বিশ্বখ্যাত কলম্বিয়া বিজনেস স্কুলের শিক্ষক বেনজামিন গ্রাহাম সম্ভবত তার সেরা ছাত্র ওয়ারেন বাফেটের তুলনায় কম পরিচিত। তবে বাফেট বলেছেন, গ্রাহাম লিখিত ‘দ্য ইনটেলিজেন্ট ইনভেস্টর’ বিনিয়োগের ওপর অতুলনীয় শ্রেষ্ঠ বই। আর গ্রাহাম বলেছেন, যেকোনো চমৎকার জিনিসই একই সঙ্গে প্রাপ্তির বেলায় বিরল ও বোঝার জন্য কঠিন। এ বই তার ব্যতিক্রম নয়। তবু কেন পড়বেন? জবাবটা গ্রাহামের মুখেই শুনুনÑ কোনো বিষয়ের দাম ও মূল্য এক নয়। দাম হলো যার বিনিময়ে আপনি কিছু কিনবেন, আর তার পরিবর্তে যা মিলবে, সেটি হলো জিনিসটির মূল্য। বেপরোয়া বিনিয়োগকারী বলে কিছু নেই বেপরোয়া ফাটকাবাজ থাকতে পারে আমার বইয়ের প্রথম কয়েকটি অধ্যায় মূলত একটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হলো, এসব অধ্যায় পড়লেই পাঠকের কাছে পরিষ্কার হবেÑঠিক কোন দৃষ্টিকোণ থেকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকে দেখছি আমি। তাতে বিনিয়োগকারীরা আভাস পাবেন, বইটি তাদের কতটুকু কাজে আসবে কিংবা তিনি যা খুঁজছেন, তা এখানে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না। সেখান থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, বইটি সংগ্রহ করবেন কি না অথবা আরও এগোবেন কি না, খানিকটা পড়া হয়ে থাকলে। যারা অনুসন্ধিৎসু পাঠক, তাদের জন্য সার্বিকভাবে প্রথম দিককার অধ্যায়গুলো হচ্ছে উপযুক্ত পোর্টফোলিও নীতি গঠনের ওপর সংক্ষেপিত বিতর্ক।
বিনিয়োগের সঙ্গে ফাটকাবাজির পার্থক্য কোথায়?
শেয়ারবাজার বিষয়ে যাদের ভালো জানা-বোঝা আছে, তারা অনেক সময় বিনিয়োগ ও ফাটকাবাজিকে গুলিয়ে ফেলেন। সেজন্য শুরুতেই আমাকে জোর দিয়ে বলতে হচ্ছে, এ বইয়ে যতবার ‘বিনিয়োগ’ শব্দটি ব্যবহƒত হয়েছে, কোনোবারই তা দিয়ে ‘ফাটকাবাজি’ বোঝানো হয়নি। প্রশ্ন তুলতে পারেন, তাহলে আমার ভাষায় বিনিয়োগ কী? ১৯৩৪ সালে আমার রচিত বইয়ের শিরোনাম ছিল ‘সিকিউরিটি অ্যানালাইসিস’। বইটি বর্তমানে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য। সেখানে বিনিয়োগকারীর সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে এভাবে, ‘একজন বিনিয়োগকারী হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি যৌক্তিক মুনাফার সম্ভাবনায় আশ্বস্ত হয়ে এবং বিস্তারিত বিশ্লেষণের মাধ্যমে যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা হাতে নিয়ে কোনো বিনিয়োগমূলক কার্যক্রমে যুক্ত হন।’ অন্যদিকে যে ধরনের বিনিয়োগমূলক কার্যক্রমে যৌক্তিক মুনাফা ও যথোচিত নিরাপত্তার বালাই থাকে না, সেটি হলো ফাটকাবাজি। বিনিয়োগকারীর ওই সংজ্ঞা লিখেছিলাম কয়েক দশক আগে। তবু এ সময়ের মধ্যে অর্থনীতি তথা বাজারে এমন কোনো মৌলিক পরিবর্তন আসেনি যে, ওই সংজ্ঞা সংশোধনের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি। অস্বীকার করা যাবে না, যে কোনো শেয়ারবাজারে ফাটকা উপাদান বিরাজমান। একটা সময় পর্যন্ত সেগুলো বিনিয়োগেরই অংশ বলে মনে করা হতো। পরে বিনিয়োগ থেকে আলাদা করা হয় ফাটকাবাজিকে। এর একটা ইতিহাস আছে। বিনিয়োগের সঙ্গে ফাটকাবাজির পার্থক্য নির্ণয়ে এখানে তা আলোচনা করা উচিত। লক্ষণীয়, বিনিয়োগের সঙ্গে ফাটকাবাজির পার্থক্য সূচিত হয় ১৯২৯-৩২ সালের ওয়ালস্ট্রিট বিপর্যয়ের
