চার হাজার ৩০০ কোটি টাকা। হাতিরঝিল প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে দুই হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। শেখের জায়গা-ডেমরা ও গাবতলী-শিরনিরটেক সড়ক এবং যাত্রাবাড়ী কাঁচপুর সেতু আট লেন করার কাজে আরও প্রায় ৩৩০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। দ্রুত গণপরিবহন ব্যবস্থা হিসেবে মেট্রোরেল চালু করা হয়েছে। ঢাকা উড়ালসড়ক বা এক্সপ্রেসওয়েও চালু করা হয়েছে। একের পর এক আটটি উড়াল সেতু বা ফ্লাইওভারও রয়েছে। তারপরও কি ঢাকা মহানগরীর সড়ক গতিশীল?
‘আরবান ট্রান্সপোর্টেশন ইন রিচ অ্যান্ড পুওর কান্ট্রিস’ শীর্ষক গবেষণার প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের ১৫২টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে ধীরগতির শহর ঢাকা। ঢাকার যানজট নিরসনে ১০ বছরের ব্যবধানে (২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল) ৪২ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। অথচ ঢাকার সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (আরএসটিপি) বাস ব্যবস্থার সংস্কারকে অগ্রাধিকার দেয়া হলেও তার আগেই ফ্লাইওভার বা এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এর ফলে ঢাকা আজ স্থবির নগরে পরিণত হয়েছে। বদলে দিয়েছে প্রায় দুই কোটি মানুষের জীবনের ছন্দকে। ১০ লাখ কর্মজীবী মানুষ বছরজুড়ে যে অর্থ (৩৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা) আয় করে, তা খেয়ে ফেলে এই যানজট। আমাদের রাস্তার গাড়ির যে গড় গতিবেগ, তা কমতে কমতে এখন হাঁটার যে গড় গতিবেগ, তারও নিচে নেমে গেছে।
২০১১ সালে হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রির্সাচ সেন্টারের প্রকাশিত পরিসংখানে দেখা যায়, গণপরিবহন ছয় শতাংশ জায়গা দখল করে থাকলেও ২৮ ভাগ যাত্রী পরিবহন করে। ব্যক্তিগত গাড়ি ৩৪ দশমিক ৪১ শতাংশ জায়গা দখল করে থাকে, কিন্তু যাত্রী পরিবহন করে মাত্র ৮ দশমিক ৮৩ ভাগ। এতে সহজে বোঝা যায়, যানজট বাড়ার প্রধান কারণ বাসের মতো গণপরিবহন না বাড়িয়ে ছোট ও ব্যক্তিগত গাড়ির নিবন্ধন বাড়ানো। একটি ব্যক্তিগত গাড়ি প্রতিদিন দু-তিন যাত্রী পরিবহন করে, কিন্তু একটি রিকশা প্রতিদিন (প্রায়) ১০০ যাত্রী পরিবহন করে। ঢাকা শহরে যানজটের কারণে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করার ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করার কথা থাকলেও হচ্ছে তার উল্টো। বেশি যাত্রী পরিবহন করার পরও অনেক রাস্তা দিয়ে পরিবেশবান্ধব যানবাহন (রিকশা) চলাচল নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর ফলে রাস্তার ওপর ব্যক্তিগত গাড়িগুলোর পার্কিংয়ের জন্য জায়গা বেড়ে গেছে, যা ওই এলাকায় যানজটকে আরও জটিল রূপ দিয়েছে। সরকার বর্তমানে গণপরিবহন (বাস) আমদানির জন্য ঋণ সুবিধা দেয় না বললেই চলে। কিন্তু অন্য দিকে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করার জন্য সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো স্বল্প সুদে ব্যাংকঋণ দিচ্ছে। এখানেই শেষ নয়, সরকার ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করার জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের বিনা সুদে ৩০ লাখ টাকা দিচ্ছে এবং মন্ত্রীদের ও সংসদ সদস্যদের জন্য বিনা শুল্কে ব্যক্তিগত গাড়ি আমদানি করার সুবিধা করে দিয়েছে।
বিশ্বের অনেক শহর আজ যানবাহনের এ বিড়ম্বনা থেকে মুক্তির জন্য হা-পিত্যেশ করছে। শহরকে গাড়িমুক্ত করার জন্য গৃহীত হচ্ছে নানারকম পরিকল্পনা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার নতুন আইন করার উদ্যোগ নিয়েছে, যেখানে গাড়ি কেনার আগে ক্রেতাকে পার্কিংয়ের জায়গা কিনতে হবে এবং গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের সময় যথাযথ পার্কিংয়ের জায়গার সার্টিফিকেট দেখাতে হবে। স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে যদি কোনো ব্যক্তি নিজ এলাকা ছাড়া অন্য এলাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করেন তাহলে ১০০ ডলার দেয়ার বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। প্যারিসের সিটি সেন্টারের যারা স্থানীয় বাসিন্দা নন, তাদের জন্য এরই মধ্যে এই এলাকায় ছুটির দিনে গাড়ি নিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নরওয়ের রাজধানী অসলোর রাস্তা থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ গাড়ি নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা করেছে শহর কর্তৃপক্ষ। ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার বৃদ্ধির হার শূন্যতে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে সিঙ্গাপুর।
ঢাকা আমাদেরই শহর, ফলে এই শহর নিয়ে আমাদেরই ভাবতে হবে। আমাদেরই গড়তে হবে। যেমন করে একসময়কার ভবিষ্যৎহীন জাকার্তা, ম্যানিলা ও কলম্বিয়ার বোগোটা শহর এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সরকার ও সাধারণ জনগণ সবাই মিলে একযোগে কাজ করলে আমরাও ঢাকা শহরকে স্বাস্থ্যকর নগর হিসেবে গড়ে তুলতে পারব। ঢাকা শহরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভূমির মিশ্র ব্যবহার হচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে এই মিশ্র এলাকাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার মধ্য দিয়ে শৃঙ্খলা ও বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। ঢাকা শহরে ভূমির এই মিশ্র ব্যবহার স্বল্প দূরত্বে মানুষের প্রয়োজন মেটাতে সাহায্য করছে। বর্তমানে ঢাকায় প্রায় ৮০ শতাংশ যাতায়াত পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে, যার অর্ধেক যাতায়াত আবার দুই কিলোমিটারের মধ্যে হয়ে থাকে। এই স্বল্প দূরত্বের যাতায়াতের জন্য সাইকেলে ও হেঁটে নিরাপদে চলাচলের পরিবেশ তৈরি করা এবং অধিক দূরত্বের জন্য গণপরিবহন নিশ্চিত করা গেলে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। রাজধানীর চারপাশ ঘিরে যে নদী রয়েছে, তা ব্যবহার করা হলে রাস্তার ওপর চাপ কমবে। এই জলপথে হাতিরঝিলের মতো যদি ওয়াটার লঞ্চ সার্ভিস কার্যকর করা যায়, তাহলে নগরবাসীর বড় একটি অংশ এটা ব্যবহার করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারবে। এমনটা থাইল্যান্ডে করা হয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন শহরে সড়কে গাড়ি চলাচল বন্ধ রেখে স্থানীয় এলাকাবাসীর জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়, যেখানে শিশুরা খেলাধুলা, সাইক্লিং, স্কেটিং, আড্ডাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে। ঢাকা শহরে খেলাধুলার জায়গার অভাবে শিশু-কিশোরদের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ এখানে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ ও পার্ক নেই। ফলে শিশুরা টিভিতে কার্টুন অথবা গেমসে আসক্ত হয়ে পড়ছে। বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরা সময় কাটানোর কোনো জায়গা না থাকায় বেশিরভাগ সময় বাসায় বন্দি থাকছেন। এলাকার অভ্যন্তরে কম ব্যস্ত সড়কে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় বন্ধ রেখে বা নিয়ন্ত্রণ করে শিশুদের খেলাধুলা, সাইক্লিং, স্কেটিং এবং নারী ও বয়োজ্যেষ্ঠদের আড্ডা প্রভৃতি ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এ ধরনের উদ্যোগ শুধু ঢাকা শহর নয়, জেলা পর্যায়ের শহরগুলোয়ও গ্রহণ করা প্রয়োজন। কারণ নগরায়ণের প্রভাব জেলা শহরেও পড়েছে।
নগরের তত্ত্বাবধায়কদের অবকাঠামো উন্নয়নে যেমন জোর দেয়া প্রয়োজন, ঠিক তেমনি জোর দেয়া উচিত গণপরিসরের দিকে। ছোট এই শহরে চাইলেই নতুন করে গণপরিসর (পার্ক, খেলার মাঠ ও উদ্যান) তৈরি করা সম্ভব নয়। কাজেই শহরে যেসব জায়গায় গণপরিসরের সম্ভাবনা রয়েছে, সেগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। যদি আমরা সবাই উদ্যোগী হই, দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করি, ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে শহর বিনির্মাণে অংশগ্রহণ করি, তবে আমরাও প্রাণসখা ঢাকা শহরের স্নিগ্ধতা ও মমতা ফিরিয়ে আনতে পারব।