বেইজিংয়ের পথে-প্রান্তরে

বাস থেকে নেমেই চক্ষু চড়কগাছ। সকাল ৯টা। অথচ এরই মধ্যে কয়েকশ’ গাড়ির সমাহার। বাংলাদেশে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের সমাবেশ শেষে ঢাকার রাজপথে যেমন জনস্রোত বয়ে যায়, তিয়েনআনমেন স্কয়ার কিংবা নিষিদ্ধ নগরীমুখী পর্যটকদের স্রোতও ছিল তেমনি। বিশ্বের প্রায় সব প্রান্তের মানুষের সমাগম ঘটে এখানে। এ যেন বিশ্ববাসীর মিলনমেলা। অত্যন্ত সুশৃঙ্খলিত, নেই কোনো হুড়োহুড়ি, চিৎকার চেঁচামেচি। পাণ্ডার ঝাণ্ডা নিয়ে চলছে গাইড সুফিয়া ও তার সহকারী ক্যানিস। পিছু পিছু চলছি আমরা ২০ বঙ্গসন্তান।
প্রথমেই দেখি তিয়েনআনমেন স্কয়ার। মুক্তমঞ্চ হিসেবে এটি পরিচিত। ১০৯ একর জায়গাজুড়ে নির্মিত এ স্কয়ারে একসঙ্গে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ সমাবেত হতে পারে। ১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর আধুনিক চীনের স্থপতি মাও সেতুং এ তিয়েনআনমেন স্কয়ারে ঘোষণা দেন সমাজতান্ত্রিক চীনের। ১ অক্টোবরে পালিত হয় চীনের স্বাধীনতা দিবস। ১৯৪৯ সালের ঘটনা তিয়েনআনমেন স্কয়ারকে যেমন বিশ্ববাসীর কাছে নতুন চীনের বার্তা দিয়েছে; এর ঠিক ৪০ বছর পর এখানকারই একটি ঘটনা বিশ্ববাসীর নিন্দা কুড়িয়েছে। ১৯৮৯ সালে গণতন্ত্রের দাবিতে তিয়েনআনমেন স্কয়ারে সমবেত হয়ে আন্দোলন শুরুর পরে হাজারো আন্দোলনকারীকে হত্যা করে পরিস্থিতি সামাল দেয় তৎকালীন সরকার। নির্মম এ ঘটনায় নিহতের স্মৃতি রক্ষার্থে হংকংয়ে নির্মাণ করা হয়েছে পিলার অব শেইম। অবশ্য বেইজিং কিংবা তিয়েনআনমেন স্কয়ারে এ নিয়ে কোনো স্মৃতিফলক নেই। এমনকি বর্তমান প্রজন্ম এ ঘটনাটি জানুক তাও চায় না চীন সরকার। টেলিভিশন ও ইন্টারনেট থেকে এ আন্দোলনের বইপত্র মুছে ফেলার চেষ্টা করছে সরকার। ২০১৪ সালে এএফপি প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায় এ প্রসঙ্গে।
তিয়েনআনমেন স্কয়ারের দক্ষিণের ভবনে রয়েছে মাও সেতুংয়ের মরদেহ। নেতার মরদেহ দেখতে চীনাদের আগ্রহ অত্যাধিক। দীর্ঘ লাইন লেগে আছে সেখানে। গাইড জানান, ১০ বছর আগে প্রায় তিনঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে একবার প্রাণহীন মাও সেতুংকে দেখতে পেরেছিলেন। শুধু মুখমণ্ডল উম্মুক্ত, পুরো দেহ দলীয় পতাকা দিয়ে আবৃত।
তিয়েনআনমেন স্কয়ারের উত্তর দিকে একটু সামনে হাতের ডানে পাওয়া গেল বিশাল ফুলের বাগান। অগণিত প্রস্ফুটিত ফুলের সৌরভে সুরভিত পুরো বাগান। বাগানটি এমনভাবে সজ্জিত যা এক কথায় অসাধারণ। হাজারো ফুলের সৌরভে বিমোহিত পর্যটকরা ছবি তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এখানে কথা হয় হুইল চেয়ারে করে আসা মার্কিন নাগরিক এলিজাবেথের সঙ্গে। ভাইপো মার্ক স্মিথের সঙ্গে এসেছেন চীন ভ্রমণে। ফুলের জলসা দিয়ে শেষ হয়েছে তিয়েনআনমেন স্কয়ার। এর উত্তরে রয়েছে একটি রাস্তা, আর রাস্তার উল্টো পাশে বিশাল দেয়াল ঘেরা প্রাসাদের অস্তিত্ব দেখা যায়। আন্ডারপাস দিয়ে আমরা অতিক্রম করলাম রাস্তাটি। প্রাসাদের দেয়ালের মাঝ বরাবর রয়েছে সুসজ্জিত একটি গেট। গাইড জানান, এর নাম নর্দান গেট বা গেট অব ডিভাইন সাইট। গেটের পাশে রয়েছে পরিণত বয়সের মাও সেতুংয়ের বিশাল ছবি। