পূর্বের প্রকাশের পর…………..
১৯২০ সালের আগেই ইংল্যান্ডের সবচেয়ে দামি কোম্পানি ছিল সাউথ সি। ওই কোম্পানির কিছু শেয়ার কিনেছিলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা চিন্তাবিদ স্যার আইজ্যাক নিউটনও। একবার আকস্মিকভাবে দরপতন শুরু হলে তিনি বেচে দেন সাউথ সি’র সব শেয়ার। বিস্মিত নিউটন শতভাগ মুনাফায় আয় করেন সাকুল্যে সাত হাজার পাউন্ড। শেয়ারের দাম কমার পরও তার কেন লাভ হলো, এটা বুঝতে না পেরে এই মহান পদার্থবিদ নাকি তার এক বন্ধুকে বলেছিলেন ‘মহাবিশ্বের সব জাগতিক বস্তুর গতি-প্রকৃতি নির্ণয় করা সম্ভব; কিন্তু শেয়ারবাজারের মন কিছুতেই নয়।’ বিপত্তি ঘটলো এর পর। হুট করে বাড়তে শুরু করলো সাউথ সি’র শেয়ারদর। তাড়াহুড়ো করে অন্যদের দেখাদেখি বেশকিছু শেয়ার কিনে
পরবর্তীতে বিক্রি করে ধরা খেলেন আনুমানিক ২০ হাজার পাউন্ড। এতে প্রচণ্ড হতাশ হন নিউটন। পুঁজিবাজারে
বিনিয়োগ করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত যদি ব্যর্থও হয়ে থাকেন, তার মানে এই নয় যে আপনি বোকা; আপনাকে
দিয়ে কিচ্ছু হবে না। এর কারণ হলো, সফল বিনিয়োগকারী হওয়ার জন্য যে মানসিক শৃঙ্খলার প্রয়োজন, তা আপনার নেই। যা ছিল না নিউটনেরও।
বুদ্ধিমান আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারীর মেজাজ বোঝা কঠিন সক্রিয় বিনিয়োগকারীর পোর্টফোলিও পরিকল্পনা।
‘এন্টারপ্রাইজ’ (উদ্যোগ) শব্দটি পাঠকদের জন্য নিশ্চয়ই কোনো নতুন শব্দ নয়। অর্থনীতিতে অবশ্য এর অর্থ খানিকটা ভিন্ন। সেই ভিন্নার্থবোধক অর্থশাস্ত্রসম্মত ‘এন্টারপ্রাইজ’ শব্দের প্রথম ব্যবহারকারী মহান ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ লর্ড জন মেনার্ড কেইনস। কেইনসের কাছে ‘এন্টারপ্রাইজে’র অর্থ ছিল বিশ্লেষণী বিনিয়োগ। আর ‘এন্ট্রাপ্রেনিউর’ (উদ্যোক্তা) হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি বিনিয়োগ করেন বুদ্ধি খাটিয়ে বিশ্লেষণপূর্বক। কথা হলো, রক্ষণাত্মক বা নিষ্ক্রিয় বিনিয়োগকারীর সূচনাবিন্দু সক্রিয় তথা আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারীরও সূচনাবিন্দু। তার মানে, উভয়কেই নিজ নিজ বিনিয়োগ পোর্টফোলিওকে বিভক্ত করতে হবে হাই-গ্রেড বন্ড ও ফার্স্ট ক্লাস কমন স্টকের মধ্যে এবং অবশ্যই অযৌক্তিক দামে কেনা যাবে না সেগুলো। তাহলে রক্ষণাত্মক ও আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারীর মধ্যে পার্থক্য কোথায়? আছে। সেজন্যই আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারীর পোর্টফোলিও পরিকল্পনা রক্ষণাত্মক বিনিয়োগকারীর পর সংযোজিত হয়েছে এ বইয়ে। লক্ষণীয়, বিনিয়োগের যে ক্ষেত্রটা রক্ষণাত্মক বিনিয়োগকারীর বিচরণভূমি, সেটিই আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারীর ভিত্তিমূল। রক্ষণাত্মক বিনিয়োগকারী নির্দিষ্ট কিছু প্রেসক্রিপশন মেনে চলবেন। আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারী নিজের বিশ্লেষণী শক্তি প্রয়োগ করে সে প্রেসক্রিপশন ছাড়িয়ে শেয়ারবাজারে বিস্তৃত করবেন তার শাখা-প্রশাখা। ফলে একই কথা যেন বারবার বলতে না হয়, সেজন্য রক্ষণাত্মক বিনিয়োগকারীর অংশটি ঠিক পূর্ববর্তী অধ্যায়ে উল্লেখ রয়েছে। আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারী অবশ্যই সেগুলো পড়বেন। তা কেবল রক্ষণাত্মক বিনিয়োগকারীদের জন্য নয়। রক্ষণাত্মক বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ বিন্যাস শৃঙ্খলায় আনা যায়; সুশৃঙ্খলভাবে পরিবেশন করা যায়। কারণ রক্ষণাত্মক বিনিয়োগকারীর চিন্তাভাবনা অনেকটাই আদর্শিক (আইডিয়াল) এবং সরলরৈখিক। আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারীর বেলায় তা করা কঠিন। কেননা তার চিন্তাভাবনা অধিক গতিশীল; চোখের সামনে পছন্দের দুয়ার খোলা রাখা আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারীর স্বভাব। আবার তিনি কেবল নিজ যোগ্যতা ও সামর্থ্যরে ভিত্তিতেই শেয়ার পছন্দ করেন না, ব্যক্তিগত আগ্রহ ও অভিরুচিও তার গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা।
আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারী চেনার নানা উপায় রয়েছে। তার মধ্যে সহজতমটি নেতিবাচক। দেখবেন একশ্রেণির বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারী একেবারে ঠাণ্ডা মাথায় করপোরেট গ্রাহকের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে হাই-গ্রেড প্রেফারড স্টক। আবার ‘বারগেইন লেভেলে’ (দরকষাকষির মাধ্যমে অভীষ্ট দামে কেনার সুযোগ) না পৌঁছা পর্যন্ত কিনছেন না প্রেফারড স্টক বা নি¤œমানের বন্ড। সাধারণত তারা ‘হাই-কুপন ইস্যু’ কেনেন কুপনটির মূল্যের ৩০ শতাংশ কম দামে কিংবা ‘লোয়ার-কুপন’ ইস্যুর বেলায় আরও কমে। ‘হাই-কুপন’ ইস্যু বুঝতে সমস্যা হচ্ছে? ওয়ালস্ট্রিটে আমরা ‘হাই-কুপন’ ইস্যু বলতে বুঝি এমন সব করপোরেট বন্ড ও প্রেফারড স্টককে, যে বন্ডগুলো বাজারের গড়পড়তা হারের চেয়ে কমপক্ষে ৮ শতাংশ সুদ দেয় এবং যে স্টকগুলো বিনিয়োগকারীকে দেয় বাজারের চেয়ে অন্তত ১০ শতাংশ বেশি ডিভিডেন্ড ইল্ড। মুনাফা ভালো, ইল্ড ভালো আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারীকে ঝুঁকি নিতে হচ্ছে না তাহলে? হচ্ছে বৈকি। খেয়াল করুন, একটি কোম্পানি কখন উচ্চ সুদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আপনার কাছ থেকে ঋণ নেবে; যখন সে যে কোনোভাবে অর্থায়ন পেতে মরিয়া। আবার কোনো কোম্পানি ঝুঁকির মধ্যে থাকার প্রাথমিক লক্ষণ এটি। সেই ঝুঁকিটাই নিতে রাজি থাকেন আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারী। এদিকে আকর্ষণীয় ইল্ডের বিদেশি বন্ড কেনায় ‘সামান্য’ আগ্রহ আছে তার। সব ধরনের নতুন ইস্যু (কনভার্টিবল বন্ড ও প্রেফারড স্টক) ক্রয়ে সতর্ক তিনি। অথচ অনেকের কাছেই কনভার্টিবল বন্ড লোভনীয়। অন্যদিকে সাম্প্রতিক অতীতে চমৎকার আর্নিং পারফরম্যান্স (আয় নৈপুণ্য) দেখানো কমন স্টকের প্রতি বহু বিনিয়োগকারীর লোলুপ দৃষ্টি থাকলেও তিনি অনেকটা নিস্পৃহ। দেখা যাছে, আমাদের বুদ্ধিমান আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারীর মেজাজমর্জি বোঝা সহজ নয়। আসলে তা-ই। রক্ষণাত্মক বিনিয়োগকারীর বন্ড বিনিয়োগ-অনুশীলন (বন্ড ইনভেস্টমেন্ট) মানসম্মত (স্ট্যান্ডার্ড)। রক্ষণাত্মক বিনিয়োগকারী কিন্তু তা অনুসরণ করতে নাও পারেন। তার হয়তো পছন্দ হচ্ছে করযুক্ত হাই-গ্রেড বন্ড; যেখান থেকে মিলবে অন্তত ৭ দশমিক ২৫ শতাংশের উচ্চ ইল্ড। কিছু আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারীকে অবশ্য দেখা যায়, তারা কিনছেন দীর্ঘমেয়াদি ৫ দশমিক ৩০ শতাংশ ইল্ডের করমুক্ত বন্ড। (গ্রাহাম ব্যবহƒত সমীকরণ অনুযায়ী, ২০০৩ সালের হিসাবে হাই-গ্রেড করপোরেট বন্ডে ৫ দশমিক ১ শতাংশ ও করমুক্ত ২০-বছর মেয়াদি মিউনিসিপ্যাল বন্ডে ইল্ড থাকতে হবে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ)।
