পূর্বের প্রকাশের পর…..
শেয়ারবাজারে কিছু মুহূর্তে চোখ বুজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন আপনি। কখনও কখনও আবার চোখ-কান খোলা না রাখলে সমূহ বিপদ। কখন চোখ বন্ধ রাখবেন, আর কখন খোলা রাখবেন সে বিষয়ে কিছু উপদেশ ঝেড়েছি। আর এ আলোচনায় বিনিয়োগকারীর সাইকোলজি সম্পর্কে বাক্যালাপ অবধারিত। একজন বিনিয়োগকারীর সবচেয়ে বড় শত্রু হলো তার মেজাজ ও মগজ। কথাটি বর্তমান সময়ে আরও বেশি প্রযোজ্য। মন্দা বাজারে রক্ষণশীল ভাব ধরে নিষ্ক্রিয় হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন, তা হবে না। বিনিয়োগ করতে চাইলে ভালো-মন্দ শেয়ার কিনতেই হবে আপনাকে। গায়ে লাগাতেই হবে মন্দা বাজারের উত্তাপ। আমার বিশ্বাস, কারও যদি মোটামুটি চলনসই জ্ঞান-বুদ্ধি থাকে, তিনি যদি আমার কথাগুলো আত্মস্থ করতে সমর্থ হন কাজে আসবে বইটি। সফল বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপযুক্ত মানসিকতা গড়ে তুলতে পারবেন পাঠকরা। আমি কিন্তু বহু সাধারণ বিনিয়োগকারীকে ওয়ালস্ট্রিটে দেখেছি, যারা ফাইন্যান্স, অ্যাকাউন্টিং ও স্টক মার্কেটের ওপর বিশাল ডিগ্রিধারীদের চেয়ে ভালো করেছেন।
পরিচালনা পর্ষদ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারছে কি না, তা দেখুন
এই গেলো বিপদচিহ্ন। এবার আসা যাক শুভলক্ষণে যেগুলো দেখলে কোম্পানিটিকে বাছাই করতে পারেন বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে। সেক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো খেয়াল রাখবেন:
১. যেসব কোম্পানির প্রতিযোগিতা সক্ষমতা (কম্পিটিটিভ অ্যাডভান্টেজ) অনেক বেশি। কম-বেশি সব কোম্পানিরই থাকে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা। তবে কিছু কোম্পানি আছে, সামান্য প্রতিযোগিতায়ই হেলে পড়ে যারা। আবার কিছু কোম্পানি আছে, যারা একের পর এক প্রতিদ্বন্দ্বীদের আক্রমণেও বাজারে এমনভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে যে, মনে হয়, এরা বুঝি অজাতশত্রু। একজন বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীর দরকার ওই রকম বিস্তৃত প্রতিযোগিতা সক্ষমতাসম্পন্ন কোম্পানি। এক্ষেত্রে কয়েকটি উপাদান বিবেচ্য। এক. শক্তিশালী ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি। মোটরসাইকেল প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান হার্লে-ডেভিডসনের কথা চিন্তা করুন। ক্রেতারা এই ব্র্যান্ডটিকে এতই পছন্দ করেন যে, বহু বাইকচালক হার্লে-ডেভিডসনের ট্যাটু বসিয়েছেন নিজ শরীরে। দুই. বাজারে যদি কোম্পানিটি মনোপলি বা নিয়ার-মনোপলি থাকে। তিন. ইকোনমিস অব স্কেল সুবিধা পায় অর্থাৎ বিপুল পরিমাণ পণ্য সস্তায় উৎপাদনের ক্ষমতা রাখে। উদাহরণ হিসেবে জিলেটের কথা বলা যায়। প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন রেজর বিক্রি করছে জিলেট। এদের মুনাফার প্রধান উৎস হচ্ছে, বিপুলসংখ্যক রেজর একসঙ্গে তৈরির মাধ্যমে উৎপাদনব্যয় হ্রাস। চার. স্বতন্ত্র ও অদৃশ্য কোনো সম্পদ। যেমন কোকা-কোলার সিক্রেট ফর্মুলা। স্থূল দৃষ্টিতে দেখুন, ওই ফর্মুলা মূল্যহীন। অথচ এই অদৃশ্য ফর্মুলাই কিন্তু কোক-কে পরিণত করেছে কোটি কোটি মানুষের আকর্ষণের বস্তুতে। পাঁচ. কোম্পানিটি যদি সহজে প্রতিস্থাপনযোগ্য না হয় বা প্রতিস্থাপনের অযোগ্য হয়। যেমনÑনিউইয়র্ক মহানগরে যারা বিদ্যুৎ সরবরাহ করে, খাতটি থেকে সহজে তাদের বের করে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
