বেলেন ফার্নান্দেজ: এমন একটি রাষ্ট্রে বয়োজ্যেষ্ঠ আমেরিকানদের টিকে থাকার জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়, তাদের মৃত্যু পর্যন্ত যে রাষ্ট্রের মুনাফার ধারা বজায় থাকে।
এ বছরের আগস্টে ৭২ বছর বয়সে মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে আমার বাবা একটা কবিতা আবৃত্তির চেষ্টা করেন। তার একটু আগেও বাবা কথা বলতে পারছিলেন না। হঠাৎ কোথা থেকে যেন শক্তি পেলেন, আর আবৃত্তি করলেন উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসের ১৯২৭ সালের কবিতা ‘সেইলিং টু বাইজেন্টিয়াম’। কবিতার প্রথম লাইনÑ‘সে দেশে বৃদ্ধদের জন্য কোনো ঠাঁই নেই।’
বাবার এ তাৎক্ষণিক পারফরম্যান্স দেখার জন্য উপস্থিত ছিলাম আমি, আমার মা আর আমার চাচা। মঞ্চ ছিল ওয়াশিংটন ডিসিতে বাবার বিছানা। এখানেই তাকে কেমোথেরাপির পর হোম হসপিস কেয়ার দেয়া হতো। মুনাফাখোর ডাক্তাররা কেমোথেরাপি দিতে বাধ্য করেছিলেন। এতে আরও জলদি চলে গেলেন বাবা।
এরকম আরও অনেক কবিতা আমার বাবা মুখস্থ করেছিলেন তার যৌবনে, তার বুদ্ধিবৃত্তিক সনদকে সম্মান করার উদ্দেশ্যে। আমার মা ও চাচাও তার তার আবৃত্তির প্রভাবে পড়েছিলেন। বাবার মৃত্যুশয্যায় তারাও আবৃত্তিতে যোগ দিলেন। তার তেজোদীপ্ত আবৃত্তি শেষ করার পর বাবা আবারও নিস্তেজ ও নীরব অবস্থায় চলে গেলেন। এরপর মৃত্যুর আগে যতক্ষণ ছিলেন বারবার কেবল মৃত্যুকামনাই উচ্চারণ করেছেন।
সেই অন্তিম কাব্যিক বিস্ফোরণের সময় বাবার মনে কী চলছিল, তা আমি কখনোই জানতে পারব না। কিন্তু ইয়েটসের কবিতার প্রথম লাইনটি ‘যে দেশে আমরা বাস করছি, যে দেশে জš§গ্রহণ করেছি এবং যে দেশকে আমার বাবা-মা ও আমি বছরের পর বছর ধরে এড়িয়ে চলেছি,’ সে দেশের সঙ্গে একেবারেই মিলে যায়। আমার বাবা-মা প্রায় আট বছর বার্সেলোনায় থাকার পর সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন। আমি তুরস্ক থেকে আগস্টে ওয়াশিংটনে এসেছি। গত ২০ বছরের স্বঘোষিত নির্বাসনে ওয়াশিংটন ছিল আমার অন্যতম নিয়মিত যাত্রাবিরতির স্থান।
প্রকৃতপক্ষে, বাবার জীবনের অন্তিম কয়েক মাসে নিশ্চিত হয়েছি, আমেরিকায় ‘বৃদ্ধদের জন্য কোনো ঠাঁই নেই।’ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ও শ্মশান পরিষেবার জাঁকজমকপূর্ণ জগতের শিকারে পরিণত হয়েছেন তিনি। তারও আগে চিকিৎসার নামে অনর্থক কেমোথেরাপি শুষে নিয়েছে তার যা কিছু সঞ্চয়।
উদাহরণস্বরূপ, প্রোস্টেট ক্যানসারের ওষুধ এক্সটানডির এক মাসের প্রেসক্রিপশনের জন্য বাবার কাছ থেকে ১৪ হাজার ৫৭৯ ডলার চার্জ করা হয়েছে। মার্কিন নাগরিকদের ট্যাক্সের টাকায়ই তো এ ওষুধ উদ্ভাবন করা হয়েছে। আর এখন এর দাম রাখা হচ্ছে কয়েকজন মার্কিন নাগরিকের উপার্জনের চেয়েও বেশি। স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য মৌলিক চাহিদা মেটানোর উপায় নেই, সে মানুষদের জন্যও মার্কিন পুঁজিবাদ মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।
মার্কিন সমাজ ব্যাপক মানুষের ওপর নিপীড়নে বিশেষভাবে পটু। অবশ্যই এলিট সম্প্রদায় এ নিপীড়নের শিকার হয় না। তারা বরং তীব্র বৈষম্যের ফায়দা ভোগ করে। বিশেষ করে বয়স্কদের প্রতি মার্কিন সমাজ বেশি নিষ্ঠুর। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শ্রমভিত্তিক শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট হওয়ার পর বয়স্করা নিঃশেষিত বস্তুতে পরিণত হন। তারপরও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের ছিবড়ে মুনাফা বের করতে চায় এই সমাজ।