পর। ওই ধসেই মহামন্দা দেখা দেয় মার্কিন অর্থনীতিতে। অবশ্য সেটা বহিঃস্থ প্রভাব। আর ত্রিশের দশকের ওই বাজার বিপর্যয়ের অভ্যন্তরীণ প্রভাব ছিল, সে সময়টায় কার্যত ‘ফাটকা’ তকমা এঁটে যায় প্রায় সব শেয়ারের সঙ্গে। পরিস্থিতি তখন এতোটা অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে যে, এমনকি বাজারসংশ্লিষ্টরা বলতে থাকেন, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বলে কিছু নেই, সব ফাটকাবাজি। আমি মনে করি, তাদের এ ধরনের মন্তব্য করার কারণ শেয়ারবাজারের অন্তর্নিহিত গতিপ্রকৃতির প্রতি মনোযোগের অভাব। ফলে তারা যে কোম্পানির শেয়ারকেই সহায় ভাবতে চেয়েছেন, সেটি হয়ে পড়েছে অস্থিতিশীল। অবস্থাদৃষ্টে প্রথম সারির একজন অর্থনীতিবিদ তো বলেই বসলেন, বিনিয়োগ হয় বন্ডে আর শেয়ারে হয় ফাটকাবাজি। এ ফাটকাবাজি মানে নিয়ন্ত্রণের অযোগ্য, উচ্ছৃঙ্খল পয়সা ঢালা বা কামানোর কার্যক্রম। পরবর্তী সময়ে নিরাপত্তার আবরণে জড়িয়ে ফাটকাবাজিকে বিনিয়োগে রূপান্তর করা হয়। অর্থাৎ কোনো বিনিয়োগের সিদ্ধান্তে যখন ঝুঁকি হ্রাসের প্রশ্নটি অনুপস্থিত থাকে, তখন সেটি ফাটকাবাজি।
অনেকের প্রবণতা হলো, শেয়ারবাজারে যারা যান কিংবা শেয়ার কেনাবেচা করেন, তাদের প্রত্যেককে বিনিয়োগকারী ভাবেন। মোটেও তা মনে করি না আমি। শেয়ারবাজারে লেনদেনে যুক্ত সবাইকে তথা যে কাউকে বিনিয়োগকারী বলতে আমি নারাজ। তবে বিনিয়োগকে ফাটকা বলা আর ফাটকাবাজিকে বিনিয়োগ হিসেবে অভিহিত করার ব্যাপারটা এখনও চালু। একটা উদাহরণ দিই। ১৯৬২ সালের জুনে ওয়ালস্ট্রিটের একটি সাময়িকী এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করলো, ‘ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ভল্লুক জ্বরে (বিয়ারিশ ফিবার) আক্রান্ত: কিছুই কিনছেন না তারা’। সেই একই সাময়িকী আবার ১৯৭০ সালের অক্টোবরে এক সম্পাদকীয়তে বললো, ‘বাজার গিলতে উদ্যত
বেপরোয়া বিনিয়োগকারীরা!’ আমার কথা হলো, প্রথমে ডিমান্ড সাইডে থেকে পরে সাপ্লাই সাইডে গিয়ে লাভটা হলো কী, বিভ্রান্তি বাড়ানো ছাড়া? ধরুন, একজন ব্যক্তি বন্ধুবান্ধব দ্বারা
প্ররোচিত হয়ে বাজারে এসেছেন সম্প্রতি। তিনি এসেই একগাদা শেয়ার কিনলেন; আবার কয়েকটি বেচে দিলেন। কী কিনলেন আর কোনটি বেচলেন, কেন বেচলেন, সেসব বিষয়ে কোনো নিজস্ব ধারণা নেই ভদ্রলোকের; তিনি শুধু শুনেছেন, শেয়ারবাজারে লাভ করা যায়। এ ব্যক্তিকে বিনিয়োগকারী বলবেন? না বলে পারছি না, ওই বিখ্যাত সাময়িকীতে ভল্লুক জ্বরাক্রান্ত ‘বিনিয়োগকারী’দের পরিহাস করার কয়েকদিনের মধ্যে তর তর করে উঠতে শুরু করে বাজার।
