ডা. আব্দুর রাজ্জাক: ১৯৯২ সাল থেকে ‘ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব মেন্টাল হেলথ’-এর উদ্যোগে ১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। সারা বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি এই দিবসটির উদ্দেশ্য। প্রতি বছর এর আলাদা প্রতিপাদ্য থাকে। এ বছর প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য’।
মানুষ কোনো না কোনোভাবে কাজেকর্মে ব্যস্ত। বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের কেউ অফিস-আদালতে বসে কাজ করেন। কৃষক মাঠে, শ্রমিক কলকারখানায়, ছাত্রছাত্রী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এভাবে সবারই কর্মস্থল আছে। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান সময়ই আমরা কর্মস্থলে পার করে দিই। আর এই কর্মস্থলের পারিপার্শ্বিক অবস্থা, পরিবেশ ও সহপাঠীর আচার-আচরণ জীবনের ওপর বিস্তার প্রভাব ফেলে। কথায় আছে, ‘সৎসঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।’ অতএব কর্মপরিবেশ বা পারিপার্শ্বিক অবস্থা যদি সুখের হয় তাহলে জীবন হয় স্বর্গময়। এর বিপরীতে জীবন হয় জাহান্নামের সমান। ফলে মানুষ হয়ে পড়ে মানসিক রোগী।
বাংলাদেশে ২০ থেকে ২৯ বছর বয়সী নারী পোশাক শ্রমিকদের ওপর পরিচলিত একটি জরিপে দেখা যায়, তাদের ৪৩ শতাংশ কর্মক্ষেত্রজনিত মানসিক চাপে ভুগছেন। অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো কর্মক্ষেত্রেও নারী-পুরুষ বৈষম্য এখনও বাংলাদেশে পরিলক্ষিত হচ্ছে। গর্ভধারণ ও স্ত্রীরোগ কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের বাড়তি মানসিক সমস্যার কারণ। বাংলাদেশে বাসাবাড়ি, গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এখনও শিশু শ্রমিক নিয়োগ লক্ষ করা যায়। ফলে কর্মক্ষেত্রে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনে ঘটনাও প্রায়ই দৃশ্যমান। কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নারীরা কর্মক্ষেত্রে মাঝে মাঝে মানসিক চাপে পড়ে থাকেন। ফলে তাদের মাঝে তৈরি হয় ভয়, আতঙ্ক ও কাজের প্রতি অনাগ্রহ।
সমস্যাটি শুধু বাংলাদেশের নয়, বহির্বিশ্বেরও। ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল রিপোর্ট ২০১৭ অনুযায়ী, উন্নত বিশ্বের সব কর্মক্ষেত্রে গড়ে প্রায় ১০ শতাংশ কর্মী কেবল বিষন্নতায় জন্য যথাযথ দায়িত্ব পালনে সমস্যার সম্মুখীন হন। বিষন্নতায় আক্রান্ত ৫০ শতাংশ কর্মী চিকিৎসাসেবা নেন না। প্রতিদিনের একটি বড় সময় মানুষ কর্মক্ষেত্রে কাটান। ফলে কর্মক্ষেত্র মনের ওপর নানা প্রভাব ফেলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিষন্নতার কারণে ২০০৩ সালে ৮৪ বিলিয়ন ডলার আর্থিক ক্ষতি হয়, যার মধ্যে ৫২.৫ বিলিয়ন ক্ষতি হয় বিষন্নতাজনিত অনুপস্থিতি আর যথাযথ দক্ষতার অভাবে (গ্রিনবার্গ ২০০৩)। যুক্তরাজ্যেও এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২৫ শতাংশ কর্মী কর্মক্ষেত্রকে মানসিক চাপ সৃষ্টির প্রধান কারণ হিসেবে মনে করেন। ২০১৩ সালে ৩১টি ইউরোপীয় রাষ্ট্রের ওপর পরিচালিত এক জরিপে ৫০ শতাংশের বেশি কর্মী কাজের ধরন ও কর্মক্ষেত্রকে মানসিক চাপের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবেচিহ্নিত করেন।
লক্ষণ
ঘন ঘন অফিসে অনুপস্থিতি, বিলম্বে অফিসে আসা, কম কাজ করা, একই কাজ নিয়ে দীর্ঘ সময় বসে থাকা, নির্দিষ্ট সময়ের আগে অফিস ত্যাগ, সহকর্মীদের সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক,
যখন-তখন রাগারাগি, পারস্পরিক সন্দেহ, যখন-তখন মিথ্যা বলা, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের সমস্যা প্রভৃতি।
মানসিক স্বাস্থ্যবান্ধব কর্মক্ষেত্রকরণীয়
- গুণগত মানসম্মত কর্মী নিয়োগ।
- কর্মক্ষেত্রে শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দেওয়া।
- কর্মক্ষেত্র আনন্দময় রাখা।
- কাজের পাশাপাশি বিনোদনমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা। যেমন পিকনিক, চা-চক্র, স্পোর্টস ও নাটক আয়োজন করা।
- কর্মীদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যতথ্যগুলো বিনা সম্মতিতে প্রকাশ না করা।
- সহকর্মী, ঊর্ধ্বতন বা অধস্তন কর্মীদের সঙ্গে কথা ও আচরণে সংযম প্রদর্শন।
- সহকর্মীদের সাফল্যকে উদযাপন করা ও প্রশংসা করা। ব্যর্থতাকে বারবার তুলে না ধরা ও ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ না করা।
- কাজের পাশাপাশি পরিবারকে সময় দেওয়ার সুয়োগ বাড়ানো।
- সহকর্মীদের মধ্যে বিষন্নতা, উদ্বিগ্নতা বা আচরণজনিত সমস্যার ক্ষেত্রে আলাদা কথা বলা ও প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা।
- টিম ওয়ার্কের মাধ্যমে কাজ করা।
- কর্মক্ষেত্রের জটিলতা সম্মিলিতভাবে সমাধানের চেষ্টা করা।
প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর মাঝে মানসিক রোগের হার
১৬.১% (২০০৩-২০০৫ জাতীয় জরিপ)
৩২% (২০১৬ কমিউনিটি জরিপ)
শিশু-কিশোরদের মাঝে মানসিক রোগের হার
১৮.৪% (২০০৯, কমিউনিটি জরিপ)
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ = ২৫০ জন
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট = ৫৭ জন
মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা
মানসিক হাসপাতাল, পাবনা
মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, মেডিক্যাল কলেজসমূহ
মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালসমূহ
সরকার অনুমোদিত বেসরকারি হাসপাতাল
ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে সেবা প্রদানের স্থান।