২. যেসব কোম্পানি ম্যারাথনার, স্প্রিন্টার নয়: এটা বোঝার উপায় নিহিত কোম্পানির আর্থিক বিবৃতিতে উল্লিখিত নেট আর্নিংয়ে। খেয়াল করুন, উদ্দিষ্ট কোম্পানির নেট আর্নিং মসৃণ ও স্থিতিশীলভাবে বেড়েছে কিনা, নাকি হুট করে জ্বলেই নিভে গেছে। এ নিয়ে একবার বিস্তারিত গবেষণা প্রতিবেদন ছাপায় ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালিস্ট জার্নাল। আর বহু ভুক্তভোগী বিনিয়োগকারী একই বিষয় অনুভব করেছেন ও করছেন বিনিয়োগ করার পর। দ্রুত বর্ধনশীল কোম্পানিগুলো সাধারণত দ্রুতই প্রতিযোগিতার বাজারে পিছু হটে। ফলে এসব কোম্পানি পরিত্যাজ্য। তার বদলে ওসব কোম্পানি খুঁজুন, যাদের দীর্ঘমেয়াদি প্রাক-কর (প্রি-ট্যাক্স) আর্নিং গ্রোথ ১০ শতাংশ। কর-পরবর্তী (আফটার-ট্যাক্স) আয় প্রবৃদ্ধি ৬ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে থাকলেও চলবে। এই প্রবৃদ্ধি টেকসই হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আবার ১৫ শতাংশ আয় প্রবৃদ্ধি কিন্তু বিভ্রান্তিকর। ফলে যেসব কোম্পানি ১৫ শতাংশ আয় প্রবৃদ্ধি টার্গেট করেছে, তাদেরও বাদ দিন তালিকা থেকে। কেননা এরা পুরো ম্যারাথন দৌড়টাই দৌড়াতে চায় ১০০ মিটার স্প্রিন্টারের মতো। তার মানে এগুলো প্রতিযোগিতা-জ্ঞান বিবর্জিত।
৩. যেসব কোম্পানির উদ্ভাবনের প্রতি ঝোঁক আছে: একটি কোম্পানির পণ্য বা সেবার মান যতই ভালো হোক ও কোম্পানির ব্র্যান্ড ভ্যালু যতই শক্তিশালী হোক, আয়-মুনাফা-প্রবৃদ্ধি অক্ষুন্ন রাখতে ব্যবসা সম্প্রসারণে দৃষ্টি দিতেই হবে তাকে। এক্ষেত্রে অন্যতম কৌশল হলো রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আরএনডি)। আরএনডি-কে ফালতু ব্যয় ধরে নিয়ে ওই পথ মাড়ান না অনেকে। অথচ আরএনডি যদি এ মুহূর্তের আয় উৎস নাও হয়, আগামীর জন্য এটা অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। প্রশ্ন উঠতে পারে, সেক্ষেত্রে কেমন হবে আরএনডি বাজেট? এর কোনো গৎবাঁধা নিয়ম নেই। সংখ্যাটি সম্পূর্ণভাবে কোম্পানির আর্থিক অবস্থান ও উচ্চাভিলাষের ওপর নির্ভরশীল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০০২ সালে নিট সেলের ৪ শতাংশ আরএনডি-তে ব্যয় করেছিল প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল; যেখানে একই বছর জনসন অ্যান্ড জনসন খরচ করে আনুমানিক ১১ শতাংশ।
