পর্ব এক…………
আর্থিক ব্যবস্থাপনাবিষয়ক প্রশিক্ষণে অংশ নিতে সম্প্রতি দ্বিতীয়বারের মতো যাওয়া হয় কনুফুসিয়াসের দেশ চীনে। ঈদের ছুটি থাকায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অংশগ্রহণকারীদের তথ্য ঢাকায় চীনা দূতাবাসে পাঠাতে না পারায় একই ফ্লাইটে পুরো দলের যাত্রার ব্যবস্থা করা যায়নি। ২০ জনের দলকে যেতে হলো তিন ধাপে।
দ্বিতীয় দলের প্রতিনিধি হিসেবে বেইজিং পৌঁছাই এক দুপুরে। তৃতীয় দলের বেইজিং পৌঁছার সময় ছিল এক ঘণ্টা পর। তাই গুয়ানজুতে পাঁচ ঘণ্টার যাত্রাবিরতিসহ ১২ ঘণ্টার দীর্ঘ ভ্রমণে বেইজিং পৌঁছেও অপেক্ষা করতে হলো। এক ঘণ্টা পরের সেই বিমানটি বেইজিংয়ের মাটি স্পর্শ করল দুই ঘণ্টা দেরি করে। সহ-প্রশিক্ষণার্থীদের লাগেজ খুঁজে পেতে কালক্ষেপণ হয়, মোট সাড়ে তিন ঘণ্টা পর বিমানবন্দরের সীমানা ছাড়লাম। অভ্যর্থনাকারী আমাকে জানালেন, যানজট থাকলে অনিশ্চিত, নতুবা ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে যাব নির্ধারিত গন্তব্যে। অবশেষে কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই মিনিট ৫০-এর মধ্যে আমাদের গাড়ি থামে ফ্রি কমফোর্ট হোলিডে হোটেলে। হেইডিয়ান জেলার দক্ষিণ সুইউয়ান সড়কের হোটেলটির অবস্থান চমৎকার। বেইজিং শহরের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত। হোটেলের পাশ ঘেঁষে রয়েছে মেট্রো রেললাইন। কক্ষ থেকে শোনা যায় মেট্রোরেলের অনবরত আসা-যাওয়ার শব্দ। আট তলাবিশিষ্ট হোটেলের প্রতিটি ফ্লোরে রয়েছে ৮০টি করে অতিথি কক্ষ।
পরদিন সকালে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণপর্ব। চীনের সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইকোনমিকের উদ্যোগে আয়োজিত প্রশিক্ষণ কোর্সের উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ট্রেনিংয়ের সহকারী ডিন মেং সিপিং। তিনি বক্তব্য রাখলেন তার মাতৃভাষা মান্দারিনে। দোভাষীর ভূমিকা পালন করেন লি পিং পিং।
বিকালে দেখতে যাই বেইজিং চিড়িয়াখানা। হোটেল থেকে মিনিট ত্রিশের যাত্রায় পৌঁছে যাই কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে। চিড়িয়াখানার প্রবেশমুখে দর্শনার্থীদের দীর্ঘ সারি। ১৯ ইউয়ানের বিনিময়ে প্রাপ্তবয়স্ক যে কেউ ঘুরে দেখতে পারে পুরো চিড়িয়াখানা। আমাদের হয়ে আয়োজকরাই মিটিয়ে দেন প্রবেশ ফি। ভালুক, বানরসহ নানা ধরনের প্রাণী থাকলেও দর্শনার্থীর মূল আকর্ষণ ছিল বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী পান্ডাকে ঘিরে। আমাদের গাইড সুফিয়া জানান, পাঁচটি পান্ডা আছে এখানে। তিনটির দেখা মিলল বাইরে। অন্য দুটি নিজেদের ঘরে অবস্থান করছে। তবে দেখা পাওয়া তিনটি আবার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। নানা কসরত করেও দর্শনার্থীরা ভাঙাতে পারেননি তাদের সুখনিদ্রা। তাই ঘুমন্ত পান্ডাকে ক্যামেরাবন্দি করে ফিরতে হলো সবাইকে।