বন্ডের মূল্য হিসাব করা হয়, শতাংশে পার ভ্যালু (উইথ ১০০)। ফলে যখন শুনবেন কোনো বন্ডের দাম ৮৫, তার মানে প্রিন্সিপাল ভ্যালুর (মুখ্য মূল্য) ৮৫ শতাংশ দামে বিক্রি হচ্ছে ওই বন্ড। আবার কোনো বন্ডের প্রকৃত মূল্য যদি হয় ১০ হাজার ডলার অথচ বিক্রি হয় ৮৫-তে, তাহলে বন্ডটি কিনতে পরিশোধ করতে হবে ৮ হাজার ৫০০ ডলার। যে বন্ড ১০০’র নিচে বিক্রি হয়, তাকে বলে ডিসকাউন্ট বন্ড; আর প্রিমিয়াম বন্ড হলো যে বন্ডের দাম ১০০’র বেশি। এখন দেখার বিষয় হলো, ফার্স্ট-রেট করপোরেট বন্ডগুলো ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ বা তারও বেশি ইল্ড দিচ্ছিল ১৯৭১ সালের শেষ দিকে। প্রশ্ন হলো, আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারীরা কেন এই সহজ মুনাফা ছেড়ে সেকেন্ড-গ্রেড বন্ড কেনায় আগ্রহী হলেন? খেয়াল করুন, একশ্রেণির করপোরেশন রয়েছে, যাদের অর্থায়ন তথা ঋণ পরিস্থিতি (ক্রেডিট স্ট্যান্ডিং) তেমন সুবিধাজনক নয়। ফলে এদের পক্ষে তখন ‘স্ট্রেইট বন্ড’ বা ‘নন-কনভার্টিবল’ (রূপান্তরের অযোগ্য) বাজারে ছাড়া প্রায় অসম্ভব অথচ অর্থায়নও দরকার। এমন পরিস্থিতিতে করপোরেশনগুলোর প্রধান কৌশল হয়ে দাঁড়ায় ‘কনভার্টিবল’ (রূপান্তরযোগ্য) বন্ড বিক্রির মাধ্যমে ঋণ অর্থায়ন। লক্ষণীয়, এ কনভার্টিবলগুলো কিন্তু ওয়ারেন্টের (হুকুম) অধীন। ফলে কোম্পানি চাইলে যে কোনো সময় বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে ‘কল’ করতে পারে সেগুলো। ভিন্ন ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত এ কোম্পানিগুলোকে তাই কনভার্টিবল বন্ড বিক্রি করতে হয় কিছুটা ছাড়ে (ডিসকাউন্ট)। আবার কিছু কোম্পানি রয়েছে, যেগুলোর রেটিং পয়েন্ট কম অথচ নন-কনভার্টিবল বন্ড ছেড়েছিল বাজারে। এসব কোম্পানি তাদের পুরোনো বন্ডগুলো বেচতে উদগ্রীব; অথচ বিশাল ছাড় না দিলে কে আগ্রহী হবে! আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারীদের জন্য এসব লুফে নেওয়ার মতো সুযোগ বটে। কেননা আগামী দিনে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে ওসব বন্ডের প্রিন্সিপাল ভ্যালুতে বড়সড় মুনাফা যোগ করা সম্ভব। এখানে আগামীর অনুকূল পরিস্থিতি বলতে আমি বুঝিয়েছি, সাধারণ সুদের হার খানিকটা কমলে ও ইস্যুকারী কোম্পানির ক্রেডিট রেটিং একটু বাড়লে।
সমস্যা হলো, মূল্য ছাড়ের আকর্ষণ ও প্রাথমিক মুনাফা বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সেকেন্ড-গ্রেড বন্ডের প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে উন্নততর বন্ডগুলো। যেমন, ১৯৭০ সালে পুরোনো ইস্যুর কুপন রেট ছিল ২ দশমিক ৫ থেকে ৪ শতাংশ পর্যন্ত। তখন প্রতি ডলার ওল্ড কুপন বিক্রি হয়েছে অর্ধেক দাম তথা ৫০ সেন্টে। কয়েকটি তথ্য দিই। একই বছর আমেরিকান টেলিফোন অ্যান্ড টেলিগ্রাফ কোম্পানির (এটিঅ্যান্ডটি) ১৯৮৬ সালে মেয়াদ শেষ হওয়ার অপেক্ষায় থাকা (ডিউ) ২ দশমিক ৬৩ শতাংশ কুপন রেটের এক ডলারের বন্ড বিক্রি হয় ৫১ সেন্টে; অ্যাটকিনসন টোপকেয়া অ্যান্ড সান্টা ফে’র কুপন রেট ছিল ৪ শতাংশ, ডিউ ১৯৯৫ সাল, বিক্রি হয় ৫১ সেন্টে; ম্যাকগ্র-হিলের কুপন রেট ছিল ৩ দশমিক ৯ শতাংশ; ডিউ ১৯৯২ সাল, বিক্রি হয় ৫০ দশমিক ৫ সেন্টে। এই বন্ডগুলো কিন্তু সেকেন্ড-গ্রেড বন্ডের তুলনায় উন্নততর এবং উৎকৃষ্ট প্রতিযোগী। সুতরাং যে আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারীরা ১৯৭১ সালের শেষভাগে সেকেন্ড-গ্রেড বন্ড ছেড়ে দিয়ে বিরাট ডিসকাউন্টে এসব বন্ড কিনেছিলেন, তারা মেয়াদকাল শেষে পেয়েছেন ভালো আয় ও মূলধনি মুনাফা (আর্নিং অ্যান্ড অ্যাপ্রিসিয়েশন)। সেকেন্ড-গ্রেড বন্ডের আরেক প্রতিদ্বন্দ্ব^ী হলো ‘রেডি বন্ড’। এদের কারও কারও ইল্ড ৮ শতাংশেরও বেশি।
