বিশ্ব শরণার্থী দিবস ও নিরাপত্তা অধিকার

মো. জাহাঙ্গীর আলম: আধুনিক এই বিশ্বে সবচেয়ে করুণ বিষয় হলো একটি বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠী এখনও নিজ ঘরবাড়ি ও দেশ থেকে পালিয়ে শরণার্থী জীবনযাপন করছে। শরণার্থী ইস্যুটি বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে পুরোনো ও চলমান সমস্যার একটি। দিন দিন শরণার্থীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। শরণার্থীরা অস্থায়ী ক্যাম্পে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। তাদের নির্দিষ্ট দেশ নেই, নিরাপত্তাহীনতা, অবহেলা আর বঞ্চনায় কাটে জীবন। শরণার্থীদের মৌলিক, মানবিক ও নিরাপত্তা অধিকার নেই বললেই চলে। বিশ্বের অনেক স্থানেই আজ শরণার্থীদের মৌলিক ও মানবিক অধিকার, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা হুমকির মুখে। তাই আন্তর্জাতিক মহলে শরণার্থীদের অধিকার বাস্তবায়নে বহুবিধ আলোচনা হচ্ছে। তবে তাদের অধিকারের পাওয়ার বিষয়টি এখনও পরিপূর্ণতা পায়নি ।

আমরা সাধারণত নির্যাতন, সংঘাত, যুদ্ধ বা সহিংসতা থেকে বাঁচতে নিজ ঘরবাড়ি ও দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হওয়া মানুষকে শরণার্থী বা উদ্বাস্তু বলি। জাতিসংঘের মতে, কোনো ব্যক্তির বর্ণ, ধর্ম, জাতীয়তা, নির্দিষ্ট কোনো সামাজিক গোষ্ঠীর সদস্যপদ থাকা অথবা রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকার কারণে যদি তার ওপর নির্যাতনের সমূহ সম্ভাবনা থাকে, তবে নিজ ঘরবাড়ি ও দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া সেসব জনগোষ্ঠী শরণার্থী হিসেবে গণ্য হবে। সে হিসেবে সারাবিশ্বে প্রতি মিনিটে ২০ জনের বেশি ব্যক্তি যুদ্ধ, সংঘাত, সহিংসতা ও নিপীড়নের শিকার হয়ে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হচ্ছে।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত নিপীড়ন, সংঘাত, সহিংসতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে বাঁচতে সারা বিশ্বের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতদের সংখ্যা ১০ কোটি (১০০ মিলিয়ন) অতিক্রম করেছে। এই নতুন রেকর্ড ইউক্রেন যুদ্ধসহ অন্যান্য সংঘাতের কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা এত বেড়েছে বলে মনে করছে ইউএনএইচসিআর। বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ২০২১ সালের শেষ নাগাদ নয় কোটির মতো ছিল। ইথিওপিয়া, বুরকিনা ফাসো, মিয়ানমার, নাইজেরিয়া, আফগানিস্তান এবং কঙ্গোতে সংঘাতের কারণে মূলত সংখ্যাটি বাড়ছিল। তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধের হামলা থেকে বাঁচতে দেশটি থেকে ইতোমধ্যে ৬০ লাখের মতো মানুষ জীবন বাঁচাতে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। আর ৪০ লাখ ইউক্রেনের ভেতরেই এক অঞ্চল ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। ১০ কোটির বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার অর্থ হচ্ছে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশের বেশি মানুষ আর নিজের ঘরে থাকতে পারছেন না। এই সংখ্যার মধ্যে শরণার্থী, আশ্রয়প্রার্থী এবং নিজের দেশেই ঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হওয়া পাঁচ কোটির মতো মানুষও রয়েছে।

ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের শেষে সারাবিশ্বে ৮৯ দশমিক ৩ মিলিয়ন মানুষ বলপূর্বক নিজ ভিটামাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এর মধ্যে ২৭ দশমিক ১ মিলিয়ন উদ্বাস্তু বা শরণার্থী, ৫৩ দশমিক ২ মিলিয়ন অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষ, ৪ দশমিক ৬ মিলিয়ন আশ্রয়প্রার্থী এবং ৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন ভেনেজুয়েলান বিদেশে বাস্তুচ্যুত। বিশ্বের অর্ধেকের বেশি শরণার্থী এসেছে দক্ষিণ সুদান, আফগানিস্তান এবং সিরিয়া থেকে। দেশগুলোতে যুদ্ধবিগ্রহসহ নানা সমস্যার কারণে এসব মানুষ বর্তমানে শরণার্থী। এ শরণার্থীদের আশ্রয়দান করেছে তুরস্ক, পাকিস্তান, লেবানন, ইরান, উগান্ডা এবং ইথিওপিয়া। বাংলাদেশও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয়দানকারী একটি দেশ। সম্পূর্ণ মানবিক কারণে মিয়ানমারের প্রায় ১১ লাখ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশ সাময়িকভাবে আশ্রয় দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে প্রথম আশ্রয় নিয়েছিল ১৯৭৮ সালে।

