স্মৃতি চক্রবর্তী: মানবজীবনে বৃক্ষ নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য, সরকারের এ ব্যাপারে ব্যাপক ইতিবাচক মনোভাব থাকা সত্ত্বেও কিছু দুষ্ট ও লোভাতুর মানুষের কারণে এ অনুষঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা জানি, বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু বৃক্ষের প্রাণের অস্তিত্ব সন্ধান করেছিলেন। প্রকৃতির বড় সম্পদ কিংবা অলঙ্কার বৃক্ষ মানুষের সখা। বৃক্ষ মানুষের বাঁচার উপাদান জোগায়, বৃক্ষ মানুষকে নিরাপত্তা বেষ্টনীর ছায়ায় রাখে। তাই মানুষের জীবন প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন নয়, বরং নিবিড়ভাবে সংলগ্ন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কতটা বৃক্ষপ্রেমিক ছিলেন, এর অনেক দৃষ্টান্ত আমরা খুঁজে পাই তার বিভিন্ন রচনায়। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, প্রকৃতির কবি বলে খ্যাত জীবনানন্দ দাশ একই সঙ্গে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনেক রচনায়ও আমরা তা দেখতে পাই। মানুষের সঙ্গে বৃক্ষের যে নিবিড় সম্পর্ক এবং তাদের রচনায় নানাভাবে উঠে এসেছে; মূলত বৃক্ষের ভূমিকা মানবজীবনে অসীম, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মুজিববর্ষ উপলক্ষে জাতীয় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তার বৃক্ষ সৃজন, রোপণ, প্রতিপালন, পরিচর্যা ও সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির পরিসর বিস্তৃতকরণে বিশেষ কর্মসূচি ইতোমধ্যে নানা ইতিবাচক দিক দৃশ্যমান করে তুলেছে। সারাদেশে সরকারের পক্ষ থেকে বৃক্ষের চারা বিতরণ ও রোপণ আমাদের সবুজের পরিসর বিস্তৃতকরণ করেছে, যদিও আমাদের ভূখণ্ডের অনুপাতে যেটুকু বনভূমির প্রয়োজন, রয়েছে তার তুলনায় অনেক কম। বৃক্ষনিধন ও পাচারকারী চক্র এবং সমাজের কিছু মানুষের নির্বিচারে বৃক্ষনিধনের যে অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের খবর প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে, তা আমাদের জন্য স্বস্তির বিষয় নয় মোটেই। তবে আশার কথা হলো, এ সরকারের ব্যাপক কার্যক্রম, অনুপ্রেরণা-সহযোগিতা ইত্যাদি নানামুখী কর্মকাণ্ডে বৃক্ষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা তুলনামূলকভাবে বেড়েছে এবং সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বৃক্ষের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারছে। নিঃসন্দেহে এমনটি স্বস্তির বিষয়, আশার কথা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে বহুবার বলেছেন, যারা যেখানে অবস্থান করছেন, যার যতটুকু জায়গা রয়েছে, সেখানেই বৃক্ষরোপণ করুন। যারা শহরে-নগরে কিংবা মহানগরে বাস করেন, তারা ব্যালকনি বা ছাদে বৃক্ষরোপণ করুন। প্রধানমন্ত্রীর এ আহ্বান সমাজের বৃহদাংশের মানুষকে ব্যাপকভাবে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। নগর-মহানগর-শহরে ঊর্ধ্বপানে তাকালে অনেক ক্ষেত্রেই এই দৃশ্য মন কেড়ে নেয়।
নানারকম দূষণে আমরা আক্রান্ত। এর মধ্যে অন্যতম হলো বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণ রোধ করতে হলে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। একই সঙ্গে উপকূলীয় এলাকাগুলোতেও ভাটি বাংলায় এ সবুজ বেষ্টনীর গুরুত্ব সর্বাধিক। স্মরণ করা যেতে পারে, স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে বৃক্ষরোপণ করে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি উদ্বোধন করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৪ সাল থেকে প্রতি বছর পহেলা আষাঢ় থেকে সাংগঠনিক ও সামাজিক পর্যায়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালিত হয়ে আসছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃক্ষরোপণের ক্ষেত্রে বস্তুত ফলদ, বনজ ও ভেষজ এই তিন ধরনের বৃক্ষরোপণের যে তাগিদ দিয়ে আসছেন, তাতে সঙ্গতই ভাবা যায়, তা শুধু আর্থিকভাবেই দেশের জন্য ফলপ্রসূ হবে না, সারাদেশে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও তা অত্যন্ত সহায়ক। এমনকি প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও বৃক্ষরোপণ ও এর পরিচর্যার ওপর ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট নম্বর