বুড়ি তিস্তা রিজার্ভার খনন: কৃষককে সর্বস্বান্ত করার আয়োজন

এম নাজমুল হুদা ও জাহিদুল ইসলাম: নীলফামারীর বুড়ি তিস্তা নদী বয়ে গেছে ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার ওপর দিয়ে। একসময়কার প্রমত্তা এই বুড়ি তিস্তা এখন মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। সেই সঙ্গে দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছে এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় বসবাসকারী কৃষকদের জন্য। যে জমি তাদের জন্য ছিল আশীর্বাদ, এখন সে জমি রক্ষার জন্য মুখোমুখি হতে হয়েছে ৯টি পৃথক পৃথক মামলার।

কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ভাষ্যমতে, কৃষির উন্নয়নের জন্য উত্তর জনপদের দরিদ্র অসহায় কৃষকদের ভাগ্য উন্নয়নের নিমিত্তে রয়েছে বুড়ি তিস্তা সেচ প্রকল্প বা রিজার্ভার। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, এটিতে লাভই হবে কৃষকদের। এই মানবদরদি প্রকল্পে এলাকার গরিব ও অসহায় মানুষের কষ্ট দূর হবে। তবে সত্যিই কি এসবের কিছু ঘটবে? এই রিজার্ভার কি সত্যিই কৃষকদের ভাগ্য বদলের জন্য করা হচ্ছে, নাকি কৃষকদের সর্বস্বান্ত করে কতিপয় রাঘব বোয়ালের টাকার কুমির বনে যাওয়ার এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র।

শুরুর কথা: বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে খাদ্যচাহিদা পূরণের নিশ্চয়তায় তিস্তা বাঁধ ও সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের হঠকারী সিদ্ধান্তে ১৯৬৭-৬৮ সালে ডিমলা ও জলঢাকা মহকুমার কৃষকদের কাছ থেকে হুকুম দখলে (মৌখিক সম্মতি) ১০৪ দশমিক ২৫ একর জমি অধিগ্রহণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।

বুড়ি তিস্তায় পানি মজুত রাখার জন্য তারা ১৪টি জল কপাটবিশিষ্ট একটি ব্যারাজ নির্মাণ করে আর মজুতকৃত পানি খরিফ মৌসুমে কৃষিজমিতে সেচ কাজে ব্যবহারের জন্য বাঁধের দুই প্রান্তে দুটি ক্যানেল খনন করা হয়। এ সময় উপরিউল্লিখিত সাত থেকে ১০টি মৌজার কৃষিজমিতে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে বলে জনসাধারণকে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেচ প্রকল্পটি শুরু থেকে এ এলাকার কৃষকদের কোনো প্রকার সেচ সুবিধা দিতে পারেনি।

মূলত পানি সরবরাহ কার্যক্রম শুরু করা হলে ১৯৭২ সালে অধিগ্রহণকৃত ১০৪ দশমিক ২৫ একর জমির বাইরে আরও বিস্তৃত এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে অনেক ফসলি জমি ও বাড়িঘর পানিগর্ভে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। ফলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যকর সুবিধার পরিবর্তে উল্টো বেশি ভোগান্তির সৃষ্টি হয়। এত প্রকল্প শুরুর দিকে ফসল নষ্ট বাবদ পাউবো আংশিকভাবে খেসারতের টাকা পরিশোধ করলেও অবশিষ্ট টাকা অদ্যাবধি পরিশোধ করা হয়নি। ফলে নদীসংলগ্ন এক হাজার ৯২ একর জমির মালিকরা তাদের আবাদি জমির ফসল হারিয়ে এবং জমির ফসলের উপযুক্ত খেসারতের টাকা না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে থাকেন।

তৎকালীন দখলদার পাকিস্তান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্বেচ্ছাচারিতার ফলে নির্মিত বুড়ি তিস্তা বাঁধ সেচ প্রকল্পটি জনস্বার্থে তথা ফসল উৎপাদনে চরমভাবে ব্যর্থ হয়।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, অপরিকল্পিতভাবে এই প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়েছিল। এই প্রকল্পের ফলে নদী ও তৎসংশ্লিষ্ট এলাকার ক্ষতি হয়েছে। সরকারি বরাদ্দের টাকা জলেই গেছে। বুড়ি তিস্তা ভারতে উৎপত্তি হয়ে বাংলাদেশে প্রায় ২৪ কিলোমিটারজুড়ে প্রবাহিত হয়েছে। এ নদী গভীর ও স্রোতস্বিনী ছিল গত এক যুগ আগেও। বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নে নদীটির অপরিসীম ভূমিকা ছিল। ধীরে ধীরে নদীটি সরু হতে থাকে এবং গভীরতা কমে যায়।