শরণার্থীদের অধিকার সুরক্ষায় বড় মাধ্যম হলো ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশন এবং ১৯৬৭ সালের প্রটোকলের সঠিক ব্যবহার। এছাড়া ১৯৪৮ সালের মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র (The Universal Declaration of Human Right)এর বাস্তবায়ন। বর্তমানে বিশ্বের ২৭.১ মিলিয়ন উদ্বাস্তু বা শরণার্থীদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ একান্ত জরুরি। ইউএনএইচসিআর শরণার্থী অধিকার বাস্তবায়নের নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শরণার্থীদের নিরাপত্তা অধিকার ফিরে পাওয়ার মাধ্যম হচ্ছে নিরাপদ আবাসস্থল, জাতি পরিচয় এবং পাশাপাশি মৌলিক ও মানবাধিকার অধিকার ফিরে পাওয়া।

জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী, ২০০১ সাল থেকে প্রতি বছর বিশ্ব শরণার্থী দিবসটি পালিত হয় এক একটি প্রতিপাদ্য ধরে। এই বছর, শরণার্থীদের নিরাপত্তা অধিকার চাওয়ার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। বিশ্ব শরণার্থী দিবস ২০২২ এর মূল প্রতিপাদ্য: Whoever. Wherever. Whenever. Everyone has the right to seek safety. বা যে কেউ, যেখানেই থাকুক, যখনই থাকুক তাদের নিরাপত্তা চাওয়ার অধিকার রয়েছে। বিশ্বের প্রতিটি মানুষেরই নিরাপত্তা চাওয়ার অধিকার রয়েছে। তারা যেই হোক না কেন, যেখান থেকেই আসুক না কেন, যখনই আসুক না কেন, যারা পালাতে বাধ্য হয়েছে বা যাদের পালাতে বাধ্য করা হয়েছে তাদের সাথে মর্যাদার সঙ্গে আচরণ করা উচিত। যে কেউ সুরক্ষা চাইতে পারে, তারা কে বা তারা যা বিশ্বাস করুক না কেন, সেটি বিবেচনা না করে তাদের নিরাপত্তা চাওয়ার বিষয়টি যেটি একটি মানবাধিকার তার ওপর গুরুত্ব দেয়া উচিত।

ইউএনএইচসিআর মতে, শরণার্থীরা যেখান থেকেই আসুক না কেন, পালাতে বাধ্য হওয়া মানুষদের আমাদের স্বাগত জানানো উচিত। শরণার্থীরা সারাবিশ্ব থেকে আসে। জীবন বাঁচাতে তারা বিমান, লঞ্চ বা নৌকা অথবা হেঁটে এক দেশ থেকে অন্য দেশে আশ্রয় নিতে পারে, তবে যা সর্বজনীন তা হলো তাদের নিরাপত্তা চাওয়ার অধিকার। যখনই মানুষ পালাতে বাধ্য হয়, তাদের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। হুমকি যা-ই হোক না কেন যুদ্ধ, সহিংসতা, নিপীড়ন থেকে প্রত্যেকেই সুরক্ষা পাওয়ার যোগ্য। প্রত্যেকেরই নিরাপদ থাকার অধিকার রয়েছে। নিরাপত্তা চাওয়া বলতে ইউএনএইচসিআর এখানে পাঁচটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছে: আশ্রয় চাওয়ার অধিকার; নিরাপদ প্রবেশাধিকার; দেশে ফিরতে বাধ্য না করা; কোনো বৈষম্য না করা; এবং মানবিক আচরণ। অন্যান্য বিষয়গুলোর মধ্যে পরিবারগুলোকে একত্রিত রাখা, পাচারকারীদের হাত থেকে তাদের রক্ষা করা এবং নির্বিচারে আটক এড়ানো।

প্রতিটি মানুষের মৌলিক ও মানবিক এবং নিরাপত্তা অধিকার পাওয়ার বা চাওয়ার অধিকার রয়েছে। মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, আর এক দিন তারাও ফিরে পাবে তাদের সেই স্বাভাবিক স্বাধীন জীবন এটাই আমাদের কামনা। বিশ্বের শরণার্থীদের মৌলিক ও মানবাধিকার অধিকার ফিরিয়ে দিতে রাষ্ট্রগুলো আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে এইটাই এ বিশ্ব শরণার্থী দিবসের প্রত্যাশা আমাদের। আমরা প্রতিজ্ঞা করব বিশ্বের সব শরণার্থীদের নিরাপত্তা অধিকার পায়। আমরা আরও মানবিক হবো, আর ভাবব তারাও আমাদের পরিবারের কেউ। খোলা আকাশে নিচে বসবাস করা ১০ কোটি শরণার্থীদের মৌলিক-মানবিক ও নিরাপত্তা অধিকার রক্ষা এবং সুস্বাস্থ্য স্বাভাবিক জীবনযাপনের প্রত্যাশা করি আজকের এই দিনে।

পিআইডি ফিচার

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০