নির্ধারণ করে দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই প্রকল্প নিঃসন্দেহে প্রজন্মকে বৃক্ষ-সখা হিসেবে গড়ে তোলার একটি দূরদর্শী পরিকল্পনা। এতে করে বৃক্ষের প্রতি ভালোবাসা তৈরি, যোগাযোগ স্থাপন, নিজের চিন্তা করা ও তা বাস্তবায়নের সুযোগ তৈরি করে সমস্যা নিরূপণ ও সমাধান এবং সর্বোপরি সৃজনশীল দক্ষতা অর্জন করার সুযোগ পাবে শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে জলবায়ুজনিত কারণে সৃষ্ট পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর বৈরী ছায়া দূর করতে ও বৈশ্বিক উষ্ণতায় পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এ প্রকল্প। বৃক্ষের কাছে ঋণের শেষ নেই আমাদের। মানবজীবনে বৃক্ষের দান অসীম।
নির্বিচারে বৃক্ষনিধন বন্ধে এবং সমাজের লোভাতুর চক্রের কাঠ ব্যবসার অন্তরালে মহামূল্যবান সম্পদ বৃক্ষ পাচার বন্ধ করতে কঠোর অবস্থানের কোনো বিকল্প নেই। যদি বৃক্ষনিধন বন্ধ না করা যায়, তাহলে সামাজিক বনায়নের পরিসর বিস্তৃতকরণের উদ্যোগের ফল কাক্সিক্ষত মাত্রায় মিলবে না এবং আমাদের জাতীয় স্বার্থে উদ্দেশ্য সাধনের চলমান প্রচেষ্টায় আশানুরূপ ফলও মিলবে না।
‘সবুজে বাঁচি, সবুজ বাঁচায়, নগর-প্রাণ-প্রকৃতি সাজাই’ এই সেøাগান আমাদের জাতীয় জীবনের জন্য তো বটেই, প্রতিবেশ-পরিবেশের জন্যও অত্যন্ত শক্তিসঞ্চারক। নানা কারণে শহর-নগর-মহানগরে জনচাপ ক্রমেই বাড়ছে। নদীভাঙন, বন্যার প্রকোপ, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদির পাশাপাশি শিক্ষা, কর্মসংস্থান, ব্যবসা-বাণিজ্য এ রকম আয়ও অনেক কিছুর সুযোগ-সুবিধা ও উন্নত জীবনযাপনের প্রত্যাশায় মানুষ গ্রামবিমুখ হচ্ছে। এই জনস্রোত ঠেকাতে হবে এবং গ্রামকেই উন্নয়নের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে নির্ধারণ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য পরিবেশ-প্রতিবেশ সমুন্নত রেখে বসবাসের ব্যবস্থা নিরাপদ করতে হবে। সরকারের বিশেষ পরিকল্পনা গ্রাম হবে শহর, এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে যে লক্ষ্যে কাজ চলছে, তাও আশার সঞ্চার ঘটায়।
তবে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়নের নামে বৃক্ষনিধন ও বনভূমি ধ্বংস করে যে সর্বনাশ ডেকে আনছেন অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের হোতারা, তাদের প্রতি রাষ্ট্রশক্তির কোনোরকম অনুকম্পা দেখানো চলবে না। অসময়ের অতিবৃষ্টি, খরা, বন্যা, বজ পাত, বায়ুদূষণ-পানিদূষণের মতো সৃষ্ট জটিল সমস্যা সমাধানেও বৃক্ষের কোনো বিকল্প নেই। এই ধরণীতে নিঃস্বার্থ প্রকৃত ও উপকারী বন্ধু বৃক্ষের ছায়াতলেই গড়ে উঠেছিল মানবসভ্যতা। তাই বৃক্ষ ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না।
কার্তিক প্রামাণিক, আফতাব চৌধুরীর মতো অনেকেই নিজ উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ করে শুধু জাতীয় পুরস্কারই লাভ করেননি, সৃষ্টি করেছেন অনন্য দৃষ্টান্ত। তাদের কর্মকাণ্ড প্রজš§কে অনুপ্রাণিত করতে ভূমিকা রাখছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, দূষণমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশে রয়েছে বনায়নের বিপুল সম্ভাবনা। এ সম্ভাবনা সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগাতে হবে। পরিকল্পিত একটি বাগান কিংবা বনায়নই হতে পারে সরকার এবং জাতির আয়ের অন্যতম উৎস এ বিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজšে§র জন্য বাসযোগ্য দেশ গড়তে বৃক্ষরোপণকে রূপ দিতে হবে সামাজিক আন্দোলনে। মাত্র কয়েক দশক আগেও বরেন্দ্র অঞ্চলের পরিচিতি ছিল দেশের মরুভূমি হিসেবে, কিন্তু ওই এলাকার রুক্ষ লাল মাটিতেও এখন ফসল উৎপাদন হয়। সোনালি ফসলের হাসিতে সব রুক্ষতা মুছে গেছে এ অঞ্চলে। বৃক্ষের ছায়া হয়েছে বিস্তৃত। সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের কারণে ওই মরুভূমি অঞ্চল এখন পরিণত হয়েছে সবুজের সমারোহে। এ দৃষ্টান্তগুলো আমাদের সামনে অনুপ্রেরণা দেয়, আশা জাগায়। বৃক্ষের প্রতি ভালোবাসা, আমাদের সবার সচেতনতা এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে কেবল নির্মল পরিবেশের এক সবুজ পৃথিবী গড়তে। আমাদের ভালোবাসার সে হাত বাড়িয়ে দেয়ার কোনো বিকল্প নেই এ ক্ষেত্রে।
পিআইডি নিবন্ধ