বৃদ্ধাশ্রম নয়, পরিবারই হোক প্রবীণদের শেষ ঠিকানা

কণিকা রানী : মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে একাকী বাস করতে পারে না। এভাবেই গড়ে উঠে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র। মা-বাবা, ভাই-বোন, দাদা-দাদি, কাকা-কাকি সবাই মিলেই পরিবার। প্রতিটা মানুষ কোনো না কোনো পরিবারের অংশ।

পরিবার আমাদের জীবনে একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। পরিবার আমাদের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা সব কিছুর আধার। পৃথিবীতে পরিবারের লোকজনদের চেয়ে কেউ আপন হয় না। আমাদের সুসময়-দুঃসময়, সব সময় পরিবার আমাদের পাশে থাকে। বিশেষ করে মা-বাবা আমাদের সুখের জন্য অনেক কিছু উৎসর্গ করে। মা-বাবার মতো করে কেউ আমাদের বোঝে না। কিন্তু সেই মা-বাবা যখন বৃদ্ধ হয়ে যান তখন আমাদের তাদের দেখাশোনা করার মতো সময় বা মানসিকতা কোনোটাই থাকে না। শেষ বয়সে এসে এখনও অনেক মা-বাবা আশ্রয়হীন, কেউ কেউ রাস্তায়, কেউ বা ভিক্ষা করে, কেউ বিদ্ধাশ্রমে দিনাতিপাত করছে।

বৃদ্ধাশ্রম বলতে বোঝায় বৃদ্ধ নারী-পুরুষদের আবাসস্থলকে। আবাসস্থল বা বৃদ্ধাশ্রমের উৎপত্তি হয়েছিল মূলত গরিব -দুস্থ, সহায়-সম্বলহীন, সন্তানহারা প্রবীণদের শেষে জীবনে বিশেষ সেবা করার জন্য। কিন্তু আধুনিক সমাজে বৃদ্ধাশ্রম বলতে একদম ভিন্ন কিছু দৃষ্টিগোচর হয়। বর্তমানে বৃদ্ধাশ্রম বলতে বোঝায় বৃদ্ধ পিতামাতার জন্য পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের থেকে আলাদা আবাসস্থলকে। যে উদ্দেশ্যে বৃদ্ধাশ্রমের যাত্রা শুরু হয়েছিল আজকাল তার উল্টো দিকটা দেখা যায়। আমরা যত বড় হচ্ছি, শিক্ষিত হচ্ছি ততই অমানবিক, স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি, আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছি। নিজের মা-বাবাকে দেখার, যতœ নেয়ার কোনো সময় নেই। সমাজের নিয়মগুলো আধুনিকতার ছোঁয়ায় পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। অতীতে যৌথ পরিবারে সবাই একসঙ্গে হেসেখেলে সুখ-দুঃখের সঙ্গী হয়ে জীবনযাপন করত। কিন্তু এখন একক পরিবারের ধারণা, আমাদের মন মানসিকতাকে সংকীর্ণ করে দিচ্ছে। ফলে নিজের মা-বাবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি। যে মানুষটা এক সময় মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সারাদিন পরিশ্রম করে আমাদের বড় করেছে, পড়াশোনা শিখিয়েছে তাদেরকেই আমরা ভুল যাই। দিন দিন আমাদের মনুষ্যত্ব, বিবেক, বুদ্ধি সব লোপ পাচ্ছে। এখন দেশে মানুষের গড় আয়ু নারীদের ৭৪.১, পুরুষদের ৭০.৬ বছর। অনেক আগে ভেঙে গিয়েছে যৌথ পরিবার, এরপর থেকে একক পরিবারের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এক তথ্যমতে, দেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠী ছিল ১৯৯০ সালে ৪০ লাখ ৯০ হাজার। এরপর ১৯৯১ সালে দাঁড়ায় ৬০ লাখে। ২০১০ সালের পর ১ কোটি ২৫ লাখের বেশিতে এসে দাঁড়ায় এ সংখ্যা। ২০২৫ সালে এ সংখ্যা ১ কোটি ৮০ লাখ হবে প্রায়। আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রম শব্দটি এখন পর্যন্ত মহামারি হিসেবে ধারণ না করলেও বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে ক্রমেই ভিড় জমছে। কারণ হিসেবে দেখলে পাওয়া যায়, অনেক মা-বাবা তার সন্তান বা সন্তানের স্ত্রীর কাছে অবহেলা, অযতœ, অবজ্ঞা, উপেক্ষা, মানসিক নির্যাতন, একাকিত্ব এমনকি কখনও কখনও দুর্ব্যবহারের শিকার হয়ে বাধ্য হয়ে আশ্রয় নেয় বৃদ্ধাশ্রমে অনেক নামি দামি বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক, চাকরিজীবীও। মানব সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কমে যাচ্ছে আমাদের আবেগ, আন্তরিকতা, ভালোবাসা, মানবিকতা, কৃতজ্ঞতার মতো কোলম মন। ফলে ক্রমান্বয়ে আমরা হƒদয়হীন পশুতে পরিণত হচ্ছি। আমরা শিক্ষিত হচ্ছি ঠিকই কিন্তু আমরা ভুলে যাচ্ছি আমাদের অতীতে, ভুলে যাচ্ছি আমাদের শেকড়কে। যাদের অস্তিত্ব ছাড়া আমাদের বেড়ে ওঠা ছিল অসম্ভব আজকে তাদের শেষ আশ্রয় আমরা হতে চাই না। তাদের শেষ আশ্রয় হয় বৃদ্ধাশ্রম। আজকাল পত্রিকার পাতায়, টিভিতে চোখ রাখলে দেখা যায় বৃদ্ধ পিতা-মাতার আহাজারি। বৃদ্ধাশ্রম থেকে হাজারো পিতা-মাতার আবেগ, অভিমানের চিঠি। হয়তো অনেক মা-বাবা চিঠির উত্তরের অপেক্ষায় থেকেই পৃথিবীর হিসাব-নিকাশের বন্ধ করে পরপারে পাড়ি জমায়।

