বিশ্ব রাজনীতির মারপ্যাঁচে করোনা ভ্যাকসিন

মুশফিকুর রহমান ইমন: বিশ্বব্যাপী বয়ে চলছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। গত বছরের নভেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম কেস পাওয়ার পর কেউ হয়তো কল্পনাও করতে পারেনি এই ভাইরাস পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে জনজীবন বিপর্যস্ত করে ফেলবে। খুব দ্রুতই অর্থনীতি, রাজনীতি কিংবা পুরো সমাজব্যবস্থাকে স্থবির করে দিয়ে এক অজানা আতঙ্কের ছায়া নেমে আসবে পুরো বিশ্বেÑএ রকম দুর্যোগের কথা এ বছরের শুরুতেও ভাবা দুঃসাধ্য ছিল। কিন্তু সময়ের আবর্তে অকল্পনীয় সব ঘটনাই বাস্তবে পরিণত হয়েছে। তাবৎ দুনিয়ায় মানুষ আজ উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর রুদ্ধশ্বাসে সময় অতিবাহিত করছে। ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, ব্রিটেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা সামলাতে ব্যস্ত। আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যুহার কমাতে অনেক দেশেই নেয়া হচ্ছে লকডাউনের প্রস্তুতি। বিজ্ঞানী ও গবেষকদের আশঙ্কা শীতে এই ভাইরাস আবারও প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। পুরো বিশ্বের নজর এখন তাই করোনার ভ্যাকসিনের দিকে। ভ্যাকসিন নিয়ে তাই সাধারণ মানুষের জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। কবে আসবে করোনার ভ্যাকসিন এ জিজ্ঞাসা সবার।

খুব দ্রুত করোনার ভ্যাকসিন বাজারে আনার জন্য তাই উন্নত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে প্রথম থেকেই একধরনের প্রতিযোগিতা চলে আসছিল। একটি কার্যকর ভ্যাকসিন বাজারে নিয়ে আসতে সাধারণত পাঁচ থেকে ১০ বছরের দীর্ঘ গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন। কিন্তু করোনা মহামারি ঠেকাতে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জন্য গবেষণা ও উৎপাদনের নিয়মকানুনের শর্ত কিছুটা শিথিল করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এরই মধ্যে কভিড-১৯ ভ্যাকসিন আবিষ্কারের সুখবরের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বে সবার মধ্যে আশার আলো জ্বলতে শুরু করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, শিগগির বাজারে আসতে পারে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন। কিন্তু ভ্যাকসিনের বিষয়টি শুধু এর আবিষ্কারের প্রশ্নেই সীমাবদ্ধ নয়। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতি, জাতীয় রাজনীতি, সমাজনীতিসহ রাষ্ট্রীয় যোগাযোগÑসবকিছুই জড়িত। এটি শুধু করোনা টিকার জন্যই সত্য নয়। করোনাভাইরাসের আগেও বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে ইবোলা, সার্স ও মার্স নামের জীবনবিনাশী সংক্রামক ব্যাধির দাপট। বিগত শতকেই হাজারো মানুষের প্রাণনাশের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল স্প্যানিশ ফ্লু। তারও আগে গুটিবসন্ত ভয়াবহ মহামারির সৃষ্টি করেছিল। জাতিসংঘের নেতৃত্বে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও কার্যকর উদ্যোগের ফলেই এই ব্যাধি নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে।

বিশ্ব যখনই কোনো সংক্রামক ব্যাধি দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে, ঠিক তখনই মানবহিতৈষী কর্মোদ্যোগের পাশাপাশি হেঁটে চলেছে আত্মকেন্দ্রিকতা, উগ্র জাতীয়তাবাদ কিংবা পুঁজিবাদের কলুষিত রূপ। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, আগে যত টিকা আবিষ্কার ও প্রয়োগের বিষয় সামনে এসেছে, সবসময় এই রাজনীতি ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের ভেতর দিয়েই সেগুলোকে যেতে হয়েছে। এখন করোনা ভ্যাকসিন সামনে রেখেও বিভিন্ন উন্নত রাষ্ট্রের মধ্যে এই বিষয়গুলো দেখা যাচ্ছে। লকডাউনের সূচনাকালে মার্চের শুরুর দিকে মাস্ক, গ্লাভস ও স্যানিটাইজারের মতো ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) বাজার থেকে হঠাৎ করেই উধাও হতে শুরু করে। উন্নত রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজস্ব  হাসপাতালের কর্মীদের ব্যবহারের জন্য রেস্পিরেটর, মাস্ক ও গ্লাভস মজুত রেখেছিল।

ঠিক একই রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে। কারণ করোনার ভ্যাকসিন উৎপাদনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কোটি কোটি ডলারের বাণিজ্য আর বিশ্ব রাজনীতি। এছাড়া কয়েক দশক ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানরা দেশীয় রাজনীতিতে সর্বোচ্চ সমর্থন ধরে রাখতে আন্তর্জাতিকতাবাদের বদলে কঠোর জাতীয়তাবাদের প্রতি অধিক আনুগত্য প্রকাশ করছেন। এটি বিশ্বকে বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