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই পাওয়া গেল কাক্সিক্ষত নিষিদ্ধ নগরী। ১৪০৬ সালে মিং সম্রাট ঝুডির নির্মাণকাজ শুরু করেন, ১৪২০ সালে তা শেষ হয়। এখানে বসে মোট ২৪ জন সম্রাট তাদের শাসনকাজ পরিচালনা করেন। এটি মিং ও চিন শাসনামলের রাজ প্রাসাদ ছিল। সাধারণের প্রবেশ নিষেধ ছিল বলে এর নাম রাখা হয় নিষিদ্ধ নগরী। চীনা ভাষায় এর নাম গুগং বা প্রাচীন নগরী। এটি বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন রাজপ্রাসাদ। ইউনেস্কো ১৯৮৭ সালে একে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা দেয়। বর্তমানে এটি আর রাজপ্রাসাদ নয়, পুরোপুরি পর্যটনকেন্দ্র। এটি মূলত চীনের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পরিচয় বহন করছে।
নর্দান গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়লো বিশাল একটি ক্যাম্পাস। এখানে টানানো বোর্ড পড়ে জানা যায়, এটি নিষিদ্ধ নগরীর মূল প্রাসাদ। বিভিন্ন অনুষ্ঠান, উৎসব আয়োজনে এটি ব্যবহৃত হতো। মূল প্রাসাদে রয়েছে তিনটি বিশেষ হলো যথা- হল অব সুপ্রিম হারমনি, হল অব সেন্ট্রাল হারমানি ও হল অব দ্য প্রিজারভিং হারমানি। আমাদের জন্য বরাদ্দ মাত্র এক ঘণ্টা। তাই সবকিছু খুঁটিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি। ভাসা ভাসা ভাবেই দেখেই মেটাতে হয়েছে চোখের ক্ষুধা। হল অব
সুপ্রিম হারমানির ৩০ মিটার উঁচু ভবনটিই নিষিদ্ধ নগরীর সর্বোচ্চ ভবন। সদর ভবনের পর বিশাল মাঠ সমেত উঠান পাড়ি দিয়ে পাওয়া গেল আরও কিছু ভবন। গাইডের সহায়তায় জানতে পারি, এটি অন্দরমহল। সদর প্রাসাদের মতো এখানেও আছে তিনটি বিশেষ স্থাপনা। প্রথমটি হ্যাভেনলি পিস হল, পরেরটি হল অব ইউনিয়ন অ্যান্ড পিস। সর্বশেষেটি হল অব টেরিসট্রিয়াল ট্যাঙকোয়িলিটি। এখানে কথা হয়, শিশুপুত্রসহ ভ্রমণে আসা ইসরাইলি মিখাইলের সঙ্গে। একটু সামনে গিয়ে দেখা পেলাম এ যুগের কয়েকজন রাজা-রানীকে। একশত চাইনিজ মুদ্রা দিয়ে রাজকীয় পোশাক পরে রাজ সিংহাসনে বসে ছবি তোলার সুযোগ রয়েছে সেখানে। সঙ্গে বিশেষ ক্যামেরায় তোলা ছবিটিও পাওয়া যাবে।