লক্ষণীয়, ফার্স্ট-গ্রেড ও সেকেন্ড-গ্রেড বন্ডের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে বেশ। সাধারণত ফার্স্ট-গ্রেড বন্ডের আয় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তার সুদ চার্জকে ছাড়িয়ে যায়। সেকেন্ড-গ্রেডের বেলায় সে সময় লাগে অনেক বেশি। যেমন ১৯৬৪ সালের শুরুতে রেলওয়ে কোম্পানি শিকাগো, মিলাকোয়ে, সেন্ট পল ও প্যাসিফিকের ৫ শতাংশ ইনকাম ডিবেঞ্চার বন্ডের ইল্ড ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ অতিক্রম করে ১৯৬৮ সালে এসে। তবে সুদ পরিশোধের পর ও আয়কর দেওয়ার আগে দেখা গেলো, কার্যত ওসব শেয়ার থেকে আয় হয়েছে মাত্র দেড়গুণ। সেগুলো সেকেন্ড-গ্রেড বন্ড। কেননা আমার হিসাবমতে, মূল্যস্ফীতি ও সুদহার আমলে নিলে ওই সময়ে আয় কমপক্ষে পাঁচগুণ হওয়া উচিত ছিল। অথচ বহু বিনিয়োগকারী তখন ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ ইল্ড দেখেই বিভ্রান্ত হয়ে ঠকেছেন। এসব খুঁটিনাটি একজন আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারীর নজর এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়। তাকে মনে রাখতে হবে, হয়তো হাই-গ্রেড বন্ড থেকে প্রাপ্ত মুনাফা সন্তোষজনক নয়; তবু কেবল ইল্ড দেখেই কেনা উচিত নয় কোনো বন্ড বা প্রেফারড স্টক। কোনো শেয়ার বা বন্ড কখনোই কিনবেন না যথেষ্ট নিরাপদ মনে না হলে। এখানে ডিসকাউন্ট দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। এর সঙ্গেও বিনিয়োগের নিরাপত্তা যুক্ত। ডিসকাউন্টে বন্ড ও শেয়ার কেনার সুবিধা হলো, ক্রয়মূল্য কম থাকায় অদূর ভবিষ্যতে এর প্রিন্সিপাল ভ্যালুর ওপর মুনাফা বৃদ্ধির সম্ভাবনা উজ্জ্বল। অথচ শতভাগ মূল্য দিয়ে কেনা বন্ড শেয়ারে সে সুযোগ নেই। উপরন্তু ঝুঁকি আছে মন্দা বাজারে খোদ বিনিয়োগটিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিংবা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সুদের হার ও ডিভিডেন্ডও কমিয়ে দিতে পারে কোম্পানি।
সেকেন্ড-গ্রেড বন্ড ও প্রেফারড স্টকের দুটি অনন্য বৈশিষ্ট্য আছে, যা প্রত্যেক বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীর স্মরণ রাখা প্রয়োজন। এক. মন্দা বাজারে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দুটিই। দুই. তবে বাজার যখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে তখন মন্দা বাজারের ক্ষতি পুষিয়ে নিয়েই অধিকতর মুনাফা প্রত্যর্পণ করে সেকেন্ড-গ্রেড বন্ড ও প্রেফারড স্টক। এমনকি যেসব কুমুলেটিভ প্রেফারড স্টক আগে ভালো মুনাফা দিতে পারছিল না, তারাও দেওয়া শুরু করে লভ্যাংশ। ১৯৪৫-৪৭ সালে ওয়ালস্ট্রিটে দেখেছি, বেশকিছু সেকেন্ড-গ্রেড বন্ড ও প্রেফারড স্টক বিনিয়োগকারীদের হয় নগদ অর্থে নয়তো নতুন শেয়ার ইসু্যুর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের মুনাফা দিচ্ছে অবলীলায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, ওই ঘটনায় বহু আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারী ব্যাপকভাবে লাভবান হন, যারা পূর্ববর্তী মন্দা বাজার থেকে ওসব বন্ড ও শেয়ার কিনেছিলেন বিরাট ডিসকাউন্টে। ফলে দীর্ঘমেয়াদি ফার্স্ট ক্লাস স্টকের চেয়ে প্রেফারড স্টক কেনা ভালো কিছু কিছু ক্ষেত্রে। অবশ্য এখানে মূলত দুই ধরনের বিপত্তির শিকার হতে পারেন আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারী। প্রথমটি হলো, হয়তো দেখা গেলো তিনি যে সম্ভাবনা চিহ্নিত করেছেন, অন্যরা হয়তো তার আগে কিংবা একই সঙ্গে চিহ্নিত করলেন সম্ভাবনাটি। সেক্ষেত্রে ক্রেতার সংখ্যা বাড়ায় ১০০’র নিচে বন্ড কেনা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে তার পক্ষে। দ্বিতীয় বিপত্তি হচ্ছে, যদি ১০০’র নিচে পানও, কাক্সিক্ষত ফল পেতে তার বিনিয়োগ সামর্থ্য অনুযায়ী কী পরিমাণ তিনি বিনিয়োগ করতে পারবেন সেখানে?
