পূর্বের প্রকাশের পর………
১৭২০ সালের আগেই ইংল্যান্ডের সবচেয়ে দামি কোম্পানি ছিল সাউথ সি। ওই কোম্পানির কিছু শেয়ার কিনেছিলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা চিন্তাবিদ স্যার আইজ্যাক নিউটনও। একবার আকস্মিকভাবে দরপতন শুরু হলে তিনি বেচে দেন সাউথ সি’র সব শেয়ার। বিস্মিত নিউটন শতভাগ মুনাফায় আয় করেন সাকুল্যে সাত হাজার পাউন্ড। শেয়ারের দাম কমার পরও তার কেন লাভ হলো, এটা বুঝতে না পেরে এই মহান পদার্থবিদ নাকি তার এক বন্ধুকে বলেছিলেন, ‘মহাবিশ্বের সব জাগতিক বস্তুর গতি-প্রকৃতি নির্ণয় করা সম্ভব; কিন্তু শেয়ারবাজারের মন কিছুতেই নয়।’ বিপত্তি ঘটলো এর পর। হুট করে বাড়তে শুরু করলো সাউথ সি’র শেয়ারদর। তাড়াহুড়ো করে অন্যদের দেখাদেখি বেশকিছু শেয়ার কিনে পরবর্তীতে বিক্রি করে ধরা খেলেন আনুমানিক ২০ হাজার পাউন্ড। এতে প্রচণ্ড হতাশ হন নিউটন। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত যদি ব্যর্থও হয়ে থাকেন, তার মানে এই নয় যে আপনি বোকা; আপনাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। এর কারণ হলো, সফল বিনিয়োগকারী হওয়ার জন্য যে মানসিক শৃঙ্খলার প্রয়োজন, তা আপনার নেই। যা ছিল না নিউটনেরও।
বুলের চূড়া ও বেয়ার মার্কেটের তলানি দর্শন দুটোই খুব ক্ষণস্থায়ী বাজারের উত্থান-পতনে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত
একজন বিনিয়োগকারীর হাতে যখন স্বল্পমেয়াদি (সাত বছর বা এর চেয়ে কম সময়ের) হাই-গ্রেড বন্ড থাকে, বাজারের উত্থান-পতন নিয়ে খুব বেশি দুশ্চিন্তা নেই তার। কেননা উত্তাল বা পরিশ্রান্ত বাজার তার ওপর প্রভাব ফেলবে না সেভাবে। ফলে চলতি অধ্যায়ে এ নিয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। আবার ইউএস সেভিং বন্ডে যারা বিনিয়োগ করেছেন, তাদের উদ্দেশেও বেশি কিছু বলার নেই। কেননা বাজার যদি ওই বন্ডের ব্যয়মূল্যের সমান বা সামান্য বেশি ওপরে উঠে যায়, সমস্যা হবে না শীতনিদ্রায় চলে যাওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে ইউএস সেভিং বন্ডের। এদিকে বাজার আবহাওয়ার প্রায় কোনো আসরই নেই দীর্ঘমেয়াদি হাই-গ্রেড বন্ডের ওপর। ঐতিহাসিক মূল্যায়ন বলে, বাজার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দীর্ঘমেয়াদি বন্ডের মূল্য পরিবর্তনের ঘটনা অত্যন্ত বিরল। আর যদি সেই ঘটনা ঘটেও যায়, সুইং পিরিয়ড (মূল্য ওঠানামার সময়) হবে সংক্ষিপ্ত। সেজন্য এ অধ্যায়ে মূলত শেয়ার নিয়েই আলোচনা করা হবে। লক্ষণীয়, বাজারে মূল্যস্তরের ওঠানামা (সুইং পিরিয়ড অব মার্কেট) ও মূল্যস্তরের ওঠানামায় শেয়ারদরের পরিবর্তনের (প্রাইস সুইং) দিক থেকে বন্ড বাজার থেকে ব্যাপকভাবে ব্যতিক্রমী হচ্ছে পুঁজিবাজার। বন্ডবাজারে তেমন নেই উত্থান-পতন। দু-একবার যাও ঘটে, বন্ডের গুণগত পরিবর্তন সেভাবে হয় না বললেই চলে। অথচ শেয়ারের দামে ওঠানামা করতে পারে যেকোনো মুহূর্তে এবং বড় মাত্রায়। সুতরাং আমি মনে করি, একজন বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীর এসব বিষয়ে ভালোভাবে ওয়াকিবহাল থাকার পাশাপাশি উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলার সার্বক্ষণিক আর্থিক ও মানসিক প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন। তার লক্ষ্য থাকা উচিত, বাজারস্তরের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজের সুবিধাটি আদায় করে নেওয়া। অবশ্যই সব বিনিয়োগকারীই চান, তার আয়ত্তে থাকা স্টক হোল্ডিংয়ের মূল্য সময়ের সঙ্গে বেড়ে উঠুক। সেজন্য সুবিধাজনক সময়ে শেয়ার কেনা ও বিক্রিটাও তাদের কাম্য।
