বেনজামিন গ্রাহাম:দ্য ইনটেলিজেন্ট ইনভেস্টর

পূর্বের প্রকাশের পর……….

শেয়ারবাজারে কিছু মুহূর্তে চোখ বুজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন আপনি। কখনও কখনও আবার চোখ-কান খোলা না রাখলে সমূহ বিপদ। কখন চোখ বন্ধ রাখবেন, আর কখন খোলা রাখবেন সে বিষয়ে কিছু উপদেশ ঝেড়েছি। আর এ আলোচনায় বিনিয়োগকারীর সাইকোলজি সম্পর্কে বাক্যালাপ অবধারিত। একজন বিনিয়োগকারীর সবচেয়ে বড় শত্রু হলো তার মেজাজ ও মগজ। কথাটি বর্তমান সময়ে আরও বেশি প্রযোজ্য। মন্দা বাজারে রক্ষণশীল ভাব ধরে নিষ্ক্রিয় হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন, তা হবে না। বিনিয়োগ করতে চাইলে ভালো-মন্দ শেয়ার কিনতেই হবে আপনাকে। গায়ে লাগাতেই হবে মন্দা বাজারের উত্তাপ। আমার বিশ্বাস, কারও যদি মোটামুটি চলনসই জ্ঞান-বুদ্ধি থাকে, তিনি যদি আমার কথাগুলো আত্মস্থ করতে সমর্থ হন কাজে আসবে বইটি। সফল বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপযুক্ত মানসিকতা গড়ে তুলতে পারবেন পাঠকরা। আমি কিন্তু বহু সাধারণ বিনিয়োগকারীকে ওয়ালস্ট্রিটে দেখেছি, যারা ফাইন্যান্স, অ্যাকাউন্টিং ও স্টক মার্কেটের ওপর বিশাল ডিগ্রিধারীদের চেয়ে ভালো করেছেন।

 

পুঁজিবাজার স্বল্প মেয়াদের ভোটিং মেশিন আর দীর্ঘ মেয়াদের ওয়েটিং মেশিন

 

প্রথম জোড়া: সিসকো (সিআইএসসিও) ও সাইসকো (এসওয়াইএসসিও)

২০০০ সালের ২৭ মার্চ স্টক মূল্যে ৫৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করে বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান করপোরেশন হয়ে ওঠে সিসকো সিস্টেমস ইনকরপোরেশন। সে সময় সিসকোর প্রধান ব্যবসা ছিল সরাসরি ইন্টারনেট ডেটা প্রবাহিত হয়, এমন তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য তথা হার্ডওয়্যার প্রস্তুতকরণ। উল্লেখ্য, ওই ঘটনার মাত্র ১০ বছর আগে প্রথম আইপিও ছাড়ে সিসকো। সৌভাগ্যবান তারাই, ওই সময়ে সিসকোর আইপিও কিনতে পেরেছিলেন যারা। কেননা ওই ব্যক্তি যদি এক দশক পর সিসকো আইপিও’র গেইন দেখতে পেতেন, প্রথম দর্শনে তার মনে হতো উম্মাদ কেরানির টাইপ এরর। আলোচ্য গেইন ১০৩,৬৯৭ শতাংশ এবং গড় বার্ষিক রিটার্ন হচ্ছে ২১৭ শতাংশ। ২০০০ সালসহ পূর্ববর্তী চার প্রান্তিকে সিসকোর সামগ্রিক আয় ১৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন এবং শুধু শেয়ার আয় ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। তখন সিসকোর শেয়ার নিট ইনকামের ২১৯ গুণ বেশি দামে বিক্রি হয় ওয়ালস্ট্রিটে। একই সময় কোম্পানিটি অর্জন করে যে কোনো বৃহৎ মার্কিন কোম্পানির অন্যতম সর্বোচ্চ পিই রেশিও।