চলতি সংস্করণে বিদেশি বন্ড অংশ সংযোজন করার একটি কারণ, একজন আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারীর কাছে এও এক গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ ক্ষেত্র। দুই নম্বর কারণ, আমার সংক্ষিপ্ত অভিজ্ঞতায় বিদেশি বন্ডে বিনিয়োগ নিয়ে দুশ্চিন্তার যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। মানুষের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি আর্থিক বাজার বিশেষত বিদেশি বন্ডের ওপর মারাত্মক কুপ্রভাব ফেলেছিল প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তারপর বিদেশি বন্ডের প্রতি মানুষের আকর্ষণ হ্রাস পায় ত্রিশের মহামন্দায়। সেখান থেকে বিদেশি বন্ডের অবস্থান বর্তমানে কিছুটা অনুকূলে বটে। তবু বিনিয়োগকারীরা এমনকি সবচেয়ে ভালো বিদেশি বন্ড বিক্রয়কারী দেশ : যেমন অস্ট্রেলিয়া ও নরওয়ের বিক্রীত বন্ডের দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা না করে পারেন না। আসলে এক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হলো, বন্ডের নিরাপত্তা। ইউএস ট্রেজারি বন্ড নিয়ে শঙ্কা নেই। খেলাপি হলে গ্যারান্টার মার্কিন সরকার পরিশোধ করবে মূল্য। কিন্তু বিদেশি বন্ড যদি কোনো কারণে খেলাপি হয়ে যায় এমন কোনো আন্তর্জাতিক আইন বা অন্য কোনো কাঠামো নেই যে, তার মূল্য তুলে নেওয়া যাবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৫৩ সালে যেসব মার্কিন বিনিয়োগকারী সাড়ে ৪ শতাংশ মুনাফার আশায় ১ ডলার মূল্যের রিপাবলিক অব কিউবার বন্ড ১১৭ সেন্টে কিনেছিলেন, তারা তো সেই সুদ পান-ই নি, উল্টো অবস্থা বেগতিক দেখে সেই বন্ডই ২০ সেন্টে বিক্রি করতে বাধ্য হয় ১৯৬৩ সালে।
কোম্পানি নতুন নতুন শেয়ার বাজারে ছাড়বে আর আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারী তা জানতেও পারবেন না, এ হয় না। এটি প্রায় সব সক্রিয় বিনিয়োগকারীরই আগ্রহের বস্তু। তবু নতুন ইস্যুতে (শেয়ার) বিনিয়োগের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো মন্তব্য করতে চাই না আমি। কেননা নতুন ইস্যু যে কোনো গুণসম্পন্ন এবং যে কোনো মাত্রার আকর্ষণীয় হতে পারে। ফলে একে কোনো সীমাবদ্ধ নিয়মের আওতায় আনা কঠিন। নতুন ইস্যুর গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে যা-ই বলবো, দেখবেন তার ব্যতিক্রমটিও বেরিয়ে এসেছে সঙ্গে সঙ্গে। অবশ্য এ পরামর্শ দিতে কোনোই বাধা নেই যে, পুরোনো শেয়ারের চেয়ে নতুন শেয়ার কেনার সময় বাড়তি সতর্কতা কাম্য। ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই না করে কোনোক্রমেই কিনবেন না নতুন ইস্যু। পাশাপাশি ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’ ও ‘যাচাই-বাছাই’ শব্দের প্রয়োগ অতিরঞ্জিত, আমি জানি। তারপরও পুনরাবৃত্তি করলাম শুধু সতর্কতার ওপর জোর দিতে। লক্ষ করুন, নতুন ইস্যু নিয়ে ভাবনার দুটি প্রধান কারণ রয়েছে। প্রথমত, কোনো কোম্পানি নতুন ইস্যু বাজারে আনার আগে বিপণনে জোর দেবেই। তার মানে সেলসম্যানশিপ কৌশলের ওপর বেশি গুরুত্ব দেবে তারা। কেননা দাম যত বাড়িয়ে বিক্রি করা যায়, কোম্পানির জন্য ততই লাভ। আর কোম্পানির এই ফাটকা লাভের ফাঁদে আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারী যেন না পড়েন, সেজন্য সজাগ থাকা দরকার। লক্ষণীয়, কমন স্টকের নতুন ইস্যু বিক্রি হয় ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিংয়ের (আইপিও) মাধ্যমে। এর আন্ডাররাইটিং কমিশন থাকে। তার মানে এর বিল্ট-ইন কমিশনটি পায় আন্ডাররাইটার প্রতিষ্ঠান। ওয়ালস্ট্রিটে এই সংখ্যাটি কম নয় আনুমানিক ৭ শতাংশ। শেয়ার বিক্রির আরেকটি কমিশন হচ্ছে বায়ারস কমিশন। এর পরিমাণ ৪ শতাংশের নিচে এবং তা কমন স্টকের পুরোনো ইস্যু বিক্রির বেলায় প্রযোজ্য। এক গবেষণায় দেখা গেছে, পুরোনো ইস্যুর চেয়ে নতুন ইস্যুতে দ্বিগুণ লাভ করে থাকে ওয়ালস্ট্রিট। দ্বিতীয়ত, সিংহভাগ কোম্পানি নতুন ইস্যু বিক্রি করে বাজার অনুকূলে থাকাকালে। এতে মুনাফার পরিমাণ বাড়ে বিক্রেতার, ক্রেতার নয়। ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর ফাইন্যান্স বিভাগের প্রফেসর ওয়েন লেমন্ট ও ইউনিভার্সিটি অব নটর ডেমের প্রফেসর পল শুলজ দেখিয়েছেন, কোম্পানিগুলোর জন্য সবচেয়ে লাভজনক হলো বাজার তুঙ্গে থাকার সময় নতুন ইস্যু ছাড়া।