আমরা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখতে পাই মা দিবস, বাবা দিবসে সন্তানদের হাজারো আবেগঘন পোস্ট কিন্তু বাস্তবে এর ছিটেফোঁটাও দেখতে পাওয়া যায় না।

প্রবীণদের সামাজিক নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করার জন্য জাতীয় সংসদে পিতামাতার ভরণপোষণ বিল-২০১৩ পাস করা হয়। যেখানে বলা হয়েছে সন্তানকে পিতামাতার সঙ্গে থাকতে হবে এবং পিতামাতার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবাসহ সব ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হবে। কিন্তু আইন পাস করে ভালোবাসা, কর্তব্য, শ্রদ্ধাবোধ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভম নয়। এর জন্য প্রয়োজন নৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।

শুধু মা দিবস, বাবা দিবসে নয়, সব সময় সন্তানদের মা-বাবার প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা জেগে উঠুক। প্রবীণদের অধিকারের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, নৈতিকতা, পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ ও সামাজিক সচেতনতা। আজকের নবীন ভবিষ্যতের প্রবীণ। আপনার পিতামাতা হোক আপনার খেলার সঙ্গী। তাই বৃদ্ধাশ্রম নয়, পরিবারই হবে মা-বাবার নিরাপদ আবাসস্থল। অতএব, আপনার সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলুন। যে শিক্ষা আপনার সন্তানকে দেবে ধর্মীয় মূল্যবোধ, নৈতিকতা, পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ ও সামাজিক সচেতনতা। তারা আপনাকে বার্ধক্য বয়সে বুকের মধ্যে কোমল আচরণের মাধ্যমে আগলে রাখবে, প্রতিটা ক্ষণ স্নেহ-ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখবে।

শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০