ঘটনার সূত্রপাত: পরবর্তীকালে দেশ স্বাধীন হওয়ার দীর্ঘসময় পরে ২০১০ সালের ১৭ মে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ এলাকাবাসীর ৪৯২ দশমিক ৭১ হেক্টর পরিমাণ পৈতৃক ও ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তি মেসার্স তুষুকা রিসোর্স লিমিটেডকে সম্পূর্ণভাবে ইজারা দেয়। ব্যক্তিগত স্বার্থে পাউবো থেকে ইজারা নিয়ে তুষুকা নামক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করলে এলাকাবাসী চরমভাবে হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। নিরুপায় হয়ে তারা উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হলে মহামান্য হাইকোর্টের আদেশে তাদের (মেসার্স তুষুকা রিসোর্স লিমিটেড) কথিত কার্যক্রম ১০ বছরের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়।

ফলে এলাকাবাসী তাদের নিজ নিজ কৃষিজমিতে ফসল উৎপাদন করে নিজেদের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি জাতীয় খাদ্যঘাটতি পূরণে সহায়তা করে আসছে। মূলত স্বাধীনতার আগে পানির স্তর যখন চাষাবাদি জমির সাত-আট ফুট নিচে বিরাজমান ছিল, তখনই তাদের এই বাস্তবতা-বিবর্জিত পরিকল্পনা সম্পূর্ণভাবে ভেস্তে যায়। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো, তারা এলাকাবাসীর পৈতৃক ও ব্যক্তিমালিকানাধীন তিন ফসলি জমি খননের জন্য প্রশ্নবিদ্ধ পরিকল্পনা আবার গ্রহণ করেছে।

বর্তমানে উল্লিখিত প্রকল্প এলাকায় বুড়ি তিস্তা নদী ও তৎসংলগ্ন এক হাজার ২১৭ একর জমির মধ্যে ১৬০ একর জমিতে বসতভিটা, একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, চারটি মসজিদ, একটি মুক্তিযোদ্ধার ফ্ল্যাট, একটি মাদ্রাসা ও দুটি ঈদগাহ মাঠ রয়েছে এবং ৯৫৭ একর তিন ফসলি কৃষি আবাদি জমি, যা মৌজা দুটির সাতটি গ্রামে তিন হাজার পরিবারের আনুমানিক ১২ হাজার দুস্থ ও অসহায় মানুষের জীবিকা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন।

বর্তমান সমস্যা: গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর বিভিন্ন সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানা যায়, প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬৪টি জেলার অভ্যন্তরীণ ছোট-বড় নদী, খাল ও জলাশয় পূর্ণ খনন প্রকল্পের আওতায় এক লাখ চার হাজার কৃষিজমির ৯ ফুট গভীরতার কাজ (ক্যাট) প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার খনন কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই আলোকে ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িতিস্তা নদীর প্রায় কে হাজার ২০০ একর জমি খননের কাজ পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় টেন্ডারের মাধ্যমে পায় স্ট্যান্ডার্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ৫০০ একর জমি খনন করা হবে ওই জায়গায়।

প্রকল্পের অধীনে এক হাজার ২০০ একর জমির মধ্যে ৫০০ একর জমি ক্যাট প্রকল্পের আওতায় বুড়ি তিস্তা নদী খননের ক্ষেত্রে, যার দৈর্ঘ্য ৪.৫০ কি.মি. ও প্রস্থ ২.৫০ কি.মি. এবং ব্যারাজ নির্মাণ খনন ছয় হেক্টরের মধ্যে এক লাখ চার হাজার কৃষিজমি ৯ ফুট গভীরতায় প্রায় ৯০ কোটি টাকা বরাদ্দে কাজ করা হবে। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রায় এক হাজার ২০০ একর কৃষিজমি; আবার তারাই বলছেন, নদী খনন করা হবে। তাদের নিজেদের বক্তব্যই পরস্পরবিরোধী। আর নদী খনন করলে তো বিরোধের প্রশ্নই ওঠে না।

এখানে বুড়ি তিস্তা নদী খনন অবশ্যই ভালো কাজ। কিন্তু তাহলে শুধু এক হাজার ২১৭ একর ৬১ শতাংশ জমির মধ্যেই কেন? এ নদী খনন করতে হলে এর পূর্বে অবস্থিত সিংগাহারা নদী খনন করতে হবে। কারণ সিংগাহারা নদীর নাব্য না ফিরলে এই নদী খননে কোনো উপকার হবে ন আবার ওই ব্যক্তিরাই বলছেন, এক হাজার ২১৭ একর ৬১ শতাংশ জমির খাজনা তারা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নামে পরিশোধ করেছেন। তাহলে কি কারও জমির খাজনা পরিশোধ করলেই পানি উন্নয়ন বোর্ড সেই জমি নিয়ে নিতে পারে, নাকি এর পেছনে কেউ কলকাঠি নাড়ছেÑএ প্রশ্ন উঠছে। হাজার হাজার কৃষককে তাদের নিজ আবাদি কৃষিজমি থেকে বিতাড়িত করে কৃষির কোন ধরনের উন্নয়ন করা হবে, তা সাধারণ মানুষের বোধগম্য নয়।