সাধারণত দু’ভাবে সংঘটিত হয় কমন স্টকে অর্থায়ন। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কিছু কোম্পানি অতিরিক্ত শেয়ার ছাড়তে পারে তাদের বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের জন্য। সেখানে তাদের জন্য নতুন ইস্যুর মূল্য ধরা হয় চলতি বাজারের নিচে এবং বিদ্যমান বিনিয়োগকারী সেটি সাবস্ক্রাইব করুন না করুন, তার ওই অধিকারের (রাইটস) বিপরীতে একটা আর্থিক মূল্য ধরে রাখে কোম্পানি। আর এভাবেই ইস্যু হয় রাইট শেয়ার। প্রায় সর্বদা নতুন ইস্যু আন্ডাররাইট করে দেয় এক বা একাধিক ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিং হাউজ। আর সাধারণভাবে এটা ধরে নেওয়া হয় যে, সাবস্ক্রিপশন রাইটস-ধারী স্টকহোল্ডাররাই এগুলো কিনবেন। ফলে নতুন ইস্যু বিক্রিতে কোম্পানির যেমন বিপণন প্রচেষ্টা থাকে রাইট শেয়ার ইস্যুর বেলায় তেমনটি নেই বললে চলে। এটি রাইট শেয়ারকে দেখার কোম্পানিসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি। এর বিনিয়োগকারীসুলভ দৃষ্টিকোণটি হলো, কোম্পানির আকার-আয়তন বৃদ্ধি পেয়েছে বলে এখন বিনিয়োগকারীকে বাড়তি কিছু পয়সা খরচ করে কোম্পানিতে তার আনুপাতিক মুনাফা স্বার্থ (প্রপোরশনাল ইন্টারেস্ট অব প্রফিট) ঠিক রাখতে হবে। একে ইতিবাচক বা নেতিবাচক আখ্যা দিচ্ছি না। তবে ইউরোপে এ ধরনের পদ্ধতির অনুশীলন বেশ জনপ্রিয়। কমন স্টক অর্থায়নের আরেক উপায়, আগের প্রাইভেট কোম্পানিকে পাবলিক কমন স্টকের আওতায় আনা। এক্ষেত্রেও কোম্পানি স্টক বিক্রিতে আগ্রহ দেখার বাজার অনুকূলে থাকার সময়। প্রধানত অর্থায়ন উৎসের বৈচিত্র্য আনয়নই এর উদ্দেশ্য। উল্লেখ্য, নতুনভাবে অর্থায়নের প্রয়োজন হলে কোম্পানিগুলো সাধারণত প্রেফারড স্টক বিক্রির মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে। পাবলিক কমন স্টকে যাওয়া মানে ওই কোম্পানিটি অর্থায়নে বাড়তি বৈচিত্র্য ও নিরাপত্তা চাইছে। ঝামেলা হলো, প্রাইভেট কোম্পানি শেয়ারবাজারে প্রবেশের পর (আকার-আকৃতি অনুযায়ী) এর আচরণ অনেকাংশে নির্ধারিত হয় বাজারের অন্তর্নিহিত গতি-প্রকৃতি দ্বারা। তাই এর উত্থানপতন একই সঙ্গে বিনিয়োগকারীকে করতে পারে আনন্দিত ও হতাশ। এক্ষেত্রে বিপদ দেখা উৎপন্ন হয় মূলত দু’দিক থেকে: এক. নতুন সংগৃহীত অর্থ যেখানে ব্যবহার হবে অর্থাৎ ব্যবসায় এবং দুই. বাজারে অর্থাৎ ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য উত্তোলিত অর্থ যেখান থেকে আসবে সেখানে।
উল্লিখিত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বাজার বিপর্যয়ের সংক্ষিপ্ত পরিণতি পাঠকের সামনে তুলে ধরতে চাই। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রে যতগুলো নেতৃস্থানীয় কোম্পানি ছিল তার বড় অংশ একপর্যায়ে পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত হয় অর্থায়ন বৃদ্ধির আশায়। প্রথম সারির নামকরা কোম্পানি সব। মানুষজন মুখিয়ে থাকত সেখানে বিনিয়োগের জন্য। কিন্তু কিছুকাল পরেই এদের দশা হয় কাজীর গরুর মতো কাগজে আছে, গোয়ালে নেই। লক্ষণীয়, বাজার উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এগুলো যখনই বাজারের অতল গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হয়েছে তখনই বিনিয়োগকারীর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু থেকে সরে পড়ে বৃহৎ করপোরেশন আর তাদের স্থান দখল করে নেয় তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান। তবে বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের প্রতি আগ্রহ আবার বাড়ে এবং ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি (দুর্ভাগ্যজনকভাবে) বিনিয়োগকারীর মনে কুসংস্কার সৃষ্টি হয় বাজার যখন একটু উঠতে শুরু করেছে তখন। বুল মার্কেটের একটা শক্তি হলো এটা ডালে-চালে অর্থাৎ ছোট-বড় সব প্রতিষ্ঠানকে এক কাতারে দাঁড় করাতে পারে। ফলে বুল মার্কেটে ছোট ও বড় সব প্রতিষ্ঠানের প্রতিই কমবেশি আগ্রহ দেখান বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু বুল মার্কেট যখন তুঙ্গে থাকে তখন মানুষের একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি তীব্রভাবে গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠে। সেটি হলো, সবকিছু নিজের অধিকারে নেওয়ার বুনো আকাক্সক্ষা। দুঃখজনক যে, এর পরের ধাপই হলো পতন। লক্ষণীয়, বুল মার্কেটে বাজার দাপিয়ে বেড়িয়ে এমন কিছু প্রতিষ্ঠানকে স্বাভাবিক অবস্থায় খুঁজে পেতে হয়রান হতে হবে আপনাকে। ১০ বছর পর হয়তো অস্তিত্বও খুঁজে পাবেন না তাদের। আশা করি, এখান থেকে একটা সুন্দর চিত্র পেয়েছেন বাজারে বিপর্যয় সৃষ্টির। বুল মার্কেটে প্রথমে ভাসতে থাকে ফার্স্ট ক্লাস কমন স্টক। মূল্য কম থাকায় তা থেকে লাভবান হন বিনিয়োগকারীরা। প্রথম ক্রেতা ও বিক্রেতার এ লেনদেনের মাধ্যমে বাজার গরম হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে একে অতি-উত্তপ্ত করে তোলে একই লাভের প্রত্যাশায় ঘন ঘন ও দ্রুত শেয়ারের লেনদেন। তখন একে বিনিয়োগ বলা যায় না; সেটি পরিণত হয় বাণিজ্যে। খেয়াল করুন, ওই ঘন ঘন ও দ্রুত শেয়ার বাণিজ্যের কারণেই ত্বরিত পড়তে থাকে শেয়ারের গুণগত মান। অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, কোন পর্যায়ে বুল মার্কেট পড়ে বেয়ার মার্কেটে পর্যবসিত হবে, তা আপনার জানা আছে কি না। একটি নির্ভরযোগ্য লক্ষণ আমি জানি। সেটি হলো, যখনই দেখবেন (অপরিচিত ও অনির্ভরযোগ্য) ক্ষুদ্র কোম্পানির নতুন ইস্যুর দাম যখন (বাজারের স্বাভাবিক অবস্থার) একটি (ভালো পারফরম্যান্সের দীর্ঘ রেকর্ডযুক্ত) মধ্যম সাইজের কোম্পানির শেয়ারের চেয়ে বেশি দামে বিকোয়, তখনই বুঝবেন বিপদ আসন্ন। আমি সোজাসাপ্টা যেটা বুঝি, শেয়ারের মূল্য বিপর্যয়ের মৌলিক কারণ বিনিয়োগকারীর মনোযোগে ঘাটতি এবং শেয়ার বিক্রয়কারী সংগঠনের (সেলিং অর্গানাইজেশন) ‘লাভ হয় এমন যেকোনো কিছু বিক্রি’র প্রবণতা। তার পর যা ঘটে তা হলো, বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হন, ভালোমন্দ নির্বিচারে এড়িয়ে চলেন ছোট ও মাঝারি কোম্পানি। একটা কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়, বড় ও সুখ্যাত ব্যাংককে আমি কখনোই ওয়ালস্ট্রিটের ওই ধরনের বিপজ্জনক বাণিজ্যে অংশ নিতে দেখিনি (কেউ আদৌ করেছে বলে মনে পড়ে না) বললে চলে। সেজন্য আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারীকে যথেষ্ট বুদ্ধি করে চলতে হয়, তিনি যেন বাজে সেলসম্যানের পাল্লায় না পড়েন। নিশ্চয়ই এও তার নজর এড়ায়নি যে, শেয়ারবাজারে সেলসম্যান দু’ধরনেরই আছে উপকারী ও ক্ষতিকর।
আরও কিছু বিষয়ে ছাড়াছাড়া ভাবে বলি। একজন আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারীর আত্মহত্যার জন্য এখন পর্যন্ত যে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র আবিষ্কার হয়েছে তা হলো, কিনেই কয়েক ঘণ্টা পর শেয়ারটি বিক্রি করে দেওয়া। প্রসঙ্গত, আরেকটা বিষয় বিনিয়োগকারীরা ভুলে যান বেমালুম। ওই তাৎক্ষণিক (হট সেলিং) বাণিজ্যে আপনার কিছু লেনদেন লাভের মুখ দেখবে, কয়েকটি করবে লোকসান। কিন্তু আপনি লাভ-লোকসান যা-ই করুন, লাভ করবে ব্রোকার। তদুপরি বাজারের গতি-প্রকৃতি অগ্রাহ্য করে নিজ ইচ্ছা-অনিচ্ছায় বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা নিজের অজান্তেই কমাতে