আর নেতিবাচক লেখাটি ছাপা হয় বাজার সংকোচনকালে। আরেকটি বিষয়, ‘বেপরোয়া বিনিয়োগকারী’ বলে কোনো বস্তু নেই; বেপরোয়া ফাটকাবাজ থাকতে পারে। বিনিয়োগকারী বিনিয়োগকারীই; অমিতব্যয়ী কৃপণ হতে পারে না। অমিতব্যয়ীকে ‘কৃপণ’ বললে তাতে বাক্য যোগ্যতা হারায়। আমার বিশ্বাস, বিনিয়োগকারী-ফাটকাবাজ একাকার করে ফেলার এ অপকর্মটি সংবাদপত্রের ইচ্ছাকৃত নয়। ওয়ালস্ট্রিটে লাখ লাখ মানুষ যাওয়া-আসা করে প্রতিদিন। এদের প্রত্যেককে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা কঠিন। তাছাড়া সংবাদপত্রে শব্দের সীমাবদ্ধতা থাকে। এজন্য হয়তো কে বিনিয়োগকারী, কে ফাটকাবাজÑতা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে সবাইকে এক কাতারে ফেলে বলা হয় বিনিয়োগকারী। সংবাদপত্রের পাঠকরা এ ব্যবহার নিয়ে খুব একটা আপত্তি করেননি প্রধানত দুটি কারণে: এক. পুঁজিবাজার সেভাবে বোঝেন না তারা; দুই. বিনিয়োগ ও ফাটকাবাজির মধ্যকার পার্থক্য তাদেরও অজানা। ১৯৪৮ সালে ফেডারেল রিজার্ভ বুলেটিনে ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান পরিচালিত এক জরিপ প্রকাশ হয়। তাতে দেখা যায়, ৯০ শতাংশ মার্কিনির কোনো ধারণাই নেই শেয়ারবাজার বিষয়ে। সেখানে জরিপে অংশগ্রহণকারীদের সামনে প্রশ্ন রাখা হয়Ñআপনার যদি কিছু উদ্বৃত্ত অর্থ থাকে, তাহলে সেটি কোথায় বিনিয়োগ করা বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করেনÑব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাব, বন্ড, রিয়েল এস্টেট, না শেয়ারবাজারে? প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ উত্তরদাতা জানান, শেয়ারের ব্যাপারে কোনো ধারণা নেই তার। বাকিরা বলেছেন, পুরোপুরি জুয়া, শেয়ারবাজার বিনিয়োগের জন্য সম্পূর্ণ অনিরাপদ!
এবার আসি ফাটকাবাজির সঙ্গে শেয়ারবাজারের সম্পর্কে। পরিহাসের বিষয়, কোনো একটি শেয়ার যখন সম্ভাব্য সর্বোচ্চ আকর্ষণীয় দামে বিক্রি হয়, ঠিক তখনই সেটি ফাটকাবাজি বলে গণ্য হয় এবং কোনো একটি শেয়ার যখনই বিপজ্জনকভাবে নি¤œ দামের দিকে নেমে যেতে থাকে, তখন সেটির ক্রয় পরিণত হয় বিনিয়োগে। তবে আগেই বলেছি, শেয়ারের দর অস্বাভাবিকভাবে উঠুক বা নামুক, বিনিয়োগকারী যখন সেটি কেনা বা বেচায় ঝুঁকি হ্রাস তথা নিরাপত্তার ভাবনাটি মাথায় আনেন না, তখন সে সিদ্ধান্ত ফাটকাবাজি। ফলে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের দেখা উচিত বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেওয়ার বেলায় বিনিয়োগকারী নিরাপত্তা চিন্তাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন কি না। বাজারে বিনিয়োগ নিরাপত্তার ধারাবাহিক ও দ্রুত অনুপস্থিতি দুশ্চিন্তার কারণ নিঃসন্দেহে। তবে এতক্ষণ যে কথাগুলো বললাম আর যেসব উদাহরণ টেনে বিনিয়োগ ও ফাটকাবাজির মধ্যে বিভেদ ঘটালাম, সেগুলো আদর্শিক ক্ষেত্র। বাস্তবের শেয়ারবাজার অনেক বেশি জটিল। সেখানে একশ্রেণির তালিকাভুক্ত কোম্পানি মূলধনি তহবিলের সঙ্গেই একই কাতারে রাখে ফাটকা