পুঁজিবাজারের উত্থান-পতনে একই সঙ্গে সৃষ্টি হয় প্রচুর সম্ভাবনা ও ঝুঁকি। একজন বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীর প্রাথমিক করণীয় হচ্ছে চিহ্নিতপূর্বক সম্ভাবনার সদ্ব্যবহার করা এবং ঝুঁকিগুলো এড়িয়ে চলা। রক্ষণাত্মক বা আক্রমণাত্মক যে কোনো বিনিয়োগকারীর প্রাথমিক লক্ষ্যই হচ্ছে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন। এ প্রত্যাশা ও কামনা অনিবার্য ও নিঃসন্দেহে বিধিসম্মত। সমস্যা হলো, কোনো ব্যক্তি যুক্তি-বিশ্লেষণ অগ্রাহ্য করে বেপরোয়াভাবে বাজার থেকে মুনাফা উত্তোলনে প্রয়াসী হলে সেটি হয়ে পড়ে ফাটকাবাজি। এক্ষেত্রে ফাটকাবাজি নিয়ে আমার ভাবনা প্রধানত দুটি এক. উত্তাল বাজারের উত্তাপে ও উচ্চাভিলাষের উৎসাহে বিবেচনা হারিয়ে বহু
ব্যক্তি নিয়োজিত হন ফাটকাবাজিতে; এদের দেখাদেখি কিংবা পাঁড় ফাটকাবাজের পাল্লায় পড়েও অনেকে যুক্ত হন ফাটকা কর্মকাণ্ডে। দুই. কেউ একবার ফাটকাবাজিতে মজা পেয়ে গেলে, সে প্রথমে এর প্রতি আসক্ত হয় এবং পরে তিক্ত অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও তার অভ্যাসে পরিণত হয় এটি। ফলে ফাটকাবাজি না করার জন্য যতই পরামর্শ দিই, বাজার প্রভাবে কিংবা অন্যের উসকানি পাওয়ার কারণে বাস্তবে ফাটকাবাজি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকাটা প্রায় অসম্ভব। এখন ফাটকাবাজির প্রতি ঝোঁক যাদের রয়েছে তাদের বলব, সর্বস্ব বাজি রেখে ও চোখ বুজে ফাটকাবাজি করবেন না কখনওই। একান্তই যদি ফাটকা কর্মকাণ্ড করতে হয়, তাহলে বিশেষ বরাদ্দ রাখবেন সেজন্য। আর সেই সীমিত বরাদ্দ বাড়াতে যাবেন না কোনো অবস্থাতেই। তার সঙ্গে চোখ খোলা রাখবেন যেন কল্পনার অতিরিক্ত ঝুঁকি নেওয়া হয়ে না যায়।
মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়, এমনকি ইনভেস্টমেন্ট-গ্রেড কমন স্টকও আক্রান্ত হয় বাজার আবহাওয়ার দ্বারা। আর শেয়ারবাজারের প্রকৃতি কিন্তু সরলরৈখিক নয়। এটি পেন্ডুলামের মতো। একবার মন্দার দিকে যাবে; আবার হবে চাঙা। আর এ পেন্ডুলাম সুইং থেকেই মুনাফা তুলে নিতে হবে বিনিয়োগকারীকে। কাজটি করার দুই উপায়। প্রথমত, উপযুক্ত টাইমিংয়ের দ্বারা; দ্বিতীয়ত, যথাযথ প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে। উপযুক্ত টাইমিং মানে, বাজারের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আপনি অনুভব করছেন আর কদিন পর বাজার ওপরের দিকে কিছুটা হলেও উঠতে পারে, তখনই কিছু শেয়ার কিনে রাখলেন কিংবা আগে থেকে কেনা কোনো শেয়ার ছাড়লেন না। আবার যখন আপনার মনে হবে (অবশ্যই যৌক্তিক কারণে ও বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণের ছোঁয়া থাকতে হবে এ ধারণায়), বাজার আগামী কয়েক দিন আরও বেশি নামতে পারে তখনই কিছু শেয়ার বিক্রি করলেন বা নতুন কোনো শেয়ার আর কিনলেন না। ওই দুটিই উপযুক্ত টাইমিংয়ের উদাহরণ। আর যথাযথ প্রাইসিংয়ের দৃষ্টান্ত হলো, যৌক্তিক মূল্যের কম দামে থাকা অবস্থায় কোনো শেয়ার কেনা এবং যৌক্তিক মূল্যের ওপরে উঠলে পর সেটির বিক্রয়। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সমীকরণ দিয়ে পয়েন্টটি নির্দেশ করা কঠিন। কেননা স্থান-কালভেদে এর ভিন্নতা দৃশ্যমান। আর একজন বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারী সতর্কতার সঙ্গে মৌলিক ঝুঁকিগুলো এড়িয়ে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেবেন স্বাধীনভাবে। আশা করি, বুঝতে কোনো ভুল করবেন না পাঠকরা। নিঃসন্দেহে এতক্ষণ যে কথাগুলো বলেছি, সেগুলো প্রধানত রক্ষণাত্মক বিনিয়োগকারীর জন্য প্রযোজ্য। তবে একই সঙ্গে এই ন্যূনতম প্রচেষ্টা যে কোনো বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীকে নিতে হবে হোন তিনি রক্ষণাত্মক বা আক্রমণাত্মক। বাজারের উত্থান-পতনে যে কোনো বিনিয়োগকারীকে এতটুকু কষ্ট স্বীকার করতেই হবে। তারপর এ প্রচেষ্টা ছাড়িয়ে অধিকতর বিস্তৃত ক্ষেত্রে অগ্রসর হবেন আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারী।
সেজন্য প্রথমেই বুঝতে হবে পুঁজিবাজারে কেন মূল্যস্তরের উত্থান ও পতন ঘটে। এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীর মাথার রাখা প্রয়োজন, পুঁজিবাজারের উত্থান ও পতন খুবই স্বাভাবিক। এটি সাধারণত আবর্তিত হয় চক্রাকারে। অর্থাৎ একটি বাজার ওপরে উঠে বুল মার্কেট সৃষ্টি করবে। আবার বুল মার্কেট নিচে নামতে নামতে পরিণত হবে বেয়ার মার্কেটে। ফলে বুল বা বেয়ার মার্কেট যতই দীর্ঘায়িত হোক, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যে কোনো একটি দশার (ফেজ) অবসান অবশ্যম্ভাবী। এ নিয়ে বিতর্ক নেই। ঝামেলা হলো, স্থান-কালভেদে শেয়ারবাজারের এক ফেজ থেকে অন্য ফেজে গমনের ধরনটি অদ্ভুত। তাই ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ সত্ত্বেও শতভাগ নিশ্চিত হয়ে বলার জো নেই, অমুক শেয়ারবাজারে তমুক দিন পরে এ ঊর্ধ্বগামী চক্রের (আপওয়ার্ড সাইকেল) উদ্ভব হবে কিংবা নিম্নমুখী চক্রটি (ডাউনওয়ার্ড সাইকেল) এই পড়ল বলে। এ বইয়ের প্রথম সংস্করণ চলাকালে আমি অভূতপূর্ব বুল মার্কেট দেখেছিলাম ওয়ালস্ট্রিটে। সেখানেও স্থির ধারণা নেওয়া যায়নি এখনই অমুক শেয়ার বেচার শ্রেষ্ঠ সময়। আবার ১৯২০’র দশক তো ছিল ‘দ্য গ্রেট বুল মার্কেটে’র যুগ। তখনও মূল্যস্তর অনুমানের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন ব্যর্থ হয়েছে প্রায় পুরোপুরি।
পুঁজিবাজারের মৌলিক নিয়ম বেশিতে বেচো ও কমে কেনো। কেউ যদি এ নীতিটিকে একেবারে আদর্শিক পর্যায় থেকে অনুসরণ করতে চান তাহলে কিন্তু বিপদ। কারণ, তখন কেউ যদি সর্বোচ্চ মুনাফায় কোনো শেয়ার বিক্রি করতে চান তাকে অপেক্ষা করতে হবে বুল মার্কেটের শিংয়ের (চূড়া অর্থে) দেখা পাওয়ার আগ পর্যন্ত। সমস্যা হলো, ওই চূড়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হবেন কে, কীভাবে? এদিকে কেউ যদি সর্বনি¤œ দামে শেয়ার কিনতে ইচ্ছা করেন, তাকে অপেক্ষা করতে হবে বেয়ার মার্কেট স্বর্বনিম্ন পয়েন্টে উপনীত হওয়া পর্যন্ত। আর বাস্তবতা হলো, সেক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীর বাজার থেকে বিছিন্ন হওয়ার শঙ্কা আছে। লক্ষণীয়, বুল মার্কেটের চূড়া ও বেয়ার মার্কেটের তলানি দর্শন দুটোই খুব ক্ষণস্থায়ী। এখানে উপযুক্ত টাইমিংকারীরা সৌভাগ্যের বরপুত্র বটে। ফলে প্রকৃতপক্ষে একজন বিনিয়োগকারী সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় পান একদিকে শেয়ারবাজারের ঠিক উত্থান থেকে চূড়ায় ওঠার ঠিক আগ পর্যন্ত; অন্যদিকে শেয়ারবাজার নামতে শুরু করার পর মুহূর্ত থেকে তলানিতে পৌঁছার পূর্ববিন্দু পর্যন্ত। তার মানে বাজারের এই জোয়ার-ভাটার মাঝেই নিতে