প্রতিনিধি, কুষ্টিয়া: উপমহাদেশের আধ্যাত্মিক সাধক বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের ১৩৪তম তিরোধান দিবস আগামী (১৭ অক্টোবর) বৃহস্পতিবার। এ উপলক্ষ্যে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার ছেঁউড়িয়া লালন আখড়াবাড়িতে তিন দিনব্যাপী লালন মেলা এবং প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে আলোচনা সভা ও লালন সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
লালন মেলার এক সপ্তাহ আগে থেকেই হাজারো ভক্ত-অনুসারীরা দূরদূরান্ত থেকে আসতে শুরু করেছেন। লালন মেলা উপলক্ষ্যে আখড়াবাড়িতে হাজারো ভক্ত-অনুসারীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। তিরোধান দিবস উপলক্ষ্যে কালি নদীর পাড় ঘেঁষে লালন মাঠে শতাধিক অস্থায়ী থাকার জায়গা ও দোকান বসেছে। লালন শাহের মাজার প্রাঙ্গণ, মাঠ, কালি নদীর পাড়ঘেঁষে বসেছে দূরদূরান্ত থেকে আসা ভক্ত-অনুসারীদের খণ্ডখণ্ড দল। সেখানে ভিড় জমাচ্ছেন দর্শনার্থীরা। গুরুশিষ্য, ভক্ত-অনুসারী আর দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত প্রাঙ্গণ। লালন মেলার আগেই ভক্ত-অনুসারীদের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে স্থানটি। মাজার প্রাঙ্গণ পরিষ্কার করে বর্ণিল পরিবেশ সৃষ্টি করছে লালন একাডেমি কর্তৃপক্ষ। দূরদূরান্ত থেকে আসা ভক্ত-অনুসারীদের খণ্ডখণ্ডভাবে দলবদ্ধ হয়ে লালন ফকিরের গান গাইছেন। দিনরাত গান ছাড়াও তারা লালন ফকিরের বাণী নিয়ে একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করছেন। অনেকে আবার লালনের মত ও পথের দীক্ষা নিচ্ছেন।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় এবং লালন একাডেমির আয়োজনে আগামী
আগামী ১৭ অক্টোবর থেকে তিন দিনব্যাপী লালন মেলা শুরু হবে। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে হাজারো লালন ভক্ত অনুসারীরা লালন আখড়াবাড়িতে ইতিমধ্যে আসতে শুরু করেছেন।
লালন মেলায় অনুষ্ঠানে প্রতিদিনই আলোচনা সভা শেষে মঞ্চে শুরু হবে লালন সঙ্গীত। যেখানে গাইবেন লালন একাডেমির শিল্পী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত বাউল শিল্পী ও ভক্তরা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, লালন মেলা উপলক্ষ্যে ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে দূরদূরান্ত থেকে হাজারো লালন ভক্ত-অনুসারীরা আসতে শুরু করেছে। প্রতিনিয়ত লালন ভক্ত ও দর্শনার্থীদের উপস্থিতি বেড়েই চলেছে। লালন মেলা শুরুর আগেই আখড়াবাড়িতে ভক্ত অনুসারীদের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে। ভক্ত-অনুসারীরা খণ্ডখণ্ডভাবে দলবদ্ধ হয়ে লালন ফকিরের গান গাইছেন। লালনের বাণী ও আদর্শ নিয়ে একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করছেন। লালনের গানে গানে মুখরিত হয়ে উঠেছে। ভক্ত অনুসারীরা লালন ফকিরের মাজার প্রাঙ্গণ, মাঠ, কালি নদীর পাড়ঘেঁষে অস্থায়ীভাবে তৈরি করেছেন আস্তানা। লালন মেলায় কালি নদীর পাড়ে মাঠে বসেছে গ্রামীণ মেলা। আশপাশের এলাকায়ও হরেক রকমের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা।
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে আসা খন্দকার জাহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা ঝিনাইদহ থেকে গত কয়েকদিন আগে ছেঁউড়িয়ায় এসেছি। আমি একজন লালন ভক্ত-অনুসারী। আমার মতো শতশত ভক্ত-অনুসারীরা এখানে এসেছেন। প্রতিদিনই লোকজন আসছে বিভিন্ন জেলা থেকে। খুবই ভালো লাগছে। এবারের মেলাটা খুবই বড় মেলা হবে বলে আশা রাখি।