শেয়ার। ফলে এগুলো চেনা সহজ নয়। তবে আমার মনে হয়, এ বইটি আত্মস্থ হলে বিনিয়োগকারীরা যে কোনো শেয়ার দেখে আপনাআপনি বুঝতে পারবেন ওটির সঙ্গে কোন মাত্রায় কী কী ঝুঁকির ইস্যু যুক্ত। পাশাপাশি এমন উপলব্ধিও হওয়া উচিত, শেয়ারবাজারে ঝুঁকি ও সুযোগকে বিভক্তিকরণের কোনো সুযোগ নেই; এ দুটি বাজারের অবিচ্ছেদ্য উপাদান। ফলে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মনে মনে প্রথম হিসাবনিকাশ হওয়া দরকার, কেমন ঝুঁকি নিয়ে আসলে কী ফল পেতে চাইছি? পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে আরেকবার কথাগুলো ঘুরিয়ে বলি, সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত কোনো শেয়ার কোনো বাজারেই নেই। তাই এ অপেক্ষার কোনো মানে হয় না যে, অমুক শেয়ারের দাম নামতে নামতে (কোটেশনাল লস জিরো হয়ে) পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত হয়ে যাক, তখন সেটি কিনে নেবো। কেননা শেয়ারবাজারে সবসময় স্পেকুলেটিভ ফ্যাক্টর (ফাটকা উপাদান) বিদ্যমান। আর একজন বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীর কৃতিত্ব হলো, নিজ সিদ্ধান্তের ফলাফলে ওই উপাদানটির প্রভাব যথাসম্ভব দমিয়ে রাখা; অর্থাৎ নিরাপত্তা ও সম্ভাব্য প্রাপ্তির আলোকে যত কম সম্ভব অমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া। সেজন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি মানসিক ও আর্থিক প্রস্তুতি প্রয়োজন।
ইস্যুটি নিয়ে আরও কিছু কথা বলতে চাই। কারণ আমি দেখছি, আজকালকার অধিকাংশ শেয়ারে আলোচ্য ফাটকা উপাদান প্রবলভাবে উপস্থিত। লক্ষণীয়, কোনো কিছু কেয়ার না করে যে ধরনের ফাটকাবাজি করা হয়, যাকে বলে আউটরাইট স্পেকুলেশন (পুরোদস্তুর ফাটকাবাজি), সেটি কিন্তু অবৈধ বা অনৈতিক নয়। কেননা খেয়ালি সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার যে কারও আছে। তবে এটি বিনিয়োগ পোর্টফোলিও মোটাতাজাকরণের পক্ষে হানিকর। আরেকটি বিষয়ে জোর দেওয়া দরকার, চলমান বাজার পরিস্থিতিতে হয়তো কিছু ক্ষেত্রে ফাটকা সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি ও অপরিহার্য। তার কারণ, শেয়ারবাজার আসলে এক ধরনের ঝুঁকি ও সুযোগের বালিশ খেলা। এ বাজারে সাফল্যের মূল সূত্র হলো, সুযোগ নিজের হাতে রেখে ঝুঁকিগুলো বাজারে ছড়িয়ে দেওয়া। কেননা প্রকৃত অর্থে সে ঝুঁকি কমানোর ক্ষমতা একমাত্র বাজারেরই আছে; বিনিয়োগকারীর নেই। তবে প্রক্রিয়াটি সময়সাধ্য এবং তা সামগ্রিক অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। ফলে দেখা যায়, কিছু ক্ষেত্রে একশ্রেণির শেয়ার এমন পর্যায়ে উপনীত হয়, যাতে ঝুঁকি ও সুযোগ থাকে সমান সমান। সেক্ষেত্রে দু’ভাবে ফাটকাবাজি উপকারী। প্রথমত ফাটকাবাজি না থাকলে পুঁজিবাজারের বৃহৎ বিনিয়োগ ক্ষেত্র থেকে মূলধন নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের সুযোগ পাবে না অপরীক্ষিত নতুন কোম্পানি। ইদানীংকার অ্যামাজন