হবে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত। এজন্য আবেগী-শৃঙ্খলা (ইমোশনাল ডিসিপ্লিন) একজন বিনিয়োগকারীর জন্য জরুরি। যা হোক, আরেকটু স্মৃতিচারণা হোক বাজারে মূল্যস্তরের জোয়ার-ভাটা বিষয়ে। অনেকের ভ্রান্ত ধারণা আছে, বেয়ার মার্কেটই পুঁজিবাজারের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রকৃতি; তুলনামূলকভাবে কম সময় ধরে বিরাজ করে বুল মার্কেট। এ কথা হলপ করে বলা যায় না। কেননা ১৯৯০ সালের অক্টোবর থেকে ২০০০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত টানা এক বছরে উঠছিলই ডাউ সূচক। আরও খেয়াল করার বিষয়, এ সময়ে একবারের জন্যও সূচকটি হারায়নি ২০ শতাংশের বেশি মূল্য। তাছাড়া ওই পর্যায়কালে ১০ শতাংশের বেশি মূল্য সে হারায় মাত্র তিনবার। তাছাড়া ডিভিডেন্ড বাদ দিলে এ পর্যায়ে সার্বিকভাবে শেয়ারে মোট গেইন হয় ৩৯৬ শতাংশের কাছাকাছি। ক্রানডাল, পিয়ার্স অ্যান্ড কোংয়ের মতে, এটা গত শতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় দীর্ঘতম নিরবচ্ছিন্ন বুল মার্কেট। সবচেয়ে দীর্ঘতম বুল মার্কেট কবেকার? ‘দুর্ভাগ্যবশত’ ‘দি ইনটেলিজেন্ট ইনভেস্টর’-র সিংহভাগ সংস্করণই বেরোয় বুল মার্কেট চলাকালে। এ সময়কালটা হলো ১৯৪৯ থেকে ১৯৬১ সালের বাজার বিস্ফোরণ (মার্কেট বুম)।
আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ, বুল মার্কেট যত দীর্ঘায়িত হয়, তার চেয়েও বেশি তীব্রতায় বাজারের ঝুঁকি বিষয়ে স্মৃতিভ্রংশ রোগাক্রান্ত হন বিনিয়োগকারীরা। আমি দেখেছি, কোনো বুল মার্কেট অন্তত পাঁচ বছর সময় অতিক্রম করলেই সিংহভাগ বিনিয়োগকারী দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করেন বুল মার্কেটের মৃত্যু নেই। সে সময় মার্কেট সাইকেলের প্রতি বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেন না তারা। বাল্যশিক্ষাও ভুলে যান যে, উত্থানশীল বস্তু মাত্রেরই পতন অনিবার্য। দুঃখজনক হলো, যারা বাজারের এই রূঢ় সত্যকে যত বেশি ভুলে থাকেন, তত জোরে তত নির্মমভাবে আশা ভঙ্গ হয় তাদের। আর মনে রাখবেন, বুল মার্কেটে হারানো বিনিয়োগস্মৃতির পুনরুদ্ধারের মতো বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা খুব কমই আছে। দুর্ভাগ্যবশত, বাজারশক্তির এ বহিঃপ্রকাশটাই বেয়ার মার্কেট চাঙা হওয়ার পথে বড় অন্তরায়।
বুল ও বেয়ার মার্কেটকে জীবন্ত, ব্যক্তিত্বশালী শক্তির মতো মনে হয় প্রায়ই। সেজন্য আমি এর নাম দিয়েছি মি. মার্কেট। মজার বিষয়, ওই দুই পরিস্থিতিতে বাজার উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণ করলেও স্বাভাবিক অবস্থায় শেয়ার মূল্যায়নের (স্টক প্রাইসিং) বেলায় কিন্তু মি. মার্কেট সঠিক। আসলে তখন লাখ লাখ ক্রেতা ও বিক্রেতার দরকষাকষিতে (ভ্যালুয়েশন) বাজারের মূল্যস্তর যৌক্তিক পর্যায়ে থাকে। বেশিরভাগ সময় তা-ই হয়। তবে মাঝেমধ্যে শেয়ার মূল্যায়ন করতে গিয়ে অগ্রাহ্য করার মতো ভুল করে বাজার। আরও নগণ্য ক্ষেত্রে বাজার কর্তৃক ঘটে মারাত্মক ভুল। এ ভুল মূল্যায়নের (মিস প্রাইসিং) কারণ বাই-পোলার ডিসঅর্ডার রোগ রয়েছে মি. মার্কেটের। মনোবিজ্ঞান বলে, বাই-পোলার রোগাক্রান্তরা সাধারণত চরম দুটি মানসিক অবস্থা প্রদর্শন করে; হঠাৎ হঠাৎ মারাত্মক হতাশ হয়ে ওঠে এরা, হঠাৎ হঠাৎ হয় অতি-উচ্ছ্বসিত। বিপত্তি হলো, মি. মার্কেট শেয়ারের মূল্যায়ন সঠিকভাবে করতে ব্যর্থ হয় এই ঋদ্ধত্ত ও অবসাদগ্রস্ত অবস্থায়। সেজন্য বাজারের উদ্বেলিত দশায় গুণাগুণ নির্বিচারে দ্রুত দাম বাড়ে শেয়ারের। সামান্য আনুকূল্যে থাকা স্টককে তখন বস্তুনিষ্ঠভাবে মূল্যায়ন করতে পারে না মি. মার্কেট। ফলে ঘটে শেয়ারের ওভার-প্রাইসিং বা অতিমূল্যায়ন। একইভাবে হতাশ অবস্থার খেয়ালি মন্দা বাজার অনেক ভালো শেয়ারকেই ছুড়ে ফেলতে চায় আন্ডার-প্রাইসিং বা অবমূল্যায়নের মাধ্যমে। লক্ষণীয়, এ দুই চরম অবস্থার কোনোটিই স্থায়ী নয়। আবার ঠিক ঘড়ি ধরেও ঘটে না বাজারের রোগমুক্তি।