থাকেন প্রত্যাশিত মুনাফা। কারণটি গাণিতিক। দেখা যায়, কেউ যখন কোনো শেয়ার কিনতে অত্যধিক মরিয়া হয়ে ওঠে, শেষ পর্যন্ত ওই শেয়ারই সে কেনে সর্বসাম্প্রতিক বাজার মূল্যের ১০ শতাংশ বেশি দামে। এই অদৃশ্য ও অতিরিক্ত পরিশোধিত মূল্যের নামই হচ্ছে ‘মার্কেট ইমপ্যাক্ট’, ব্রোকার বা ব্রোকারেজ হাউজ যে মুনাফার একক অংশীদার। অবশ্যই কোনো ব্রোকারেজ হাউজের স্টেটমেন্টে এই আয় খুঁজে পাবেন না আপনি। কিন্তু এটা নির্মম বাস্তবতা। মনে করুন, কোনো কোম্পানিকে আপনার খুব মনে ধরেছে এবং আপনি দ্রুত সে স্টকের অন্তত এক হাজার শেয়ার কিনতে উদগ্রীব। ধরুন, আপনার এই অত্যুৎসাহ দেখে বিক্রেতা শেয়ারের মূল্য দিল ৫ সেন্ট বাড়িয়ে। এ অবস্থায় তাৎক্ষণিক লেনদেনের কারণে আপনার বাড়তি লোকসান হবে ৫০ ডলার; যার পুরোটাই যাবে ব্রোকারের পকেটে। আবার কোনো বিনিয়োগকারী যদি আতঙ্কিত হয়ে সর্বসাম্প্রতিক মূল্যের নিচেও শেয়ার বেচতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন, মার্কেট ইমপ্যাক্ট ঘটবে তখনও। অনেকে হয়তো ধারণা করছেন, কতই আর যাবে? অথচ এই মার্কেট ইমপ্যাক্ট কিন্তু শিরিষ কাগজের মতো ঘষে ঘষে আপনার সব মুনাফা নিঃশেষ করতে সক্ষম। তথ্য-উপাত্ত বলে, একবার শেয়ার কেনাবেচায় (স্বাভাবিক দর কষাকষির ক্ষমতার ভিত্তিতে) মার্কেট ইমপ্যাক্ট ঘটে ২ থেকে ৪ শতাংশ। কেউ রাউন্ড ট্রিপ মারলে অর্থাৎ শেয়ার কিনেই বেচলে বা বেচেই কিনলে মার্কেট ইমপ্যাক্ট দ্বিগুণ ৪ থেকে ৮ শতাংশ। আরেকটি বিষয়, এভাবে কিনেই বেচা বা বেচেই কেনাকে বিনিয়োগ বলে না, বলে ব্যবসা। আর বিনিয়োগ না করে শেয়ার ব্যবসায় নামলে ‘বহু পরিশ্রমের’ দীর্ঘমেয়াদি মুনাফা (ক্যাপিটাল গেইন রেটে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ কর প্রযোজ্য) পরিণত হয় সাদামাটা আয়ে (যেখানে সর্বোচ্চ ৩৮ দশমিক ৬ শতাংশ হারে কর দিতে হয়)। আর সেক্ষেত্রে এমনকি ব্রেক ইভেনে আসলে চাইলেও গেইন হতে হবে কমপক্ষে ১০ শতাংশ। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার ফাইন্যান্সের প্রফেসর ব্র্যাড বারবার ও টিয়ার্নস ওডিন একটি বৃহৎ ডিসকাউন্ট ব্রোকারেজ ফার্মের ৬৬ হাজার বিনিয়োগকারীর ১ দশমিক ৯ মিলিয়ন লেনদেন পর্যবেক্ষণপূর্বক এ মত দিয়েছেন। এ থেকে আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারীর শিক্ষা হলো, সব সময় কিছু একটা করার চেষ্টা নয় (অন্তত শেয়ারবাজারে), মাঝেমধ্যে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিকেই ভালো মুনাফা দেয় পুঁজিবাজার। আরেকটি বিষয় মনে রাখবেন, দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগকারী বলে কোনো শব্দ নেই। বিনিয়োগকারী মাত্রই দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগকারী। যিনি দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োজিত থাকতে পারেন না, তিনি বিনিয়োগকারী নন, ব্যবসায়ী।
একশ্রেণির আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারীর আরেকটি মারাত্মক ধারণাগত ভুল, আইপিও কিনেই বড়লোক হওয়া সম্ভব। উল্লেখ্য, আইপিও হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য কোনো কোম্পানির প্রথম বিক্রীত স্টক। অনেকের আফসোস, ১৯৮৬ সালে মাইক্রোসফট যখন প্রথম আইপিও বাজারে ছাড়ল তখন কয়েকটা আইপিও যদি একবার কিনে রাখতাম। নিশ্চয়ই বিরাট বিনিয়োগ হতো। কেননা সে সময় যারা মাত্র ২১০০ ডলার দিয়ে মাইক্রোসফটের আইপিও কিনেছেন ২০০৩ সালে এসে ৭ লাখ ২০ হাজার ডলারের মালিক হয়েছেন তাদের প্রত্যেকে। তবে আমি এর চেয়েও মজার গল্প শোনাতে পারি। প্রফেসর জে রিটার ও উইলিয়াম শিওয়ার্ট হিসাব করে দেখেছিলেন যে, কোনো ব্যক্তি যদি মাত্র ১ হাজার ডলার খরচ করে ১৯৬০ সালের জানুয়ারিতে ছাড়া ওয়ালস্ট্রিটের প্রতিটা কোম্পানির একটা করে আইপিও কিনতেও সমর্থ হয়ে থাকেন, ৫৩৩ এর পর ৩৩টা শূন্য বসিয়ে তার পর ডলার লিখলে যে পরিমাণ অর্থ হয়।