ডটকম অথবা দূর অতীতের এডিসন ইলেকট্রিক লাইট কোম্পানি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তদুপরি এও বাস্তব, প্রাযুক্তিক উদ্ভাবনের চাকায় সবচেয়ে জুতসই লুব্রিক্যান্ট হলো দীর্ঘমেয়াদি বিরল মুনাফার আকাশ কুসুম প্রলোভন। দ্বিতীয়ত, ফাটকা সিদ্ধান্তে বাজার ঝুঁকির পরিবর্তন ঘটে। অবশ্যই ঝুঁকি দূর করে না ফাটকাবাজি। তবে শেয়ার লেনদেনে বদলায় ঝুঁকির মাত্রা, এমনকি প্রকৃতি। একজন শেয়ার ক্রেতার প্রাথমিক ঝুঁকি কোনটি? অমুক শেয়ারের দাম আরও পড়তে পারে। আর বিক্রেতার জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো, তমুক শেয়ারের দাম না আরও বেড়ে যায়। এদিকে কোনো কোনো ফাটকাবাজ বুদ্ধিমানের মতো সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। দুর্ভাগ্যবশত পুঁজিবাজারের বেশিরভাগ ফাটকাবাজই সিদ্ধান্ত নেন বোকার মতো। প্রধানত তিনভাবে ঘটে এই কাণ্ড: এক. বিনিয়োগ আর ফাটকাবাজির মধ্যকার সূক্ষ্ম ব্যবধান ধরতে না পেরে সরল বিশ্বাসে বিনিয়োগকারী যখন ভাবেন বিনিয়োগই হয়েছে, ফাটকাবাজি নয়। দুই. ভালো ফাটকাবাজির জন্য উপযুক্ত জ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োজন। তাছাড়া অধিকাংশ সফল ফাটকাবাজকে দেখেছি তারা সাধারণত ফাটকাবাজি করে থাকেন শখ হিসেবে, অলস সময়ে। ফলে ফাটকাবাজিকে কেউ সিরিয়াসলি নিলে তার ক্ষতির শঙ্কাই বেশি। তিন. সামর্থ্যরে বেশি অর্থ ফাটকাবাজিতে খাটালে।
প্রসঙ্গত, ফাটকাবাজি নিয়ে আমার কিছু নিজস্ব মনোভাব; যা অনেক বন্ধুর কাছেই রক্ষণশীল বলে মনে হয়েছে। যেমন, আমি মনে করি, যে অপেশাদার ব্যক্তিরা শেয়ারবাজারে আসেন এবং মার্জিন অ্যাকাউন্টের (এ ধরনের অ্যাকাউন্ট থাকলে ব্রোকারেজ হাউজের ঋণে শেয়ার কেনা যায়) মাধ্যমে শেয়ার লেনদেন করেন, তাদের কার্যক্রম কার্যত ফাটকাবাজি। আবার তথাকথিত ‘হট’ শেয়ার ছাড়া কিছুই কিনবেন না বাজার থেকে, এ পণ করেন যেসব বিনিয়োগকারী, তাদের আমার মোটেই ফাটকাবাজ মনে হয় না, মনে হয় জুয়াড়ি। না বললে মিথ্যা বলা হবে, জব্বর খেলা এই ফাটকাবাজি। একে আরও মজাদার মনে হবে যদি আপনি একেবারে ফ্রন্ট লাইনে থাকতে পারেন। তবে বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীর প্রতি আমার পরামর্শ থাকবে, যদি একান্তই ফাটকাবাজির আসক্তি দূর না করতে পারেন এবং ফাটকাবাজির মাধ্যমে শেয়ারবাজারে নিজ ভাগ্য যাচাইয়ের খায়েশ সর্বদা জাগরূক থাকে, অপব্যবহারযোগ্য কিছু মূলধন একেবারে আলাদা করে ফেলুন। বাজার যদি বাতাসের বেগে উপরে উঠতে থাকে, তবু ওই হিসাবে কোনো নতুন অর্থ বরাদ্দ করবেন না। ফাটকা আর গুজবনির্ভর বাজার ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী হওয়াটাই সতর্কবার্তা। আর দু’বার বাজবে না ওই অ্যালার্ম। ফলে কখনও এদিক-ওদিক করতে যাবেন না ফাটকা হিসাব থেকে বিনিয়োগ হিসাবে অর্থ কিংবা বিনিয়োগ হিসাব থেকে ফাটকা হিসাবের অর্থ। কোনো ‘ঝামেলা’ থাকলে কাজটি মনে মনেও সারতে পারেন আপনি।
Add Comment