এই বাই-পোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত মি. মার্কেটের ভাবগতিক বোঝানোর জন্য একটা ঘটনা বলি। ওয়ালস্ট্রিটে ইনকটোমি কোম্পানির শেয়ার নতুন রেকর্ড গড়ে ২০০০ সালের ১৭ মার্চ। সেদিন প্রতিষ্ঠানটির প্রতিটি শেয়ার বিক্রি হয় আনুমানিক ২৩২ ডলারে। ইনকটোমি ছিল ইন্টারনেট সার্চিং কোম্পানি। ১৯৯৮ সালের জুনে এটি তালিকাভুক্ত হয় পুঁজিবাজারে। এর পর থেকে ২০০০ সালে ১৭ মার্চ পর্যন্ত এর শেয়ারদর বাড়ে ১৪০০ শতাংশেরও বেশি! বাজারে ইনকটোমির উত্থানটা ছিল চমকপ্রদ। সেই ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরেই এক সপ্তাহের মধ্যে এর শেয়ারের দাম বেড়েছিল তিনগুণ। কথা হলো, কী জাদু ছিল ইনকটোমির শেয়ারে? জাদু কিছু নয়, আসলে ডটকম বুম থেকে সৃষ্ট সেদিনকার বুল মার্কেটের নেক নজরে পড়েছিল ইনকটোমি। ফলে প্রথম কয়েক মাসে দর্শনীয় প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী ইনকটোমির প্রতি তার আনুকূল্য ছিল অযৌক্তিক। লক্ষণীয়, ১৯৯৯ সালের শেষ প্রান্তিকে ইনকটোমি বিক্রি করে আনুমানিক ৩৬ মিলিয়ন ডলারের সেবা ও পণ্য। পরিমাণটি ১৯৯৮ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিক্রীত পণ্য ও সেবার অনেক বেশি। অনেকে হিসাব করেন, বেশি লাগবে না শুধু ওই কয়েকটা মাসের প্রবৃদ্ধি যদি ইনকটোমি আর শুধু পঁাচটা বছর ধরে রাখতে পারে এক প্রান্তিকের ৩৬ মিলিয়ন ডলার আয়কে ছাড়িয়ে যেত মাসিক পাঁচ বিলিয়ন ডলারের আয়। ফলে সে সময় বহু বিনিয়োগকারী পড়েছিলেন ইনকটোমির প্রেমে। প্রতিষ্ঠানটির প্রবৃদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা অন্ধ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছিলেন যে, ইনকটোমির প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে। প্রেমিক-প্রেমিকারা একে অন্যের মারাত্মক দোষ-ত্রুটিও অগ্রাহ্য করে সাধারণত। একই ঘটনা ঘটেছে ইনকটোমির বেলায়ও। নইলে বিনিয়োগকারীরা নিশ্চয়ই দেখতে পেতেন, ব্যাপক মুনাফা অর্জনের পাশাপাশি নিয়মিতভাবে বড় অঙ্কের মুনাফাও হারাচ্ছে কোম্পানিটি। ইনকটোমি ১৯৯৯ সালের শেষ প্রান্তিকে হারিয়েছিল ছয় মিলিয়ন ডলার; আরও ২৪ মিলিয়ন পরবর্তী ১২ মাসে। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি থেকে লোকসান বাদ দিলে কার্যত সে সময়কার ইনকটোমির মুনাফা সামান্যই। মি. মার্কেটের কাণ্ড দেখেন। এত কিছুর পরও ওয়ালস্ট্রিট ২০০০ সালের ১৭ মার্চ ইনকটোমিকে ঘোষণা দেয় ২৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের প্রতিষ্ঠান হিসেবে। মি. মার্কেটের এ খোশমেজাজ বদমেজাজে পরিণত হয় ২০০২ সালের শেষ দিকে এসে। ২০০২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০০০ সালের ১৭ মার্চের আড়াই বছর পর ওয়ালস্ট্রিটে ইনকটোমির ২৩২ ডলারের শেয়ার বিক্রি হয় মাত্র ২৫ সেন্টে। আর এ মূল্য বিপর্যয়ে ২৫ বিলিয়ন ডলারের ইনকটোমির পরিণত হয় ৪৭০ মিলিয়ন ডলারের মাঝারি প্রতিষ্ঠানে। তবে