রাজপ্রাসাদ থেকে বের হওয়ার পথে রয়েছে চমৎকার একটি বাগান। অত্যান্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বাগানটিতে রয়েছে হরেক রকমের গাছ। গাইড জানান, সেপরেস নামক এক প্রজাতির গাছ রয়েছে। সেগুলোর বয়স ৩০০ থেকে ৫০০ বছর। দীর্ঘ পথচলার ক্লান্তি জুড়াতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে দলবদ্ধভাবে ফ্রেমবন্দি হলাম। বাগানের পাশে রয়েছে দুটি স্যুভেনির শপ। ঢুঁ মেরে দেখি পণ্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মাঝে নেই। তাই খালি হাতে ফিরে আসতে হলো। প্রবেশদ্বারের ন্যায় বহির্গমন পথেও অনেক মানুষের সমাগম দেখা গেল। এখানে বাড়তি পাওনা, বেশ কয়েকজন ভাসমান হকার। কিছু ভিক্ষুকের অস্তিত্বও দেখা গেল। সুহেল, ফিরোজ, মাহফুজারা ভাসমান হকারদের সঙ্গে দরকষাকষি করে কিনে নেন প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস।
পরের গন্তব্য ছিল বেইজিং স্টেডিয়াম। ২০০৮ সালের অলিম্পিক গেমস উপলক্ষে অলিম্পিক নির্মিত হয় স্টেডিয়ামটি। অনন্য স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত স্টেডিয়ামটি দেখতে অনেকটা পাখির বাসার মতো। এ কারণে স্থানীয়দের কাছে এর পরিচয় বার্ডনেস্ট হিসেবে। এটি বর্তমানে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ স্টিল স্ট্রাকচার। ৬৯ দশমিক দুই মিটার উঁচু স্টেডিয়ামটি উত্তর-দক্ষিণে ৩৩৩ মিটার বিস্তৃত। ২০০৮ সালের অলিম্পিক গেমস উপলক্ষে শুধু স্টেডিয়ামই নয়, স্টেডিয়াম সন্নিকটে বিশাল জায়গা নিয়ে তৈরি করা হয় অলিম্পিক পার্ক। এখানে নির্মাণ করা হয় পোনকি সাত তারকা হোটেল।
এক ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়ে পার্কের মূল প্রবেশদ্বারের কাছে আমাদের ছেড়ে দেন গাইড সুফিয়া। ভেতরে ঢুকতেই সাজানো গোছানো বিশাল এক পার্ক ভেসে উঠে চোখের সামনে। পায়ে চলার পথে দুই পাশে লাগানো ফুলের স্তম্ভ। আছে পুরো চত্বর ঘুরে দেখার জন্য রোলার কোস্টারের ব্যবস্থা। বয়স্ক ও যারা হাঁটতে অপারগ তাদের কৃত্রিম এ বাহনে চড়ি। আমরা ২০ জনের দল কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে ছবি তোলা আর ঘুরে দেখতে থাকি। আসার সঙ্গী একই কলেজের অনুজ জামাল উদ্দিন রাজু। পুরো চত্বরে কয়েকটি স্যুভেনির অস্তিত্ব পাওয়া গেল। আছে রেস্টুরেন্ট, কফিশপ, ম্যাগডোন্ডালসের মতো দোকানও। ভেতরের দোকানে দাম একটু চড়া বলে কিছু না কেনার পরামর্শ দিলেন সুফিয়ার। গাইডের এ পরামর্শ সবাই মেনে নিই। অলিম্পিক পার্ক চত্বর ঘুরতে কোনো ফি না লাগলেও স্টেডিয়ামে প্রবেশ ফি ৬০ ইউয়ান। তাই স্টেডিয়ামমুখী পর্যটকদের লাইন খুব দীর্ঘ নয়। আমরাও স্টেডিয়ামের বাইরে পার্কের সৌন্দর্য উপভোগ করেই কাটিয়ে দিলাম পুরোটা সময়। প্রবেশ গেটের বাইরে পাওয়া গেল বেশ বড় এক স্যুভেনির শপ। চাংসা ও বেইজিংয়ের বিভিন্ন শপিংমল ইতোমধ্যে ঘুরা হয়েছে। এখানে পণ্যের দাম তুলনামূলক কম মনে হওয়ায় দলের সবাই হুমড়ি হয়ে পড়ে কেনাকাটায়। সবাই কিছু না কিছু কেনেন তখন। দিন শেষে হিসাব কষে দেখা হলো শায়লা ম্যাডামই সেরা ক্রেতা। (চলবে)

মিনহাজুল ইসলাম জায়েদ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০