ব্যবস্থাপনার মান: কোনো কোম্পানির হাল অবস্থা বোঝার সহজতম উপায়, পরিচালনা পর্ষদ যেসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারছে কি না, তা দেখা। একজন সুব্যবস্থাপক কেবল যেটি করতে চান সেটিই বলবেন এবং সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করবেন পরবর্তী সময়ে। এর ব্যতিক্রম কোম্পানির অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা নির্দেশ করে। আরেকটি উপায় হচ্ছে, পূর্ববর্তী বার্ষিক প্রতিবেদনে সিইও কর্তৃক প্রাক্কলিত আয়, মুনাফা, প্রবৃদ্ধি প্রভৃতি বিদ্যমান বাস্তবতার সঙ্গে মেলানো। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রাক্কলনের কতটুকু পূরণ হয়েছে আর কী পরিমাণ ঘাটতি রয়েছে, তা বোঝা যাবে সেখান থেকে। একজন শক্ত ম্যানেজার কোনো কারণে ব্যর্থ হলে সাধারণত দায় স্বীকার করে নেন সঙ্গে সঙ্গে। একই পরিস্থিতিতে দুর্বল ম্যানেজার দোষ চাপান ‘অর্থনীতি’, ‘অনিশ্চয়তা’, ‘দুর্বল চাহিদা’ প্রভৃতি বিষয়ের ওপর। কোনো বিনিয়োগকারী যদি একই সঙ্গে বুল ও বেয়ার মার্কেট পেয়ে থাকেন, উপযুক্ত ম্যানেজার চেনা তার জন্য আরও সহজ হবে। লক্ষ করুন, উদ্দিষ্ট কোম্পানির চেয়ারম্যান বা সিইও বুল ও বেয়ার মার্কেটে যেসব আশ্বাস দিয়েছিলেন ও প্রাক্কলন করেছিলেন, সেগুলোর মধ্যে সংগতি আছে কি না। যদি বুল ও বেয়ার মার্কেটে দেওয়া বক্তব্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান মেলে, কোম্পানিটি সম্ভবত বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত নয়। আরও আছে, খতিয়ে দেখতে হবে,কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ কাজ করছে কার স্বার্থে, কোম্পানির না নিজেদের? কিছু কোম্পানি আছে পাল্লা দিয়ে দামি সিইও রাখে। স্মরণ রাখবেন, দোজ কোম্পানিজ আর বাই দ্য ম্যানেজারস, ফর দ্য ম্যানেজারস (ওই কোম্পানিগুলো ম্যানেজারদের আজ্ঞাবহ এবং ম্যানেজারদের জন্যই)।
আবার কিছু কোম্পানি দেখবেন, বিনিময় বা পুনঃইস্যুকরণের মাধ্যমে শেয়ারের পুনর্মূল্যায়ন (রিভ্যালুয়েশন) ঘটায়। সাবধান। ইনসাইডার আছে ওই কোম্পানিতে। পুনঃইস্যুকরণের মধ্য দিয়ে মূল্যহীন শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে মূল্যবান শেয়ার স্বার্থান্বেষীদের পক্ষে হস্তগত করা সম্ভব। আর কোম্পানির সিইও’র কমপক্ষে মৌন সম্মতি ছাড়া অসম্ভব এ ধরনের ইনসাইডার জব। ভালো ম্যানেজারদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য, তারা কাজ (নেপথ্য ব্যবস্থাপনা) নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত থাকেন যে, প্রচারের সুযোগই পান না সেভাবে। আরও আছে, একজন যোগ্য ও দক্ষ ম্যানেজার কোম্পানির শেয়ারকে খুব বেশি নামতেও দেবেন না, উঠতেও দেবেন না খুব একটা। আবার নজর দিন, কোম্পানির অ্যাকাউন্টিং প্র্যাকটিস (হিসাব অনুশীলন) যথেষ্ট স্বচ্ছ কি না, সেখানে জবাবদিহি নিশ্চিতকরণের সুযোগ কেমন। কোম্পানির হিসাব বইয়ে বিনিয়োগকারীদের জন্য বিভ্রান্তিকর পরিসংখ্যান প্রদর্শন কঠিন কিছু নয়। অনেক সময় একশ্রেণির কোম্পানি সুকৌশলে লুকায় কোনো বড় ধরনের লোকসান। এটা চিহ্নিত করার উপায় হলো, কোম্পানি কখনোই সাধারণ আইটেমের মধ্যে এগুলো লুকাবে না, যেখানে বিনিয়োগকারীর নজরে পড়তে পারে। ফলে আর্থিক বিবৃতির ‘তুচ্ছ’ আইটেমগুলো খেয়াল করুন, বড় কোনো পরিবর্তন আছে কি সেখানে?
আর্থিক শক্তি ও পুঁজি কাঠামো: একটি কোম্পানি আর্থিকভাবে শক্তিশালী তখনই থাকে, যখন এর ব্যয়ের চেয়ে আয় বেশি হয়; অর্থাৎ ইনপুটের চেয়ে আউটপুট থাকে লক্ষণীয়ভাবে বেশি। ভালো ম্যানেজাররা সবসময় চেষ্টা করেন কোন উপায়ে অর্থের অধিকতর উৎপাদনশীল ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। যেসব কোম্পানির আর্থিক ভিত শক্তিশালী, পুঁজিবাজারে বুল বা বেয়ার যে মার্কেটই চলুক কোম্পানির আয়, প্রবৃদ্ধি ও মুনাফা হওয়ার কথা। কোম্পানির আর্থিক শক্তি ঠিক আছে কি না, তা বোঝার সহজ উপায় আর্থিক বিবৃতির ক্যাশ ফ্লো শাখার আউট ফ্লো অংশে যাওয়া। সেখানে স্থিতিশীলভাবে শেষ ১০ বছরে অপারেশনস আয় বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থ হচ্ছে, কোম্পানি আর্থিক ও পুঁজিগত দিক থেকে শক্তিশালী। বিখ্যাত বিনিয়োগকারী ওয়ারেন বাফেট অবশ্য নিজের জন্য আলাদা একটা মানদণ্ড ঠিক করে নিয়েছেন। একে তিনি বলেন, ওনার আর্নিং (মালিকানা আয়)। যে কোনো কোম্পানির নিট মুনাফার সঙ্গে অ্যামোরটাইজেশন (অবলোপন) ও ডেপ্রিসিয়েশন (অবচয়) যোগ করে গোটা যোগফলের সঙ্গে নরমাল ক্যাপিটাল এক্সপেন্ডিচার বিয়োগ করলে যে মান পাওয়া যাবে, তা-ই ওনার আর্নিং। মানে হলো, ওই কোম্পানির শতভাগ মালিকানা যদি আপনার হাতে থাকে, তাহলে বার্ষিক কত আয় হবে আপনার? এ পদ্ধতির সুবিধাজনক দিক হলো, ক্যাশ ব্যালান্সের ওপর কোনো প্রভাব নেই অ্যামোরটাইজেশন ও ডেপ্রিসিয়েশনের। ফলে রিপোর্টের নিট মুনাফার তুলনায় কোম্পানির অভ্যন্তরীণ অবস্থা বোঝার জন্য এ পদ্ধতি অধিক কার্যকর। মৌলিক এ সমীকরণকে আরও সংশোধিত ও সমৃদ্ধ করা যায়। সেক্ষেত্রে বাফেটের সমীকরণ থেকে আরও তিনটি উপাদান বিয়োগ করুন:
এক. গ্রান্টিং (অনুমোদিত) স্টক অপশনের যে কোনো ব্যয়। উল্লেখ্য, গ্রান্টিং স্টক অপশনের মাধ্যমে কোম্পানির আয় বিদ্যমান শেয়ারহোল্ডারদের না দিয়ে সরাসরি বেসরকারি মালিকদের (ম্যানেজার) হাতে তুলে দেওয়া যায়।
দুই. যে কোনো ‘অস্বাভাবিক’, ‘নন-রিকারিং’ (যে ব্যয় বারবার করতে হয় না) কিংবা ‘অসাধারণ’ ব্যয়।
তিন. পেনশন ফান্ড থেকে আসা কোম্পানির যে কোনো আয়।
এখন শেয়ারপ্রতি ওনার আর্নিং প্রবৃদ্ধি শেষ ১০ বছরে স্থিতিশীলভাবে ৬ থেকে ৭ শতাংশ হারে বেড়ে ওঠা মানে কোম্পানিটি স্ট্যাবল ক্যাশ জেনারেটর (স্থিতিশীল অর্থ উৎপাদক) এবং এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময়।
Add Comment