পরের গন্তব্য ছিল বেইজিং সামার প্যালেস। ১১৫৩ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত এই রাজদরবারটি গ্রীষ্মকালে রাজাদের অবকাশ যাপনের জন্য ব্যবহৃত হতো। ১৯২৪ সালে এটি সর্বসাধারণের জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ১৯৯৮ সালে তা ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পায়। জনপ্রতি প্রবেশ ফি ৩০ ইউয়ান। এখানেও আমাদের হয়ে তা মিটিয়ে দেন সুফিয়া। রাজপ্রাসাদের প্রধান দুটি উপাদান হচ্ছে, লনজিভিটি পর্বত ও কানিং লেক। পর্বতের ঠিক পদদেশে রয়েছে ৭২৮ মিটার লম্বা একটি করিডোর, যা যুক্ত করেছে প্রাসাদের অন্যান্য ভবনকে। সুফিয়া জানান, এটি পৃথিবীর দীর্ঘতম করিডোর। পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে ৩৬ মিটার দীর্ঘ একটি মার্বেল পাথর। করিডোরের কাঠনির্মিত ছাদ আর কাঠের খুঁটি খচিত নানা রঙের আল্পনায় পাওয়া যায় অতীত দিনের চিত্রশিল্পের নমুনা। করিডোরের দক্ষিণ দিকে ২৯০ হেক্টরের কানিং লেক। এর উত্তর-পূর্ব প্রান্তে পানিতে ভাসছে অসংখ্য পদ্ম গাছ। ফুটে রয়েছে বেশকিছু লাল পদ্মও। বিশ্বের নানা প্রান্তের, নানা বর্ণের, নানা বয়সের অগণিত মানুষের কোলাহলে মুখর এ হ্রদ অঞ্চল। আছে নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থাও। জনপ্রতি ৩০ ইউয়ান দিয়ে উপভোগ করা যায় নৌকা ভ্রমণ। ব্যক্তিগত খরচে দলের অনেকে পানিতে ভাসতে চাইলেও গাইডের অনুমোদন না পাওয়ায় সে শখ পূর্ণ হলো না। দীর্ঘ এই করিডোরে কথা হয় ব্রিটিশ তরুণ জেমসের সঙ্গে। বাবা, মা ও বোনকে নিয়ে চীনে ভ্রমণে এসেছেন তিনি। দেখছেন এই বিশ্ব ঐতিহ্য। বিশাল এই হ্রদ দেখার পর তিনি মনে করেন, এখানে বেড়াতে আসাটা স্বার্থক হয়েছে।
পরদিন সকালে যাই বিশ্বখ্যাত মহাপ্রাচীরে। ২০ জনের দলের চারজন এর আগেও মধ্যযুগের এই সপ্তাশ্চর্য দেখেছেন। বাকি ১৬ জন প্রথমবারের মতো পা রাখতে যাচ্ছেন গ্রেট ওয়ালে। তাদের উচ্ছ্বাস যেন থামছেই না। সুফিয়া সকাল ৮টায় আমাদের নিয়ে ছুটলেন মহাপ্রাচীরের দিকে। দু’ধারে নানা জাতের বৃক্ষরাজি আর মাঝখানে মসৃণ পিচঢালা পথ দিয়ে ছুটে চলল আমাদের গাড়ি। বেইজিং শহরের সীমান্ত ছাড়তেই দেখা গেল রাস্তার দু’পাশে উঁচু-নিচু অনেক পাহাড়। সবুজে আচ্ছাদিত পাহাড়ের গায়ে যেন হেলান দিয়ে মেঘ ঘুমায়! বেশ কয়েকটি টানেল পাড়ি দিয়ে মিনিট ৫০ পর গাড়ি থামল গ্রেটওয়ালের নিচে।
বেইজিং শহর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরের মহাপ্রাচীরের এ অংশটির নাম বেডালিং গ্রেটওয়াল। ইয়ানজিং জেলায় অবস্থিত মহাপ্রাচীরের এ অংশটি নির্মিত হয় ১৫০৫ সালে। ১৯৫৩ সালে বেডালিং মহাপ্রাচীরের তিন হাজার ৭৪১ মিটার পর্যটকদের জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ১৯৮৭ সালে ইউনেস্কো মহাপ্রাচীরের এ অংশকে সাংস্কৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা দেয়। ২০০৭ সালে এটি বিশ্বের নতুন সপ্তাশ্চর্যের নাম্বার ওয়ান হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