কি শুকিয়ে আসছিল ইনকটোমির ব্যবসা? মোটেই নয়। প্রতিটি শেয়ারের দাম ২৫ সেন্টে পরিণত হওয়ার পরও পরবর্তী এক বছরে ইনকটোমি মুনাফা করেছে কমপক্ষে ১১৩ মিলিয়ন ডলার। তাহলে কী বদলেছিল? নিঃসন্দেহে মি. মার্কেটের মুড। ২০০০ সালের শুরুতে প্রায় সব মার্কিন বিনিয়োগকারী যেন পাগল হয়ে ওঠেন সম্ভাবনাময় ইন্টারনেট কোম্পানির শেয়ার কেনার জন্য। এই হুজুগে সহজেই নজরে পড়ে যায় শুরুতে ভালো পারফরম্যান্স দেখানো ইনকটোমি। আর সেই হুজুগই কোম্পানিটির প্রতি ডলার মূল্যের শেয়ারের দাম বাড়ায় ২৫০ গুণ; অথচ কেউ গ্রাহ্য করেননি এই ২৫০ গুণ বিনিয়োগের বিনিময়ে তারা মুনাফা পাচ্ছেন মাত্র দশমিক ৩৫ গুণ। মি. মার্কেটের বাই-পোলার ডিসঅর্ডার বুঝতে কষ্ট হলে ড. জেকিল ও মি. হাইডের গল্প পাড়া যায় এখানে। ড. জেকিল ও মি. হাইড একই ব্যক্তি। তবে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী ব্যক্তিত্বের। ড. জেকিল আদতে ফুর্তিবাজ ভদ্রলোক, যিনি রাগান্বিত হলে পরিণত হতেন দানব মি. হাইডে। এমন হাস্যময় ভদ্রলোক থেকে রক্তপিপাসু দানবে রূপান্তরিত হওয়ার ক্ষমতা মি. মার্কেটের আরও দ্রুততর। তার প্রতিশোধপরায়ণতা আরও উগ্র ও সহিংস। সেজন্য বাজারের বিচারশক্তির প্রতি যাদের আস্থা কম, চরম (মন্দা ও চাঙা) বাজারে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হন সবচেয়ে বেশি। একই কারণে সিংহভাগ সময়ে পূর্ববর্তী বুল মার্কেটের অতিমূল্যায়িত শেয়ার বেয়ার মার্কেটে অবমূল্যায়িত হয় ব্যাপকভাবে।
সেক্ষেত্রে করণীয় কী? ভূমিকাতেই বলেছি, এটা একটা সতর্কতামূলক বই। যে কোনো পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারের লাখ লাখ বিনিয়োগকারী লাখ লাখ না হোক, বিনিয়োগ করতে পারেন অন্তত হাজার হাজার পন্থায়। ফলে বাজার ওঠানামার সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগকারীর গৃহীত কৌশল নিয়ে নতুন কিছু বলতে যাওয়া বৃথা। করণীয় নিজেরাই নির্ধারণ করবেন তারা। আমি মূলত পরামর্শ দেব, কোন কোন বিষয় এড়িয়ে চলা উচিত বা কী একেবারেই করা ঠিক হবে না সেসব ইস্যুতে। সেজন্য পাঠকদের প্রশ্নের উত্তরে আমার জবাব হলো, আর যা-ই করুন বাজারের কথায় কান দিতে যাবেন না। মনে করুন, আপনার একজন প্রতিবেশী আছেন সনদপ্রাপ্ত পাগল, মানসিক হাসপাতাল ঘুরে এসেছেন দু-একবার। এখন আপনি কি সপ্তাহে পাঁচ দিন তার কাছে খোঁজ নেবেন, আজ কেমন বোধ করছেন তিনি? তার পর মিলিয়ে দেখবেন তার অনুভূতির সঙ্গে আপনার অনুভূতি মেলে কি না? যদি মিলে যায় তাহলে ওই ব্যক্তির আনন্দে আনন্দিত হবে কিংবা দুঃখে দুঃখিত হবেন অথবা সুখেদুঃখে পরামর্শ নেবেন তার? নিজের বিচার-বিবেচনা ও অনুভূতি মাপবেন পাগলের সঙ্গে? নিশ্চয়ই নিজ আবেগী জীবনের আনন্দ-বেদনার শরিক করবেন না কোনো পাগলকে। বরং সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ সাধারণত নিজ অনুভূতির প্রাথমিক মূল্যায়নটা করেন মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে এবং বুদ্ধিমত্তা দ্বারা। এখন কথা হলো, কেউ যদি নিজ অনুভূতি ও বোধশক্তির মতো অত্যন্ত বিমূর্ত বিষয়ের ভারও পাগলের ওপর ছেড়ে দিতে অনিচ্ছুক থাকেন। পুঁজিবাজারে যেখানে আপনি হাজার হাজার টাকা বিনিয়োগ করছেন তার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের ভার আপনি কোন বিবেচনায় ছেড়ে দেবেন উদ্ধত্ত বা অবসাদগ্রস্ত (অবস্থার) মি. মার্কেটের হাতে? অমন খেয়ালি শক্তির হাতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের নিরাপত্তা বিনা বাক্য ব্যয়ে ছেড়ে দেওয়া যায়? যারা মি. মার্কেটের খেয়ালি মেজাজের নমুনা এখনও দেখেননি তাদের জন্য একটা ঘটনা বলি। ১৯৯৯ সালে রিটারমেন্ট প্ল্যানগুলোতে মার্কিন চাকরিজীবীরা ব্যয় করেন মোট আয়ের গড়ে ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। মি. মার্কেট খুব খোশমেজাজে ছিলেন তখন। ফলে আলোচ্য প্ল্যানে বাড়ছিল বিনিয়োগকারীদের ভিড়। অথচ (বাজারশক্তির উচ্ছ্বাসমূলক প্রভাব ভিন্ন) ওই প্ল্যানগুলোতে এত আগ্রহ দেখানোর কোনো যুক্তি নেই। এ খোশমেজাজি মি. মার্কেট হতাশ হয়ে পড়েন ২০০২ সালে। সে সময় আবার রিটারমেন্ট প্ল্যানগুলোয় বিনিয়োগ কমে যায় সাত শতাংশের মতো। বাহ্যত ব্যাখ্যা মেলে না এ ঘটনারও, মি. মার্কেটের খেয়ালি আচরণ ছাড়া। শিক্ষা হলো, বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীকে বাজারের আবেগের কাছে আত্মসমর্পণ করা যাবে না কখনওই। যখনই আপনি নিজ বিচার-বিবেচনা মতামত অবজ্ঞা করে মি. মার্কেটের মতো হতে চাইবেন তখনই ঘটবে সর্বনাশের সূচনা। অনেকে এজন্য আবার পুরোপুরি মি. মার্কেটকে উপেক্ষা করে চলেন। এটা আরেকটা ভুল পদ্ধতি। সঠিক উপায় হচ্ছে, বাজার শক্তির তাঁবেদারি বা বিরোধিতা নয় বরং আপন স্বার্থ হাসিল পর্যন্ত মি. মার্কেটের অনুসরণ। যেই দেখলেন বাজার থেকে আপনার বিনিয়োগ-স্বার্থ হাসিল হয়েছে, পাত্তা দেবেন না বাজারকে। মনে রাখবেন, পুঁজিবাজারে মি. মার্কেট আপনার ব্যবসার অপরিহার্য সহযোগী। তাকে বাদ দিয়ে কিছু সম্ভব নয়। অন্যদিকে মি. মার্কেট হচ্ছেন নির্বোধ, একগুঁয়ে সর্বজনীন ক্রেতা ও বিক্রেতা (বায়ার অ্যান্ড সেলসম্যান)। তার কাজই হচ্ছে, একেক সময়ে একেক দামে আপনার কাছে পণ্য (শেয়ার) গছিয়ে দেওয়া। আর এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মি. মার্কেট আপনাকে কখনও কখনও চোখ রাঙাবে, মাঝেমধ্যে উসকানি দেবে বা ভয়ভীতি দেখাবে এবং হঠাৎ হঠাৎ পা ধরবে। লক্ষণীয়, মি. মার্কেট ভালো পণ্যও বেচেন আবার খারাপ পণ্যও আছে তার ঝুলিতে। একজন বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীর দায়িত্ব হলো, দরকষাকষির মাধ্যমে কম দামে মি. মার্কেটের কাছ থেকে ভালো পণ্য কেনা এবং নিজ হাতে রক্ষিত বেশি দামের মন্দ পণ্যটি তার হাতে গছিয়ে দেওয়া। এক্ষেত্রে সফল হলে আপনি বাজারের প্রভু, নইলে আপনাকে দাসে পরিণত করবে বাজার। আর সেজন্য দরকার নিজের ওপর আবেগী নিয়ন্ত্রণ (ইমোশনাল কন্ট্রোল)। আমি বিশ্বাস করি, শেয়ারবাজার-সংক্রান্ত যেকোনো টেকনিক্যাল টার্মস মুখস্থ করার চেয়ে কাজটি বেশি জরুরি এবং বাস্তবে প্রয়োগ করা কঠিন। মি. মার্কেট একই সঙ্গে ভয়ংকর শাস্তিদাতা ও অসম্ভব দয়ালু। আরেকটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়, মি. মার্কেট শুধু মূল্য ধ্বংসই করে না, একই সঙ্গে ইকুইলিব্রিয়ামে আসার জন্য তা সৃষ্টি করে ক্ষতিপূরণমূলক মূল্য। আর যেসব বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীর নিজ আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ আছে, তারাই চিহ্নিত করতে পারেন পরিবর্তনশীল স্থান-কালভেদে নবসৃষ্ট ওসব বাজারমূল্য। তাছাড়া আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হচ্ছে, শেয়ারবাজারের অসফল বিনিয়োগকারীর ব্যর্থতার প্রাথমিক কারণ হচ্ছে, বাজার কী করছে তার প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়া তথা বাজারের খবর ও গুজবে নাক ডুবিয়ে বসে থাকা।
