বেকারত্ব, হতাশা ও মানহীন শিক্ষা

মো. জিল্লুর রহমান: বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের মধ্যে একটা বড় অংশই এখন বেকার। পড়াশোনা শেষ করে তারা বছরের পর বছর চাকরির জন্য অপেক্ষা করছে, কিন্তু কাক্সিক্ষত কর্মসংস্থানে যুক্ত হতে পারছে না। ফলে তারা চরম হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে। অতিসম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের (স্নাতক পাশ) সংখ্যা ছিল প্রায় আট লাখ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ডিগ্রিধারী উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারের হার এখন ১২ শতাংশ। ২০১৬-১৭ সালে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের এ হার ছিল ১১ দশমিক ২ শতাংশ, অর্থাৎ আগের তুলনায় বর্তমানে দেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেড়েছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ত্রৈমাসিক এপ্রিল-জুন ২০২৩ শ্রমশক্তি জরিপ বলছে, দেশে শ্রমশক্তিতে সাত কোটি ৩২ লাখ ৯০ হাজার মানুষ নিয়োজিত আছে এবং এর মধ্যে কর্মে নিয়োজিত আছে সাত কোটি সাত লাখ ১০ হাজার মানুষ। কর্মজীবী মানুষের মধ্যে চার কোটি ৬৫ লাখ ২০ হাজার পুরুষ এবং দুই কোটি ৪১ লাখ ৯০ হাজার নারী। তবে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে আগের প্রান্তিকের চেয়ে বেকারের হার ৩ দশমিক ৪১ শতাংশ কমেছে এবং এর আগের প্রান্তিকে এই হার ছিল ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। বিবিএস বলছে, এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে সব মিলিয়ে দেশে ২৫ লাখ মানুষ বেকার ছিল এবং বেকারদের মধ্যে ১৬ লাখ ৭০ হাজার পুরুষ ও আট লাখ ৩০ হাজার নারী। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা অনুযায়ী, টানা ৩০ দিন ধরে ১৫ বছরের বেশি বয়সী কাজপ্রত্যাশী একজন মানুষ যদি সর্বশেষ সাত দিনে মজুরির বিনিময়ে এক ঘণ্টাও কাজ করার সুযোগ না পান, তাহলে তাকে বেকার হিসেবে গণ্য করা হয়।

গত বছর একজন তরুণ ‘ভাতের বিনিময়ে পড়ানোর বিজ্ঞাপন’ দেয়ার পর করোনা মহামারিতে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি কতটা সংকট তৈরি করেছিল, তার একটা করুণ চিত্র হিসেবে এটা সামনে এসেছিল। আসলে বেকারত্ব আর হতাশা যে কত বড় সংকট তৈরি করতে পারে, সেটা উঠেছিল ওই তরুণের ‘ভাতের বিনিময়ে পড়ানোর বিজ্ঞাপনে’। আসলে আমাদের দেশে পড়াশোনা শেষ করতেই তরুণদের ২৮ বছর বয়স পার হয়ে যায়। সরকারি চাকরির বয়স ৩০ বছরের মধ্যে দু-একটি বিসিএস আর ২০-২৫টির মতো সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করা যায়। কিন্তু মহামারির মধ্যে চাকরির পরীক্ষা বন্ধ থাকা আর বয়স শেষ হওয়ার দুশ্চিন্তা বেকারদের চরম হতাশাগ্রস্ত করে তোলে। করোনা-পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও একই দিনে চার-পাঁচটি চাকরির লিখিত পরীক্ষার তারিখ নির্ধারিত হয় এবং সকাল-বিকাল তারা দুটি পরীক্ষায় অংশ নেয়। এর মধ্যে অবশ্য প্রায়ই দু-একটি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ আসে। সব মিলিয়ে বেকারত্বের এই করুণ দশা তাদের চরম হতাশায় নিমজ্জিত করে। চাকরিপ্রত্যাশী তরুণদের মতে, বয়সের সীমাবদ্ধতার কারণে তারা যে আশা নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল, সেটা সম্ভব হচ্ছে না। তারা যে সামনে পড়াশোনা করবে, এটা হয়নি তো অন্যটা হবে এরকমও হচ্ছে না। কারণ একসঙ্গে একাধিক পরীক্ষা, তারপরে আবার দুর্নীতির কারণে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। এসব কারণে অনেক তরুণ-তরুণী হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যার পথও বেছে নিয়েছিল বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছিল।