গ্রামবাংলায় প্রচলিত প্রবচনÑ‘গরিবের বউ সবার ভাবি।’ কুটির ডাঙ্গা ও এর আশেপাশের মানুষের অবস্থা হয়েছে সেই গরিবের ভাবির মতো। সবাই সুযোগ নিতে চায়। কারণ এখানকার লোকজন একেবারেই সহজ-সরল ও অসহায়। এই গ্রাম স্বাধীনতার আগে থেকে অদ্যাবধি অবহেলিত। মাত্র দু-তিন বছর হলো এই গ্রাম বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। এসব দিনমজুর খেটে খাওয়া মানুষ যখন নিজের অধিকার আদায়ের জন্য, নিজের শেষ সম্বল জমি রক্ষার জন্য কথা বলেছে, তখনই কুচক্রী মহলের প্রভাবে পাউবো নিরীহ গ্রামবাসীর নামে নীলফামারী কোর্টে, জলঢাকা ও ডিমলা থানায় ৯টি পৃথক পৃথক মামলা দিয়ে সাত শতাধিক মানুষকে হয়রানি করছে।

আবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের অকার্যকর বাস্তবতাবিবর্জিত, কল্পনাপ্রসূত, হঠকারিতামূলক ও অবৈজ্ঞানিক সেচ প্রকল্প চালুর নামে গ্রামবাসীর আবাদি কৃষিজমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলে হাজার হাজার গরিব, দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষ না খেয়ে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হবে। সেচ প্রকল্পটি চালু ও খনন করা হলে এ এলাকার তো বটেই, সেইসঙ্গে দেশের খাদ্যচাহিদা পূরণে অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হবে। প্রকল্প এলাকার আবাদি জমির বার্ষিক ফলন উৎপাদনের তালিকাটি দেখে নিলেই এ বিষয়ে একটি স্বচ্ছ, ধারণা পাওয়া যাবে।
নি¤েœ বর্তমান বার্ষিক ফসল উৎপাদনের তালিকা লিপিবদ্ধ করা হলো: ৯৫৭ একর আমন ধানের আবাদি জমিতে বছরে প্রায় এক হাজার ৭৪০ টন ধান ফলে, যার আনুমানিক বাজারমূল্য পাঁচ কোটি ১৬ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। ৩০০ একর আবাদি জমিতে বছরে প্রায় ৭৭০ টন ধান ফলে, যার আনুমানিক বাজারমূল্য দুই কোটি সাত লাখ ৯০ হাজার টাকা।

৬০০ একর জমিতে বছরে আলু উৎপন্ন হয় প্রায় পাঁচ হাজার ৫০০ টন, যার আনুমানিক বাজারমূল্য ১৭ কোটি ৮২ লাখ টাকা। ৬০০ একর জমিতে ভুট্টা উৎপন্ন হয় বছরে প্রায় দুই হাজার ৩০০ টনেরও অধিক, যার বাজারমূল্য প্রায় ৭৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য রবিশস্য, যেমন মরিচ, টমেটো, বরবটি, শিম ও বিভিন্ন শাকসবজি আবাদ হয় প্রায় ৫৭ একরেরও অধিক জায়গা জুড়ে, যার বাজারমূল্য কমপক্ষে দুই কোটি টাকারও ওপরে। সব মিলিয়ে দুই হাজার ৫১৪ একর আবাদি জমির বার্ষিক ফলন প্রায় ১০ হাজার ৩১০ টনেরও অধিক। এসব ফসল ও রবিশস্য মিলিয়ে বার্ষিক আনুমানিক ১০১ কোটি ৫৮ লাখ ৬৮ হাজার টাকার বেশি পরিমাণ খাদ্য উৎপন্ন হয়ে থাকে। তাই বলা যেতেই পারে, এই এলাকার কৃষি জাতীয় রাজস্বে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে।

প্রকৃতপক্ষে এ মৌজার গ্রামবাসীও একান্তভাবে নদী খননের পক্ষে। তবে তাদের একটাই যৌক্তিক দাবিÑবিশেষজ্ঞ টিম দ্বারা মাঠ পর্যায়ে তদন্ত সাপেক্ষে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নদীর উৎপত্তিস্থল (বাংলাদেশ অংশ) থেকে মূল নদী ও তিস্তা ব্যারাজসহ তার ভাটি পর্যন্ত খনন করা হোক, যাতে করে নদীর নাব্য ফিরে আসে এবং নদী তার আপন গতিতে স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হতে পারে। এতে গ্রামবাসীর কোনো প্রকার আপত্তি নেই; বরং খননকালে ওই কাজে এ এলাকার লোকজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে সহযোগিতা করবে, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০