সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড শিল্পাঞ্চলে দেড় হাজার ফুট গভীরেও মেলেনি পানির সন্ধান। এমনকি ৩০ থেকে ৪০টি গভীর নলকূপে পাওয়া যায়নি প্রত্যাশিত পরিমাণের পানি। ভূগর্ভস্থ পানির সংকট বছর পর বছর তীব্র হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে অনেক শিল্পোদ্যোক্তা চোখে সর্ষেফুল দেখেছেন। এ অবস্থায় জিপিএইচ ইম্পাত ৬০ একরের জলাধারে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে সারা বছর ইস্পাত উৎপাদন করছে। এভাবে দেশে প্রথম বেসরকারি উদ্যোগে রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে জিপিএইচ ইস্পাত। এতে ব্যয় হয়েছে ৩০ কোটি টাকা।
সীতাকুণ্ড এলাকার শিল্পমালিকরা জানান, এখানে বেসরকারি উদ্যোগে নির্মিত হয়েছে দেশের বৃহত্তম শিল্পাঞ্চল। এ শিল্পাঞ্চলে দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগ্রুপ বিএসআরএম, জিপিএইচ, পিএইচপি, কেএসআরএম, টিকে, সানম্যান, এসএ, কেডিএস, মোস্তফা, মোস্তফা হাকিম, কনফিডেন্স, রাইজিং, ইউনিটেক্সসহ কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানির হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ আছে। তাদের বিনিয়োগে গড়ে ওঠে ইস্পাত কারখানা, সিমেন্ট মিল, জুতা উৎপাদন কারখানা, অক্সিজেন প্লান্ট, এলপি গ্যাস প্লান্ট, স্পিনিং মিলস, জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ডসহ বহুমাত্রিক শিল্পকারখানা। কিন্তু এ এলাকায় পানি সংকটের কারণে এসব কারখানার উৎপাদন সচল রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। নানা জটিলতার কারণে এ সমস্যার দ্রুত সমাধান হচ্ছে না। অথচ এ শিল্পাঞ্চল থেকে বছরের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করে।
এ অঞ্চলের পানি সংকটের সমাধান না হলে লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বেন। এতে মিল-কারখানা বন্ধ হবে। ব্যবসায়ীরা দেউলিয়া হয়ে যাবেন। তাই সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর শিগগির পানি সংকট নিরসনে এগিয়ে আসা উচিত। আর বিষয়টি বিবেচনা করে স্থানীয় সংসদ সদস্য, ট্রেডবডি, শিল্পমালিক ও স্থানীয় প্রশাসন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চিঠির মাধ্যমে সংকট সমাধানের উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করে।
এদিকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে জলাধার তৈরির মাধ্যেমে পানির সংকট কাটিয়ে তা দিয়ে বছরজুড়ে উৎপাদন করছে জিপিএইচ ইস্পাত। প্রতিষ্ঠানটির পাশ দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইন বরাবর দক্ষিণে দুই কিলোমিটার দূরবর্তী ছোট কুমিরা ছড়া (মগা ছড়া) এবং উত্তরে দুই কিলোমিটার দূরবর্তী বোয়ালিয়া ছড়া রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি এ দুই ছড়ার মাঝে ৬০ একর জমিতে পাহাড় থেকে গড়িয়ে আসা বৃষ্টির পানি বাঁধ দিয়ে সংরক্ষণ করছে। আর সারা বছর রড উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করছে। ইস্পাত উৎপাদনে ব্যবহƒত পানি অপচয় না করে তা আবার ব্যবহারোপযোগী করা হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, আশপাশের বাসিন্দারা দৈনন্দিন কাজেও এ পানি ব্যবহার করছেন।
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলেন, শুষ্ক মৌসুমে সীতাকুণ্ডের পতিত পাহাড়ি এলাকাগুলো পানির অভাবে ফেটে চৌচির হয়ে যায়। এই পাহাড়ি পতিত নালা, নর্দমা বা ছড়াগুলোয় ছোটখাটো বাঁধ নির্মাণ করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা যায়। অথচ এই বৃষ্টির পানি পাহাড় গড়িয়ে সমতল হয়ে সাগরে চলে যায়। পাহাড়ের খাল, খন্দ, নালা ও ছড়াগুলোয় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে ওই অঞ্চলের সবার পানির চাহিদা জোগান দেয়া সম্ভব। এ চিন্তা থেকে প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তারা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে ব্যবহারের বিকল্প পরিকল্পনা করেন। এতে পরিবেশের ওপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে কি না, তা একটি সরকারি সংস্থা দিয়ে সমীক্ষা করা হয়। তাদের সুপারিশ পাওয়ার পর জিপিএইচ একটি জলাধার নির্মাণ করে, যা ইস্পাত উৎপাদনে ব্যবহƒত পানি অপচয় না করে আবার ব্যবহারোপযোগী করা হচ্ছে। এতে কারখানাটির পানির অপচয়ের মাত্রাও কমে গেছে। আবার ভূগর্ভের পানি ব্যবহার না করায় চাপ পড়বে না।
জিপিএইচ ইস্পাতের হেড অব ফ্যাসিলিটি অ্যান্ড এস্টেট এবিএম সাহেদুল আলম আল মাসুদ বলেন, বর্তমানে প্রতিদিন তিন হাজার টন রড উৎপাদিত হচ্ছে কারখানাটিতে। এ পরিমাণ রড উৎপাদনে গড়ে পানির প্রয়োজন হয় প্রায় ৪০ লাখ লিটার। এই সম্পূর্ণ পানির জোগান সংরক্ষণ করা বৃষ্টির পানি থেকে নেয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে জিপিএইচ ইস্পাতের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমাস শিমুল বলেন, ইস্পাত উৎপাদনে পানি নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম। গভীর চিন্তা, বিশ্লেষণ ও বিশেষজ্ঞ দিয়ে সমীক্ষা করে চার বছর আগে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহারের পরিকল্পনা নেই। আমাদের জিপিএইচ কারখানা ও পানি সংরক্ষণ এলাকার চারপাশে রয়েছে ছোট-বড় পাহাড়। পাহাড়গুলোর পাদদেশে বৃষ্টির পানি জমতে জমতে কৃত্রিম হ্রদের আকার নিয়েছে। প্রায় ৬০ একর জায়গায় এ পানি সংরক্ষণ করা হচ্ছে, যা এখন পুরোদমে ব্যবহƒত হচ্ছে। সংরক্ষণ করে পানি পাইপের মাধ্যমে পানি শোধনাগারে নেয়া হয়। এরপর শোধন করে তা কারখানা ও দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারের জন্য সরবরাহ করা হয়। পাশাপাশি পাহাড়গুলোয় রোপণ করা হয়েছে নানা প্রজাতির গাছগাছালি। সংরক্ষণ করা পানিতে মাছ চাষ করা হচ্ছে। এর জন্য আমাদের প্রায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। আর বেসরকারি উদ্যোগে এ ধরনের বড় রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং প্রকল্প আমরাই প্রথম দেশে বাস্তবায়ন করেছি।