বিবিএসের উপরোক্ত জরিপের তথ্যমতে, ২০২২ সালের উচ্চশিক্ষিত বেকারদের মধ্যে প্রায় ১৯ শতাংশ নারী ছিল এবং অশিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার তুলনামূলকভাবে কম। তাছাড়া মাধ্যমিক পাস করা ব্যক্তিদের মধ্যে ২ দশমিক ৮২ শতাংশ বেকার এবং উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা ব্যক্তিদের মধ্যে বেকার ৪ দশমিক ৯৪ শতাংশ। সব মিলিয়ে ২০২২ সালে দেশে বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, যুবকদের মধ্যে বেকারের হার সবচেয়ে বেশি, এ সংখ্যা ১৬ লাখ ৮৯ হাজার। এছাড়া যাদের বয়স ২৫-৩৪ বছর তাদের মধ্যে বেকার ছয় লাখ ২৫ হাজার এবং যাদের বয়স ৩৫ বা এর ওপরে তাদের মধ্যে বেকার দুই লাখ ৬৮ হাজার জন। ২০২২ সালের হিসাবে যারা বেকার ছিল, তাদের মধ্যে এক লাখ ৫৩ হাজারের কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্নকারী বেকার হলো তিন লাখ ২২ হাজার। মাধ্যমিক স্তর পাস করা বেকার সাত লাখ ৩৯ হাজার। উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পাশ করা পাঁচ লাখ ৩৬ হাজার, বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা সাত লাখ ৩৯ হাজার এবং অন্যকোনো মাধ্যমে শিক্ষা নিয়েছে শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ বেকার।

আন্তর্জাতিক  শ্রম সংস্থার আঞ্চলিক কর্মসংস্থান নিয়ে ‘এশিয়া-প্যাসিফিক এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক, ২০১৮’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি পাকিস্তানে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ এবং  বাংলাদেশে এ হার ১০ দশমিক ৭ শতাংশ, যা এ অঞ্চলের ২৮টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। বেকারত্বের হারে ভারত এ অঞ্চলে তৃতীয় (৮ দশমিক ৪ শতাংশ), শ্রীলংকা চতুর্থ (৭ দশমিক ৯ শতাংশ), ব্রুনেই পঞ্চম (৭ দশমিক ৫ শতাংশ), ফিলিপাইন ষষ্ঠ (৭ দশমিক ৫ শতাংশ) ও ইরান সপ্তম (৭ দশমিক ৪ শতাংশ)। এতে ২০০০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলের ২৮টি দেশের বেকারত্ব, তরুণদের কর্মসংস্থান, নিষ্ক্রিয় তরুণের হার, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান, কর্মসন্তুষ্টি প্রভৃতির তুলনামূলক চিত্র উঠে এসেছে। এতে আরও বলা হয়, উচ্চশিক্ষা এখন আর কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। তরুণরা যত বেশি পড়ালেখা করছেন, তাদের তত বেশি বেকার থাকার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এ প্রতিবেদনে বাংলাদেশে শিক্ষাগত যোগ্যতার কোন পর্যায়ে বেকারত্বের হার কত, তাও তুলে ধরা হয়েছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর পার হয়নি, এমন মানুষের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে কম (১.৮ শতাংশ)। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করা মানুষের মধ্যে বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। যারা মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষিত, তাদের মধ্যে বেকার সাড়ে আট শতাংশ এবং উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকার ১০ দশমিক ৭ শতাংশ।

আইএলওর ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে দেড় যুগ আগে ২০০০ সালে সার্বিক বেকারত্বের হার ছিল ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১০ সালে তা ৩ দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়ায়। ২০১৩, ২০১৬ ও ২০১৭ সালের হিসাবে এই হার একই থাকে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। বাংলাদেশে পুরুষের ক্ষেত্রে বেকারত্ব ৩ দশমিক ৩ শতাংশ ও নারীর ক্ষেত্রে ১২ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব ২০১০ সালের তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে ২০১৭ সালে ১২ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের তরুণদের বড় অংশ আবার নিষ্ক্রিয়। তারা কোনো ধরনের শিক্ষায় যুক্ত নন, প্রশিক্ষণ নিচ্ছে না, আবার কাজও খুঁজছে না। দেশে এমন তরুণের হার ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ এবং মেয়েদের মধ্যে এই হার বেশি, প্রায় ৪৫ শতাংশ।

বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে বলেছেন, মানহীন শিক্ষায় দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকার বাড়ছে এবং পত্র-পত্রিকা খুললেই দেখা যায় অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রির নামে সার্টিফিকেট বিতরণ করছে, গুদাম থেকে মাল বের করার মতো গ্র্যাজুয়েট তৈরির কারখানা খুলে বসেছে। তিনি বলেন, যারা ব্যবসা করতে চান বাংলাদেশে অনেক সম্ভাবনার খাত রয়েছে, সেখানে গিয়ে ব্যবসায় করতে পারেন। কিন্তু শিক্ষাকে নিয়ে ব্যবসা করার মন-মানসিকতা পরিহার করা সবার জন্য মঙ্গলজনক। তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীরা কতটুকু শিখল বা কর্মসংস্থানের জন্য কতটুকু যোগ্যতা অর্জন করল তার কোনো বালাই নেই। ফলে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।

আসলে দুঃখজনক হলেও সত্য শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা বাংলাদেশের জন্য অন্যতম বড় একটি চ্যালেঞ্জ। জাতির উন্নয়ন, উন্নত সমাজ গঠন ও বিশ্বমানের গ্র্যাজুয়েট তৈরির লক্ষ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুণগত মান, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। গুণগত মান ছাড়া উচ্চশিক্ষা মূল্যহীন। তাই উচ্চশিক্ষা যাতে কোনোভাবেই সার্টিফিকেট-সর্বস্ব না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার নামে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত না করার নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, দেশে বর্তমানে শতাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। শিক্ষা বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা বিস্তারে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকারীদের এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তাদের এ উদ্যোগের ফলে আমাদের তরুণ শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিষয়ে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। তবে আমরা চাই না যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দাতব্য প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিচালিত হোক। আবার এটাও চাই না যে শিক্ষাকে পণ্য বিবেচনা করে শিক্ষার নামে বিশ্ববিদ্যালয়কে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করুক। সব বাবা-মা ও অভিভাবক অনেক কষ্ট করেন। এমনকি শেষ সহায়সম্বল দিয়ে ছেলেমেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান, যাতে তারা ভবিষ্যতে ভালো থাকতে পারে। তাদের সন্তানেরা যাতে সম্মানের সঙ্গে ও অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হয়ে বাঁচতে পারে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়।

আজকের তরুণরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ ও কাণ্ডারি। তারা নানা স্বপ্নের জাল বুনে, লেখাপড়া করে কাক্সিক্ষত কিছু অর্জন করতে চায়, পৃথিবীকে আলোকিত করতে চায়। অধিকাংশই লেখাপড়া শেষ করে একটি ভালো কর্মসংস্থান, পরিবারের জন্য কিছু করার তাগিদ, অনেকে প্রিয়জনকে জীবনসঙ্গী করে একটি সুন্দর সংসারের জাল বোনে এবং এগুলোর যেকোনো একটিতে কোন ছেদ পড়লে সে চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয়, নিজেকে ব্যর্থ মনে করে এবং জীবনকে মূল্যহীন মনে হয়। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, কভিড-পরবর্তী সময়ে বেকারত্ব সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। লাখ লাখ তরুণ-তরুণী কোনো কাক্সিক্ষত কর্মসংস্থান খুঁজে পাচ্ছে না, এ কারণে তাদের মধ্যে হতাশা চরমভাবে আঁকড়ে ধরছে। ফলে তারা পৃথিবীর সবচেয়ে অপছন্দনীয় ও নিকৃষ্টতর আত্মহত্যা কাজটিই বেছে নিচ্ছে। এর থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে এবং এজন্য আমাদের গুণগত শিক্ষার পাশাপাশি কর্মমুখী শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই তরুণদের মধ্য থেকে বেকারত্বের হতাশা দূর হবে এবং আমরাও জাতি হিসেবে সমৃদ্ধ হব।

ব্যাংকার ও কলাম লেখক

zrbbbp@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০