২০২২ সালে প্রকাশিত ওয়েস্ট হেলথ-গ্যালাপের একটি সমীক্ষার ফলাফল অনুসারে, ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী চার আমেরিকানের মধ্যে একজন এবং ৫০ থেকে ৬৪ বছর বয়সী ১০ জনের মধ্যে তিনজন আমেরিকান বলছেন, খাদ্যের মতো মৌলিক চাহিদায়ও তাদের আপস করতে হয়েছে শুধু স্বাস্থ্যসেবার খরচ মেটাতে।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, বয়স্ক নারী ও কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের ওপর আরও বেশি অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রভাব পড়েছে। এছাড়া এ বিদ্বেষপূর্ণ চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধ আমেরিকানদের জন্য তৈরি করেছে নিত্যদিনের মানসিক চাপ। আবার এ মানসিক চাপ তাদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা আরও বাড়িয়ে তোলে।
এ চক্রের সঙ্গে আরও আছে রক্তচোষা বিমা কোম্পানি। এবার সব মিলিয়ে দৃশ্যটি পুরোই নৃশংস। তাদের অনেকগুলো প্রোগ্রামে নিষেধাজ্ঞামূলক ফি আরোপ করা হয়। আবার প্রায়ই তারা জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসার কাভারেজ প্রত্যাখ্যান করেন। এতে মনে হয়, বেঁচে থাকাটা যেন বিশেষ দাক্ষিণ্য, অধিকার নয়।
এ ছাড়া আছে ৩৪ বিলিয়ন ডলারের ‘কেয়ার গিভিং’ ব্যবসা। সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্টের একটি তদন্তে প্রকাশ করা হয়েছে, একজন আমেরিকানের কাছ থেকে গড়ে ছয় হাজার ডলার চার্জ করা সত্তে¡ও এ খাত অযৌক্তিক অবহেলায় জর্জরিত। ২০১৮ সাল থেকে পত্রিকাটি দুই হাজারের বেশি বয়স্ক নাগরিকের কথা লিখেছে, যারা এ সার্ভিসের সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল। তাদের মধ্যে প্রায় ১০০ প্রবীণ কোনো পরিষেবা না পেয়েই মারা গেছেন। এ কেমন ‘কেয়ার গিভিং’?
নিশ্চিতভাবে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে একজন নাগরিককে বৃদ্ধ বয়সে যে একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতা ভোগ করতে হয়, তাতে গড় আয়ু কমবে ছাড়া বাড়বে না। আমেরিকান সাইকোলজিকাল অ্যাসোসিয়েশন উল্লেখ করেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রাতিষ্ঠানিক বয়সবাদ ‘মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা এবং সামগ্রিকভাবে সমাজের জন্য নেতিবাচক প্রভাবের’ একটি অন্যতম কারণ।
এটা ঠিক যে, একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতা এই তথাকথিত ‘মুক্তপ্রাণদের দেশ’ আমেরিকার বাসিন্দাদের জন্য আজীবনের যন্ত্রণা। এখানে সাম্প্রদায়িক ও পারিবারিক বন্ধনকে বিসর্জন দিয়ে ও হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে শুধু ব্যক্তিগত সাফল্যকে গুরুত্ব দেয়া শেখায়। এখানে মানুষ পরিণত হয় ভোগবাদী রোবটে।
যুক্তরাষ্ট্রের এ গলাকাটা ব্যবসায়িক চরিত্রের কারণে শেষমেশ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি, নার্সিং হোম ও মার্কিন স্বাস্থ্যসেবা নামের করপোরেট র্যাকেটগুলো বৃদ্ধদের ভঙ্গুর শরীর নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে পারে।
আবার এও বলতে হবে, কোনো কোনো বৃদ্ধ লোকের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আসলে চমৎকার দেশ। সাবেক যুদ্ধবাজ ক‚টনীতিক হেনরি কিসিঞ্জারের কথাই ধরা যাক, যিনি তার জীবনের একটি বড় অংশ ধরে বিশ্বব্যাপী অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটিয়ে গত নভেম্বরে কানেকটিকাটের বাড়িতে ১০০ বছরের দীর্ঘ জীবনের ইতি টানলেন।
আগস্টে বাবার মৃত্যুর কিছুকাল পরেই আমি পঞ্চাশের দশকের এক বলিভিয়ান ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলি। তিনি দুই দশকের বেশি সময় ধরে ওয়াশিংটনে বাস করছেন। তিনিও ‘বৃদ্ধদের জন্য দেশ নেই’ থিমেই কথা বললেন। তিনি তার নিজ শহর কোচাম্বাতে ফিরে আসার আগে আরও ১০ থেকে ১৫ দিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু তিনি বললেন, যুক্তরাষ্ট্রে বুড়ো হওয়ার সামর্থ্য নেই তার।
আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘বৃদ্ধদের জন্য ঠাঁই’ তো নেই-ই, এমনকি এটি কাউকেই আর একটি দেশ হিসেবে সুরক্ষা দিচ্ছে না।
লেখক ও কলামিস্ট
আল জাজিরা থেকে ভাষান্তর
শামসুন নাহার