তার তুলনায় সাইসকো করপোরেশন অনেকটাই নিষ্প্রভ। সাইসকোর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে খাবার সরবরাহ। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজটা করে আসছে তারা। পুঁজিবাজারে ১১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার বাজারমূল্যের এ কোম্পানির অন্তর্ভুক্তি ১৯৬০’র দশকে। মজার বিষয়, ২০০০ সালসহ পূর্ববর্তী চার প্রান্তিকে সাইসকোর মোট বার্ষিক আয় হয় ১৭ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার, যা হাই-টেক সিসকোর তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি। অবশ্য সাইসকোর নিট ইনকাম ছিল কমÑমাত্র ৪৫৭ মিলিয়ন ডলার। আর এর শেয়ার বিক্রি হতো আয়ের মাত্র ২৬ গুণ বেশি দামে। সংখ্যাটি তৎকালীন গড় বাজার পিই রেশিও ৩১-এরও নিচে। এখন একজন সাধারণ বিনিয়োগকারী যখন সিসকো ও সাইসকো নিয়ে ভাববেন, তাদের মনে কী কী ভাবনার উদয় হতে পারে:

১. সিসকো সিস্টেমস…ইন্টারনেট…বিরাট ভবিষ্যৎ…অবশ্যই আকর্ষণীয়…হট সেল…আরও পাওয়া যাবে।

২. আর সাইসকো করপোরেশন…নাহ, ওটা চলবে না…স্কুলে লাঞ্চ দেয়…হাসপাতালে খাবার  দেয়…ওই কোম্পানির ভবিষ্যৎ কোথায়!

আধুনিক মনোবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠা করেছে, একজন বিনিয়োগকারীর কাছে কোন স্টকটি আকর্ষণীয় বা কোনটি আকর্ষণীয় নয়, তা নির্ধারিত হয় স্টকটির বাস্তব মূল্য নয়, মানসিক তথা আবেগীয় মূল্য দিয়ে।এ কারণে বর্জ্য অপসারণের ব্যবসা যতো নিশ্চিতভাবেই ভালো রিটার্ন দিক আপনি বিনিয়োগের জন্য তেমন আগ্রহ অনুভব করবেন না, যতোটা করবেন নতুন এক ফার্মাসিউটিক্যালস ক্যানসার নিরাময়ে (১০ শতাংশ কার্যকর) নতুন ড্রাগ আবিষ্কার করেছে শুনলে। এখন সিসকোর স্টক নিয়ে বিপত্তি হলো, যেহেতু কোম্পানিটি জায়ান্টে রূপান্তরিত হয়েছে, আগামীতে ভালো প্রবৃদ্ধি তথা রিটার্ন প্রদান সম্ভব হবে না এর পক্ষে। মার্কিন লেখক অ্যামব্রোস বিয়ার্স বলতেন, কিছু বিষয়কে দেখবেন আলাদা আলাদাভাবে বিরাট; অথচ পাশাপাশি রাখলে ক্ষুদ্র। এদিকে পুঁজিবাজারের বেলায় নিয়মটা হলো, একটি কোম্পানি জায়ান্ট হতে পারে কিংবা তার বিরাট পিই রেশিও থাকতে পারে কিন্তু একই সঙ্গে বিরাট পিই রেশিও-ওয়ালা জায়ান্ট কোম্পানির স্টক একসঙ্গে থাকা অসম্ভব।

পরিশেষে ২০০২ সালে সিসকোর স্টক হারায় তার তিন-চতুর্থাংশ মূল্য; যেখানে একই বছর সাইসকোর শেয়ারমূল্যে গেইন ৫৬ শতাংশ!

দ্বিতীয় জোড়া: ইয়াহু! ও ইয়াম!

