অনেক সন্তান বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে নিজের কাছে রাখতে পেরে নিজেকে অনেক মহান ভাবা শুরু করেন। আসলে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই ভাবনাটা অমূলকও নয়। কিন্তু পিতা-মাতার সেবা যত্ন করার মাঝে কোন মহত্ব নেই। প্রতিটি সন্তানের দায়িত্ব। পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনের কথা শুনলে অনেক সন্তান এখন বিরক্ত হয়ে বলে থাকেন, একই ধরনের তত্ত্ব কথা সবসময় শুনতে ভালো লাগে না। কি বিচিত্র আমাদের চিন্তা ভাবনা ! আপনার আয় কম, স্ত্রীর সাথে বোঝাপড়া হয়না, ঘরের জায়গা কম, সন্তানের পড়ালেখায় সমস্যা হয়, এইসব অজুহাতে আপনি আপনার পিতা-মাতাকে নিজের কাছে রাখলেন না।
আপনার পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ আপনি হেলায় হারিয়ে ফেললেন। আজ আপনি দামী গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। স্ত্রী, সন্তানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের আত্মীয় স্বজন নিয়ে দেশ বিদেশে নিয়মিত যাতায়াত। বড্ড বেমানান লাগে অসহায় বৃদ্ধা মা-বাবাকে সাথে নিতে। অনেক তথাকথিত উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি পিতা-মাতা বেঁচে আছেন, সে কথা বলতেই লজ্জা পান। মনে রাখা উচিত, সন্তানের জন্য পিতা-মাতার চেয়ে মূল্যবান সম্পদ পৃথিবীতে নাই। তাদের বিকল্প কোন কিছুতেই হবে না। একটা ঘটনা মনে পরে গেল।
আমার এক শিক্ষক চাকরি থেকে অবসরে গেছেন ২০০২ সালে। এখন স্যারের বয়স ৭৭/৭৮ কিংবা কিছু বেশিও হতে পারে। ম্যাডামের (স্যারের স্ত্রী) বয়স ৭০/৭২ হবে। উনাদের দুই ছেলে-মেয়ে। আমার জানামতে, দু’জনই দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তারা পিএইচডি করতে প্রায় পনের বছর আগে উন্নত দেশের দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। কেউ আর দেশে ফিরে আসেননি। দু’জন দুই দেশে মোটামুটি স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। বাবা-মা’কে নিয়েও যাননি।
তবে তিন/চার বছর পর পর তারা বাবা-মা’কে দেখতে দেশে আসেন। এখন সন্তান হিসেবে এই দায়িত্ব তারা পালন করে চলেছেন। স্যারের টাকা-পয়সার অভাব নেই। কিন্তু দেখাশুনা করার কেউ নেই। বৃদ্ধদের কোন আত্মীয়-স্বজনও থাকে না। স্যারের সাথে মাস ছয়েক দেখা হয়েছিল। জানলাম, একজন কাজের মহিলা উনাদের দেখাশুনা করেন, রান্না করে দেন। যদি কোন দিন কাজের মহিলা না আসে, সেদিন স্যার ম্যাডামের খাওয়া-দাওয়া অনেক সময় বন্ধ হয়ে যায়। অনেক কথা বলার পর এক সময় স্যার বলেই ফেললেন, সন্তানদের বেশি বড় মানুষ করতে নেই। তারা তখন বাবা-মায়ের থাকে না।
বুঝতে পারলাম, কতটা কষ্ট বুকের মধ্যে নিয়ে স্যার চলাচল করছেন। স্যারের মতো আমারও মাঝে মাঝে মনে হয়, বাবা-মায়েরা এত এত কষ্ট করে সন্তানকে বড় বড় পদ-পদবিধারী করতে গিয়ে বড় ধরনের ভুল করে ফেলেন। সন্তানের জন্য এত কষ্ট করার কি দরকার। লেখাপড়া না শিখিয়ে যদি ছোটবেলায় কৃষি কাজে কিংবা কারখানার কাজে লাগিয়ে দিতেন, তবে সন্তান অন্তত নিজের পিতা-মাতার পরিচয় দিতে লজ্জা পেত না।
আমাদের এই জীবনের মূল্য কত? চোখ বন্ধ করলে কিছুই সাথে নিতে পারবেন না । কিসের এত ব্যস্ততা ? সারাদিনের মধ্যে মা-বাবার সাথে দশ মিনিট কথা বলার সময় বের করতে পারলেন না। আপনি একটা ব্যর্থ দিন পার করলেন। সকলেই জানি, প্রকৃতির বিচার বড়ই নির্মম। আজ আপনি যা যা করছেন, তার ফল সামনেই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। জীবনের সময় কিন্তু খুব ছোট। শরীরের শক্তি যখন কমে যাবে, প্রকৃতির সেই বিচার সহ্য করতে পারবেন তো? আশাকরি পারবেন। নাহলে এমন করবেন কেন?
লেখক-রিয়াজুল হক, যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক