নাজমুল হুসাইন: দেশের সর্বাধিক পাট উৎপাদনকারী এলাকা ফরিদপুরে গত কয়েকদিনের ভারি বর্ষণে পাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পাটের চারা যেসব ক্ষেতে ছয় থেকে আট ইঞ্চি লম্বা হয়েছে, সেখানে পানি জমেছে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত। ফলে নিমজ্জিত জমির অধিকাংশ তোষা পাটে পচন ধরেছে। এ দেশি পাটের চারা বাঁচবে বড়জোর আর দু-একদিন। ইতোমধ্যে তোষা পাট মরে যাওয়ার খবরও পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন এলাকা থেকে। শুধু ফরিদপুরে নয়, দেশের যেসব অঞ্চলে পাট চাষ হয়েছে সেগুলোর অধিকাংশেরই প্রায় একই চিত্র। ফলে এবারও দেশের পাটের উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এদিকে চলতি মৌসুম শেষ হয়ে এলেও এখনও সারা দেশে লক্ষ্যমাত্রার এক-চতুর্থাংশের বেশি পাটের আবাদ বাকি রয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত সারা দেশে ছয় দশমিক এক লাখ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। যদিও চলতি বছর পাটচাষের আবাদি জমির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছিল আট দশমিক ১৮ লাখ হেক্টর। আর এ বছর পাটের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৮৮ দশমিক ছয় লাখ বেল। অতি বৃষ্টিতে সেই বপন ব্যাহত হয়েছে। আর অনেক স্থানে আবাদ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে কৃষি অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে।
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই)-এর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়েকদিন নিমজ্জিত থাকলে বিশেষ করে তোষা পাটের বীজ পানিতে পচে যায়। সেই তুলনায় দেশি পাটের বীজ নিমজ্জিত অবস্থায় বেশি বাঁচে। ফলে এখন পর্যন্ত যারা তোষা পাট আবাদ করেছে তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এছাড়া চলমান বর্ষণে যে সব এলাকায় পাটের আগাম চাষ হয়েছে, সেখানে প্রয়োজনীয় নিড়ানি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও আবারও কিছু জমিতে পাটের বীজ পুনরায় বপন করা যাবে। তবে সে ক্ষেত্রে কৃষকের আগ্রহ ও বীজ প্রাপ্তি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে। ফলে চলতি বছর পাটের উৎপাদন কিছুটা ব্যাহত হতে পারে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান কৃষিবিদ ড. ওয়ায়েস কবীর বলেন, ‘আবহাওয়ার বিরূপ আচরণ এ বছর পাটের আশানুরূপ ফলনে প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে নি¤œ এলাকার যেসব পাট ডুবে রয়েছে সেসব ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘বর্ষণের এ বছরের আবাদ লক্ষ্যমাত্রাও প্রভাবিত হচ্ছে। যদিও পাটের বপনের সময় রয়ে গেছে, কিন্তু এ বিরূপ আবহাওয়া, বীজের স্বল্পতা ও লোকসানে কৃষকের আগ্রহের কমতি চাষে ভাটা ফেলতে পারে।’
এদিকে দেশের অন্যান্য এলাকায় খোঁজ নিয়ে রাজবাড়ী জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, গত বছর ওই এলাকায় ৪৮ হাজার ৫৬০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছিল। এ বছরও সেই অনুপাতে পাট চাষ করেছেন কৃষকরা। কিন্তু হঠাৎ জলাবদ্ধতায় অধিকাংশ পাটক্ষেত তলিয়ে রয়েছে।
দেশের বিভিন্ন এলাকার চাষিরা বলছে, প্রথম দু-একদিন বৃষ্টিতে পাটচাষিদের উপকার হলেও গত কয়েক দিন অতি বৃষ্টি কৃষকদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন ৬০ ভাগ চাষি জমিতে তোষা পাটের চাষ করছে। যা জলাবদ্ধতায় বাঁচে না। এছাড়া কালবৈশাখী ঝড়ে অনেক স্থানে পাটগাছ মাটিতে শুয়ে গেছে। এতে লোকসান ও হতাশায় পড়েছেন তারা।
জানতে চাইলে সেসব চাষিরা জানান, এসব জমিতে নতুন করে পাটচাষে আগ্রহ নেই তাদের। পাটের তুলনামূলক ভালো দাম না পাওয়াতে এমনিতেই পাটের আবাদের জায়গা নিচ্ছে ভুট্টা। চড়া দামে বীজ কিনে এসব জমিতে পাট রোপণ করা হয়েছিল। যা তলিয়ে তারা অনেক মূলধন হারালেন।
এদিকে ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, বিগত কয়েক বছর ফরিদপুরে পাটচাষের লক্ষ্যমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। ২০১৫-১৬ মৌসুমে এক লাখ ৮৭ হাজার ৫৪ হেক্টর জমিতে পাটচাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল, কিন্তু পাট চাষ হয় দুই লাখ চার হাজার ১৫৪ হেক্টর জমিতে। ২০১৬-১৭ মৌসুমে এক লাখ ৯০ হাজার ১৫৮ হেক্টর জমিতে পাটচাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল, তবে পাটচাষ হয় দুই লাখ ১৬ হাজার ৫১ হেক্টর জমিতে। আর এ বছর ২০১৭-১৮ মৌসুমে দুই লাখ ১৬ হাজার ১৪৯ হেক্টর জমিতে পাটচাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে বর্তমানে অনেক জমি পানিতে নিমজ্জিত।
সম্প্রতি দেশে নতুন পাট বিল করা হয়েছে। এছাড়া আইন করে এ পর্যন্ত দেশে ১৯টি পণ্যের সরবরাহ ও বিপণনে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পাটপণ্যের বৈচিত্র্যকরণ, রফতানি বৃদ্ধিসহ দেশে উৎপাদন বাড়াতে এ ধরনের বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। কিন্তু পাটের উৎপাদন প্রবৃদ্ধি নেতিবাচকই রয়ে গেছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত পাটচাষিদের আগ্রহ বাড়াতে তেমন সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম নেই।
বীজ সংকট থেকে শুরু করে আবাদি জমি হ্রাস, পাটের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার মতো নানা জটিলতায় এখন পাটে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে কৃষক। দেশে পাটের উৎপাদন নিয়ে তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সত্তরের দশকে পাটের সুদিন ছিল। সে সোনালি সময়ের পর শেষ ২০১০-১১ সালেই তুলানামূলক দেশে পাটের উৎপাদন বেশি ছিল। তবে এরপর থেকে আবারও উৎপাদন ক্রমাগত কমছে। যেখানে ২০১০-১১ সালে দেশে ৮৩ লাখ ৯৬ হাজার বেল পাট উৎপাদন হয়েছে। সেখানে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এসে তা ৭৫ লাখ ৬০ হাজার বেলে দাঁড়িয়েছে। একইভাবে যেখানে ২০১১-১২ সালে দেশে ১৮ লাখ ৭৮ হাজার একর জমিতে পাটচাষ হতো, তা এখন নেমেছে ১৬ লাখ ৬২ হাজার একরে।