১৯৯৯ সালের ৩০ নভেম্বর নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে ২১২ দশমিক ৭৫ ডলারে শেয়ার বিক্রি সম্পন্ন করে ইয়াহু! ইনকরপোরেশন। এটা বছরের প্রারম্ভিক শেয়ারমূল্যের তুলনায় ৭৯ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। এখানেই শেষ নয়। ৩০ নভেম্বর থেকে ৭ ডিসেম্বর মাত্র পাঁচ কার্যদিবসে ৬৩ দশমিক ৩ শতাংশ গেইন হওয়ায় ৩৪৮ ডলারে ইয়াহুর শেয়ার বিক্রি হতে থাকে ৭ ডিসেম্বর থেকে। বছরের বাকিটা সময়ও ইয়াহুর শেয়ারের দাম বাড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে। নববর্ষের আগের দিন, ৩১ ডিসেম্বর ৪৩২ দশমিক ৬৮৭ ডলারে শেষ হয় এর লেনদেন। ঝড় থামেনি পরবর্তী বছরেও। স্টক মূল্য দ্বিগুণ হয় ২০০০ সালের জানুয়ারিতেই। ফলে ৫৮ বিলিয়ন ডলার বাজারমূল্যের ইয়াহু পরিণত হয় ১১৪ বিলিয়ন ডলারের প্রতিষ্ঠানে। তখন ইয়াহুর স্টকে হাত দেওয়া যেতো না; এর শেয়ার বিক্রি হতো ৩২৬৪ গুণ বেশি দামে। প্রশ্ন, কেন এমন হু হু করে দাম বাড়লো ইয়াহুর? তার অন্যতম কারণ, ১৯৯৯ সালের ৩০ নভেম্বর এসঅ্যান্ডপি ঘোষণা দেয় ৭ ডিসেম্বর ইয়াহুর শেয়ারদর অনুযায়ী স্টকটি অন্তর্ভুক্ত হবে এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচকে। এতে অত্যাবশ্যকীয়ভাবে ইয়াহু অন্তর্ভুক্ত হয় ইনডেক্স ফান্ডগুলোয়। তার প্রভাবে ইয়াহুর শেয়ার নিয়ে চলে উম্মাদনা।

অথচ একই সময়ের ইয়াম!’র অবস্থা ছিল শোচনীয়। কোম্পানিটি আগে ছিল পেপসিকোর একটা ডিভিশন এবং এটি পরিচালনা করতো কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেন (কেএফসি), পিজ্জা হাট ও টাকো বেলের হাজার হাজার দোকান। লক্ষণীয়, ২০০০ সালসহ পূর্ববর্তী চার প্রান্তিকে ইয়াহুর আয় হয় ৪৩৩ মিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে নিট ইনকাম ৩৪ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার। ওই একই সময়ে ইয়ামের আয় হয় ৮ বিলিয়ন ও নিট ইনকাম ৬৩৩ মিলিয়ন ডলার। ইয়ামের নেট ইনকাম ইয়াহুর প্রায় ১৭ গুণ। তা সত্ত্বেও ১৯৯৯ সাল সমাপনে ইয়ামের স্টক ভ্যালু ইয়াহুর স্টক ভ্যালুর ১৯ ভাগের এক ভাগ! উল্লেখ্য, সে সময় ইয়ামের শেয়ার বিক্রি হচ্ছিল শেয়ারপ্রতি আয়ের মাত্র ৯ গুণ বেশি দামে।

মনে রাখা দরকার, পুঁজিবাজার হচ্ছে স্বল্প মেয়াদের ভোটিং মেশিন (যে যন্ত্রে দ্রব্যের গুণাগুণ নির্বাচিত হয় জনপ্রিয়তা দ্বারা) এবং দীর্ঘ মেয়াদের ওয়েটিং মেশিন (যে যন্ত্রে দ্রব্যের গুণাগুণ নির্বাচিত হয় ওজন দ্বারা)। এখানে স্বল্পমেয়াদি পপুলারিটি টেস্টে জিতেছিল ইয়াহু আর দীর্ঘমেয়াদি ওজনে জয়ী হয় ইয়াম। সেজন্যই ২০০২ সালে ইয়াহু’র ৯২ দশমিক ৪ শতাংশ পতনের বিপরীতে ২৫ দশমিক ৪ শতাংশ দাম বাড়ে ইয়ামের স্টকের।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০