একটি কার্যকর ও নিরাপদ টিকা আবিষ্কার করার জন্য প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ সম্পদের বিনিয়োগ ও পর্যাপ্ত অর্থ। উন্নয়নশীল ও দারিদ্র্যপীড়িত দেশগুলোর মোট জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশই যেখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে, সেখানে এসব দেশের পক্ষে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পেছনে এই বিপুল পরিমাণ সম্পদ বিনিয়োগ করা সম্ভব হয় না। ধনী দেশগুলোর সদিচ্ছা ও অনুগ্রহের ওপরই নির্ভরশীল এসব দেশের ভবিষ্যৎ ভ্যাকসিনেশন প্রক্রিয়া। এরই মধ্যে অনেক উন্নত দেশ, যেমন ব্রিটেন ও রাশিয়ায় ব্যাপক মাত্রায় ভ্যাকসিনেশন চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আশা করছে, আগামী বছরের শেষ নাগাদ মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর টিকা পাওয়ার একটা প্রবল সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। ফলে উন্নত ও শক্তিশালী দেশগুলোর পাশাপাশি উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোয়ও ভ্যাকসিন পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

কিন্তু এত অগ্রগতির পেছনেও রয়েছে কলুষিত রাজনৈতিক মনোভাব। সেটি হচ্ছে ‘টিকা জাতীয়তাবাদ’, যাতে কিছু দেশ নিজের টিকা নিয়ে একা থাকতে চায়। উপেক্ষা করতে চায় পুরো বিশ্বকে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, দ্রুত ও কার্যকর পন্থায় মহামারি মোকাবিলায় জাতীয়তাবাদের লাগাম টেনে ধরা ছাড়া উপায় নেই। এ ধরনের কঠোর জাতীয়তাবাদকে পুঁজি করে কোনো মহামারি মোকাবিলা করা অতীতেও সম্ভব হয়নি, বর্তমানেও সম্ভব হবে না। এ ধরনের জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি কোনো সমস্যার সমাধান তো করেই না, উল্টো সমস্যা মোকাবিলার পথে বাধা সৃষ্টি করে আরও বহুমাত্রায় দীর্ঘায়িত করে।

বিশ্ব রাজনীতি থেকে এই ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদের ঝুঁকি কখনোই সমূলে দূর করা সম্ভব নয়। তবে আশার কথা, বিজ্ঞানীরা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতামূলক কিছু অলাভজনক সংগঠন এরই মধ্যে এগিয়ে এসেছে। উল্লেখযোগ্য একটি উদ্যোগ হচ্ছে কোভ্যাক্স (ঈড়ারফ-১৯ ঠধপপরহব ষেড়নধষ অপপবংংক্সঈঙঠঅঢ)। সংস্থাটি এই ভ্যাকসিনে যেন বিশ্বের সব দেশের সমানভাবে ন্যায্য ও ন্যায়সংগত অধিকার রক্ষা হয়, সেটি নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যত বেশি দেশ কোভ্যাক্সে যোগ দেবে, তত বেশি যৌক্তিক বিতরণ, বিপণন ও ব্যবস্থাপনা সহজসাধ্য হবে, যা মহামারি মোকাবিলায় ‘টিকা জাতীয়তাবাদ’ রুখতে বহুলাংশে সহায়ক হবে। সংকটের এই মুহূর্তে বিশ্বকে সতর্ক থাকতে হবে ‘টিকা জাতীয়তাবাদের’ উত্থান সম্পর্কে। কারণ বিজ্ঞান কোনো ব্যক্তি কিংবা দেশের কল্যাণে কাজ করে না, সব দেশের সব মানুষের জন্যই বিজ্ঞান। করোনা ভ্যাকসিন যে দেশই আবিষ্কার করুক না কেন, তা বৈশ্বিক আবিষ্কার হিসেবেই পরিগণিত হবে। রাজনীতির ফায়দা লুটার জন্য যদি করোনা ভ্যাকসিনকে নির্দিষ্ট স্থানের মানুষের জন্য সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়, কিংবা পুঁজিবাদের নির্মমতার গ্যাঁড়াকলে পড়ে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে রাখা হয়, তাহলে তা হবে চরম অমানবিক ঘটনা। ভূ-রাজনীতিতে বিরোধ থাকতেই পারে, কিন্তু জনস্বাস্থ্যের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ের ক্ষেত্রে সেই শত্রুতা টেনে আনা মোটেও সমীচীন নয়। তাই মানবতার কথা চিন্তা করে হলেও সবার জন্য উš§ুক্ত করে দেয়া উচিত করোনা ভ্যাকসিনের পেটেন্ট। উগ্র জাতীয়তাবাদী কিংবা পুঁজিবাদীদের হাতে বন্দি না হয়ে ভ্যাকসিন হোক সব দেশের, সব মানুষের জন্য উম্মুক্ত।

শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০