লালন একাডেমির বাউল শিল্পী দীপু শাহ বলেন, লালনের উৎসব এর আগে বন্ধ থাকায় সাধু-গুরুরা হতাশায় ভুগছিলেন। এবার লালনের তিরোধান দিবস হবে। এজন্য আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি। সুন্দরভাবে অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন করা হবে। যতদিন বেঁচে থাকবো সাঁইজির কালাম শুনিয়ে যাব। লালন মেলায় আসা দর্শনার্থীরা বলেন, লালন মেলায় উপলক্ষ্যে আখড়াবাড়িতে দূরদূরান্ত থেকে ভক্ত অনুসারীরা এসেছেন। এখানে এসে খুবই ভালো লাগছে। লালন ভক্ত ও অনুসারীদের আস্তানাগুলো দেখতে খুব সুন্দর লাগছে। তাদের গাওয়া গান শুনতে ভালো লাগে। জায়গায় জায়গায় তারা গান গাচ্ছেন। লালন সাঁইজির গানে ও বাণীতে এই এলাকার মুখরিত হয়ে উঠেছে।
লালন একাডেমির কয়েকজন সদস্য বলছেন, লালন ফকির দীর্ঘ সময় ধরে তার নিজস্ব আত্মদর্শনের আলোকে ভক্ত আশেকান ও শিষ্যদের নিয়ে যেসব উৎসবমুখর কর্মকাণ্ড করতেন তারই ধারাবাহিকতায় পহেলা কার্তিক সাঁইজির তিরোধান দিবস পালন করতে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভক্তশিষ্য-অনুসারীরা ছেঁউড়িয়ার আঁখড়াবাড়িতে মিলিত হন। কুষ্টিয়ার আখড়াবাড়ির ভেতরে ও বাহিরে যেন পা ফেলার জায়গা থাকে না। এবারও লালন মেলা শুরুর এক সপ্তাহ আগে থেকেই দূরদূরান্ত থেকে হাজারো ভক্তরা এসেছেন। সাধু ভক্তদের এই মিলন মেলায় লালনের রেখে যাওয়া মানবমুক্তির আধ্যাত্মিক বাণী সম্বলিত গান গাওয়া হয়। লালন শাহের গান শুনতে ও এখানে ঘুরতে জড়ো হচ্ছেন অসংখ্য দর্শনার্থীরা।
বাউলসাধক কফিল শাহ বলেন, লালনের গানে সবার ওপরে রয়েছে মানুষ। সবকিছুর সন্ধান পাই তার গানে। জগতের সকল ভাবনার উত্তর তার গানে। কিন্তু লালনকে বুঝতে পারি না। সারা জীবন ধরে লালনেরই সন্ধান করে চলেছি। যত দিন যাচ্ছে ফকির লালন সাঁইয়ের জীবন ও গানের ব্যাপ্তি ততই প্রভাব বিস্তার করছে মানুষের মাঝে।
তিনি আরও বলেন, সাঁইজি ১১৬ বছর বেঁচে ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ও বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাননি। বরং তার সৃষ্টির ঔজ্জ্বল্য বেড়েছে, বেড়েছে পরিধি। ফকির লালন শাহ শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে এক ঐন্দ্রজালিক মোহময়তা বিস্তার করে চলেছেন। দিনদিন তার সে ঐন্দ্রজালিক বলয়ের বিস্তৃতি ঘটছে। অগণিত মানুষ তার বিশাল সৃষ্টি জগতে প্রবেশ করে সন্ধান করছেন যেন লালনেরই।
এ বিষয়ে কুষ্টিয়ার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক ও লালন একাডেমির অ্যাডহক কমিটির সভাপতি শারমিন আখতার বলেন, বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের ১৩৪তম তিরোধান দিবস উপলক্ষ্যে তিনদিন ব্যাপী লালন মেলার আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিদিনই সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে আলোচনা সভা শুরু হবে। আলোচনা শেষে শুরু হবে লালন সঙ্গীত। মেলার সার্বিক প্রস্তুতি চলছে।
তিনি আরও বলেন, মাজার প্রাঙ্গণ ও তার আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করবে।
উল্লেখ্য, ১৮৯০ সালের পহেলা কার্তিক উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাধক বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ দেহধাম
ত্যাগ করেন। এরপর থেকে কুমারখালি উপজেলার ছেঁউরিয়ায় তার স্মরণে লালন একাডেমি ও জেলা প্রশাসন এই তিরোধান দিবস চালিয়ে আসছে।