ওয়ালস্ট্রিটে ইন্টারনেট কোম্পানিগুলোর ইনকিউবেটর বলা হয় সিএমজিআই-কে। তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাতের জয়যাত্রার প্রাক্কালে ১৯৯৯ সালে ঝকঝকে এ প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারদর বাড়ে ৯৩৯ দশমিক ৯ শতাংশ। বিপরীতে দাম কমে কোকাকোলা, জিলেট ও ওয়াশিংটন পোস্টের মতো মান্ধাতা আমলের বহু কোম্পানির শেয়ারের। বাজারের ভাবগতিক দেখেও আনকোরা অনেক বিনিয়োগকারী আশ্বস্ত হন, কোকাকোলা-জিলেটের দিন শেষ; এখন সময় শুধু আইটির। মজার বিষয়, যা বুঝেই হোক, ওই দুঃসময়েও কোকাকোলা-জিলেট-ওয়াশিংটন পোস্টের শেয়ার বিক্রি করেনি ওয়ারেন বাফেটের নেতৃত্বে হোল্ডিং কোম্পানি বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে। বাজারের গ্রোতে একবারও গা ভাসাননি তিনি। বিনিয়োগকারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা তিনি বেচেননি বাজারের কাছে। তার সুফল মেলে পরবর্তী প্রাইস সুইংয়ে। ২০০০ সালে সিএমজিআই হারায় ৯৬ শতাংশ মূল্য; যেখানে একই বছর বার্কশায়ার হ্যাথায়ের প্রবৃদ্ধি ছিল ২৭ শতাংশের কাছাকাছি। উল্লেখ্য, ইন্টারনেট বাবল ফেটে যাওয়ায় আইটি খাতের শেয়ারে মূল্য বিপর্যয় ঘটে এবং ক্ষতিপূরণমূলক মূল্য সৃষ্টি হয় অন্য কিছু কোম্পানির শেয়ারে। স্থানটি চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন বাফেট। সেজন্যই ইন্টারনেট বাবলের উপস্থিতিতে সার্বিকভাবে বার্কশায়ার মূলধনের ৩ দশমিক ৮ শতাংশ ক্ষতি হলেও বাবলটি ফেটে যাওয়ার পর তাদের কুমুলেটিভ গেইন ছিল প্রায় ৩০ শতাংশ।
মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে পরবর্তী অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করব আমি। সাধারণত বুল ও বেয়ার মার্কেটে মিচুয়ালসহ বিভিন্ন ফান্ড ব্যবস্থাপকদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। এছাড়া এদের ভূমিকার উল্লেখযোগ্য প্রভাব থাকে বাজার ও বিনিয়োগকারীর ওপর। ফলে এখানে বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীর সতর্কতার স্বার্থে বাজারের উত্থান ও পতনকালে মিউচুয়াল ফান্ড ব্যবস্থাপকদের করা সাধারণ কিছু ভুলের তালিকা উপস্থাপন প্রয়োজন মনে করছি।
এক. যেহেতু মিউচুয়াল ফান্ড ব্যবস্থাপকদের ব্যবস্থাপনায় লাখ লাখ ডলারের পুঁজি থাকে, পুঁজির সুরক্ষা সাধনে তারা ধাবিত হন বৃহত্তর কোম্পানির শেয়ারের প্রতি। ফলে দেখা যায় বড় মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর পোর্টফোলিও কার্যত বড় বড় কোম্পানির হাজার হাজার শেয়ারে ভর্তি। এভাবে অনেক সময় অতিমূল্যায়িত জায়ান্ট কোম্পানির শেয়ারে অর্থমূল্য খুইয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অপেক্ষা করে মিউচুয়াল ফান্ড। আর তা প্রকাশিত হয় বুল মার্কেট শেষে বেয়ার মার্কেট আসার পর।
দুই. বুল মার্কেট শুরুর প্রাক্কালে বাজারের উত্তাপ অনুভব করে বিনিয়োগকারীরা বাড়তি মূলধন ঢালেন ফান্ডে। ম্যানেজারদের হাতে ওই নগদ পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে আগে কেনা বৃহত্তর কোম্পানির শেয়ার আরও বেশি করে কেনা শুরু হয়। ফলে অতিমূল্যায়িত শেয়ারের আবার অতিমূল্যায়ন বাজারের বিপজ্জনক মূল্যস্তরকে অধিকতর বিপজ্জনক স্তরে উঠিয়ে দেয়।
তিন. পড়ন্ত বাজারেও মিউচুয়াল ফান্ডের বিনিয়োগকারীদের ওপর রয়েছে একই ধরনের গোষ্ঠীগত প্রভাব (মব ইফেক্ট)।
Add Comment