সকালের গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি সত্ত্বেও আমরা পৌঁছার আগে শতাধিক পর্যটক-বাস অবস্থান নেয় গ্রেটওয়ালের পাদদেশে। স্থানীয় ও বিদেশি পর্যটকের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। ইউরোপিয়ান থেকে আফ্রিকান, আমেরিকান থেকে অ্যারাবিয়ান, এশীয় থেকে ওশেনিয়ান বিশ্বের প্রায় সব প্রান্তের অনেক মানুষের মিলনমেলা বসে গ্রেটওয়ালের পাদদেশে। আমি এর আগে গোয়ান জোহংয়ে অংশ দিয়ে মহাপ্রাচীরে উঠেছিলাম, যেখানে কোনো কেব্লকার ছিল না। বেডালিং প্রান্তে কেব্লকারের ব্যবস্থা রয়েছে। জনপ্রতি ৪৫ ইউয়ান দিয়ে ঢোকা যায় গ্রেটওয়ালের এ প্রান্তে। আর কেব্লকারে যাওয়া-আসা করলে গুনতে হয় আরও ১৪০ ইউয়ান। চীনের রাজস্ব আয়ের বড় একটি অংশ যে গ্রেটওয়াল থেকে আসে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আয়োজকদের বদৌলতে কেব্লকারে চড়ে বসলাম দলের সবাই।
অর্ধেক পথ গিয়ে থেমে যায় কেব্লকার। আরও ওপরে ওঠার জন্য চরণ যুগলই ভরসা। কেব্লকার থেকে নেমে প্রয়োজনীয় পরামর্শসহ দেড় ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়ে সবাইকে নিজের মতো ঘোরাঘুরির সুযোগ করে দেন গাইড সুফিয়া। ইতিপূর্বে একবার চূড়ায় উঠেছি। তাছাড়া আগের দিন পায়ে হালকা চোট পাওয়ায় আমার পক্ষে ওপরে ওঠা সম্ভব নয়। নাহিদ ম্যাডাম ও নজরুল স্যারও আমার মতো আশেপাশে ঘুরে ক্ষান্ত দিলেন। কিন্তু অন্যরা যেন কোথায় হারিয়ে গেল! নির্ধারিত সময়ের পরও কারও খোঁজ নেই। তাদের খুঁজে বের করতে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবী গাইড অ্যাডারসনের অবস্থা কাহিল। দুই ঘণ্টা পর সবার দেখা পাই। জীবনে প্রথমবার গ্রেটওয়াল দেখছে, তাই সময়সীমা না মানলেও দলনেতা শিবলী স্যার কারও প্রতি অসন্তুষ্ট হলেন না। তবে দুই ঘণ্টা ছুটোছুটি আর মোবাইল ফোন-ক্যামেরার ক্লিক করেও যেন অনেকের মন ভরছে না। আরও দেখতে চায় তারা। তাই কেব্লকার থেকে নেমেও গ্রেটওয়ালকে পেছনে রেখে ক্যামেরাবন্দি করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে সবাই। ওয়ালের পাদদেশে নানা ধরনের পণ্য নিয়ে পসরা সাজিয়েছেন অনেক দোকানি। কোনো পর্যটক দল দেখা মাত্র হাঁকডাকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের নিরন্তর চেষ্টা চলে তাদের। গাইড এখান থেকে কিছু কিনতে বারণ করায় দলের কারও কিছু কেনা হলো না।
মহাপ্রাচীর দর্শনের পরদিন এক সপ্তাহের জন্য বেইজিং ছাড়তে হয়। এবারে গন্তব্য প্রায় এক হাজার ৬০০ কিলোমিটার দূরের হুনান প্রদেশের রাজধানী চাংসা। পুরো সপ্তাহ প্রায় তিন হাজার বছরের পুরোনো এ শহরের নানা দর্শনীয় স্থান ঘুরে আবারও ফিরে এলাম বেইজিংয়ে। পরদিন আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো তিয়েনয়ানমেন স্কয়ার ও নিষিদ্ধ নগরীতে। রাস্তায় যানজট হতে পারে এ আশঙ্কায় সকাল সাড়ে ৮টায় আমাদের নিয়ে যাত্রা করেন সুফিয়া। দু-তিনবার স্বল্প সময়ের জন্য সিগন্যালে অপেক্ষা করা ছাড়া নির্বিঘ্নে গন্তব্যে গাড়ি পৌঁছায় ৩০ মিনিটের মধ্যে। (চলবে)
মিনহাজুল ইসলাম জায়েদ