শরিফুল ইসলাম পলাশ: ‘কাশ্মীর’ বললে আমাদের চোখের সামনে প্রাকৃতিক নিসর্গের আড়ালে চাপা পড়ে থাকা স্বাধিকার আদায়ের লড়াইয়ের গল্প ভেসে ওঠে। কেউ এ ভূস্বর্গের বন্দনায় ব্যস্ত, কেউবা আন্দোলনকারীদের জন্য চিন্তামগ্ন। কিন্তু কাঁটাতার, বুট-বুলেট ছাড়া কাশ্মীরের অনেক কিছুই এখনও অজানা-অদেখা।
কাশ্মীরের ইতিহাস, অর্থনীতি ও রাজনীতি বিষয়ক খুঁটিনাটি পাঠককে জানাতেই গবেষণাধর্মী গ্রন্থ লিখেছেন জাকারিয়া পলাশ। দক্ষিণ এশিয়া ফাউন্ডেশনের (সাফ) স্কলার হিসেবে কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়ালেখা করেছেন তিনি। সেখানে অবস্থানকালে খুব কাছ থেকে দেখা ঘটনাগুলো সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন এ বইয়ে। এর আগে জম্মু-কাশ্মীরের নানা বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন। লেখনীতে কাশ্মীরের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও সমাজবোধ নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরা হয়েছে। এবার অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বইটি প্রকাশ করেছে সূচীপত্র প্রকাশনী।
লেখকের বয়ানে চিরচেনা গল্পের সঙ্গে কাশ্মীরের রাজনৈতিক অর্থনীতিও উঠে এসেছে। গণিতের শিক্ষার্থী হিসেবে লেখক যেমন পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন, তেমনি ইতিহাস বিশ্লেষকদের মতো শেকড়ের সন্ধানও করেছেন। সেখানে স্থান পেয়েছে কাশ্মীরের ‘কনজিউমার ইকোনমি’। স্থান পেয়েছে এক সময়ের স্বাবলম্বী অর্থনীতিকে নিস্তেজ করে ফেলার ইতিহাস। কাশ্মীরিদের দুধের বদলে ক্ষীর খাওয়ানোর গল্পের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী কাশ্মীর শাল, আপেল আর আখরোটও সমান গুরুত্ব পেয়েছে এখানে।
বইটিতে মোট ২২টি অধ্যায় রয়েছে। এখানে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ভূ-রাজনীতির আদ্যোপান্ত সবিস্তারে তুলে ধরেছেন লেখক। এ অঞ্চলের প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বর্তমান সময়ের সার-সংক্ষেপ, মানুষের জীবনযাত্রা, ভাষা, সংস্কৃতির কথাও বলা হয়েছে। গল্পের ছলে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধাবস্থার সমূল অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন তরুণ এ সাংবাদিক। নানা উদাহরণ ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে কাশ্মীরের সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সম্পর্ক আছে কি না এবং বর্তমান সময়ে বাংলাদেশকে কীভাবে তারা মূল্যায়ন করে, সে বিষয়ও ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
লেখক ‘কাশ্মীরিদের চোখে বাংলাদেশ’ অধ্যায়ে লিখেছেন, ‘কাশ্মীরের অধিকাংশ তরুণ ক্রিকেটে পাকিস্তানের পরে বাংলাদেশকে সমর্থন করে।’ অনেকে বাংলাদেশ-কাশ্মীরের তুলনা করে বলে, ‘তোমরা লড়েছ পাকিস্তানি ফৌজের বিরুদ্ধে ভারতের সাহায্যে। আমরা লড়ছি ভারতীয় ফৌজের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সাহায্যে। শত্রু-মিত্র বদলে গেছে। স্বাধীনতার মর্ম আমাদের একই।’
লেখক লিখেছেন, “সব মিলিয়ে বাংলাদেশের জন্য কাশ্মীর মূলত একটা দ্বিধা। স্পষ্টতই, বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানের অংশ ছিল, তখন কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তানের জাতীয় অবস্থানই ছিল বাংলাদেশের জাতীয় অবস্থান। কিন্তু স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ এক নতুন জাতিসত্তা। কাশ্মীর প্রশ্নে আমাদের অবস্থানও তাই নতুনত্বের দাবি করে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের পবিত্র স্বাধীনতা কাশ্মীরিদের জন্য ছিল একটা শক্। কারণ যে পাকিস্তান কাশ্মীরের ‘স্বাধীনতার ত্রাতা’, তা ভেঙে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গিয়েছিল ১৯৭১ সালে।”
আজাদির স্বপ্নের বিপরীতে বুট-বুলেটের নিশানা, দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, একটি অঞ্চলের ইতিহাস আর চলমান সময়ের জটিল অংক-পরিসংখ্যানও যে সাবলীল বর্ণনায় প্রাণ পেয়ে সুখপাঠ্য হয়ে উঠতে পারে সেটাই প্রমাণ করেছেন লেখক। সে কারণেই অনবদ্য ও কালের খোরাক হয়ে উঠেছে এটি।
‘বইটির অধিকাংশ তথ্য এথনোগ্রাফিক। বড় দাগে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য এটি প্রামাণ্য হবে। আরও ভেঙে বা সহজভাবে বললে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ইতিহাস, শান্তি ও সংঘর্ষ, জেন্ডার স্টাডিজ, মিডিয়া স্টাডিজ কিংবা নৃ-বিজ্ঞানের গবেষকরা এ বইটি থেকে উপকৃত হবেন’ লেখকের এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করা যায়।
জাকারিয়া পলাশ ১৯৮৯ সালে বাগেরহাটের শরণখোলায় জš§গ্রহণ করেন। সাফ স্কলারশিপ নিয়ে কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগের ছাত্র ছিলেন।