পূর্বের প্রকাশের পর………
১৭২০ সালের আগেই ইংল্যান্ডের সবচেয়ে দামি কোম্পানি ছিল সাউথ সি। ওই কোম্পানির কিছু শেয়ার কিনেছিলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা চিন্তাবিদ স্যার আইজ্যাক নিউটনও। একবার আকস্মিকভাবে দরপতন শুরু হলে তিনি বেচে দেন সাউথ সি’র সব শেয়ার। বিস্মিত নিউটন শতভাগ মুনাফায় আয় করেন সাকুল্যে সাত হাজার পাউন্ড। শেয়ারের দাম কমার পরও তার কেন লাভ হলো, এটা বুঝতে না পেরে এই মহান পদার্থবিদ নাকি তার এক বন্ধুকে বলেছিলেন ,‘মহাবিশ্বের সব জাগতিক বস্তুর গতি-প্রকৃতি নির্ণয় করা সম্ভব; কিন্তু শেয়ারবাজারের মন কিছুতেই নয়।’ বিপত্তি ঘটলো এর পর। হুট করে বাড়তে শুরু করলো সাউথ সি’র শেয়ারদর। তাড়াহুড়ো করে অন্যদের দেখাদেখি বেশকিছু শেয়ার কিনে পরবর্তীতে বিক্রি করে ধরা খেলেন আনুমানিক ২০ হাজার পাউন্ড। এতে প্রচণ্ড হতাশ হন নিউটন। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত যদি ব্যর্থও হয়ে থাকেন, তার মানে এই নয় যে আপনি বোকা; আপনাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। এর কারণ হলো, সফল বিনিয়োগকারী হওয়ার জন্য যে মানসিক শৃঙ্খলার প্রয়োজন, তা আপনার নেই। যা ছিল না নিউটনেরও।
অধিক ব্যয় ও বাজে আচরণ গলা টিপে মারে মিউচুয়াল ফান্ডের সম্ভাবনা
ম্যানেজার স্থানান্তর: শেয়ার নির্বাচনকারীকে ওয়ালস্ট্রিটে বলা হয় স্টক পিকার। আর রাজা মাইডাসের স্বর্ণ-স্পর্শের (গোল্ডেন টাচ) কাহিনি আশা করি সব পাঠকেরই জানা। কথা হলো, যখন একজন স্টক পিকারের হাতে কিং মাইডাসের গোল্ডেন টাচ দেখা যায়, সবাই তাকে পেতে চান; এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিও। ট্রান্স-আমেরিকা প্রিমিয়ার ইকুইটি ফান্ডের ম্যানেজার ছিলেন গ্লেন বাইকারস্টাফ। ১৯৯৭ সালে কেবল তার বিনিয়োগ দক্ষতার ওপর ভর করে ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশ গেইন অর্জন করে ট্রান্স-আমেরিকা। পরের বছর বেশি বেতনে তাকে চাকরি দেয় টিসিডব্লিউ। তারপর থেকে টিসিডব্লিউর গ্যালিলিও সিলেক্ট ইকুইটিজ ফান্ড পরিচালনা করছিলেন গ্লেন। লক্ষণীয়, তিনি ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে পরবর্তী চার বছর বাজারের বাজে পারফরম্যান্সকারী ফান্ডগুলোর অন্যতম ছিল ট্রান্স-আমেরিকা প্রিমিয়ার ইকুইটি। ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ফিডেলটি অ্যাগ্রেসিভ গ্রোথ ফান্ডের ম্যানেজার ছিলেন এরিন সুলিভান। তিনি থাকাকালে ফান্ডের শেয়ারহোল্ডারদের মূলধন বাড়ে তিনগুণ। পরে ২০০০ সালে নিজে একটি হেজ ফান্ড গঠন করে ফিডেলটির চাকরি ছেড়ে দেন এরিন। পরবর্তী তিন বছরে মোট সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ হারায় ফান্ডটি।
অ্যাসেট এলিফ্যান্টিয়াসিস: এলিফ্যান্টিয়াসিস পায়ের গোদরোগ। এতে পা ভারী হয়ে যায়। তখন আর হাঁটতে পারেন না মানুষজন। সম্পদ বেশি হলে এই রোগ হয় মিউচুয়াল ফান্ডেরও। একে বলে অ্যাসেট এলিফ্যান্টিয়াসিস। কোনো মিউচুয়াল ফান্ড ভালো রিটার্ন দিতে থাকলে বিজ্ঞাপন দিতে হয় না। এমনিতেই খবর হয় বাজারে। তখন দেখবেন সপ্তাহখানেকের মধ্যে বিপুলসংখ্যক বিনিয়োগকারী ভিড় জমাচ্ছেন ওই ফান্ডের সামনে। সমস্যা হলো, অতিরিক্ত বিনিয়োগকারীর ওই বাড়তি মূলধন ফান্ডের পা ভারী করে। এদিকে ভিড় বাড়ায় জনপ্রত্যাশার চাপে ম্যানেজারদের কমে যায় শেয়ার বাছাইয়ের পছন্দ-অপছন্দ। প্রত্যাশার সে চাপ কমানো অত্যন্ত কঠিন। কেননা যখনই কোনো ফান্ড ভালো রিটার্ন দেবে, তখনই অধিক সংখ্যক বিনিয়োগকারী তার প্রতি আকৃষ্ট হবেন, এটাই স্বাভাবিক। এদিকে উঠতি বাজার ছাড়া ফান্ডের পক্ষে ভালো রিটার্ন দেওয়া সম্ভব নয়। এখন কথা হলো, এই উঠতি বাজারে কোনো একটি ফান্ডে অধিক মূলধন চলে এলে ম্যানেজারের পক্ষে বাড়তি বিনিয়োগ বাজারে না ছেড়ে উপায় থাকে না। সেক্ষেত্রে দুই পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন তিনি। এক. অতীতে যেসব শেয়ারে বিনিয়োগ করে ভালো রিটার্ন পেয়েছেন, সেই একই শেয়ারে পুনরায় বিনিয়োগ করা। এক্ষেত্রে ঝামেলা হলো, একই শেয়ারে বারবার বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করা মানে অবধারিতভাবে শেয়ারটির অতিমূল্যায়ন ঘটানো। দুই. আগে বিনিয়োগ করেননি এমন অপরীক্ষিত কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করা। এক্ষেত্রে সমস্যা হলো, অপরীক্ষিত কোম্পানির মাঝে কোনটি সম্ভাবনাময় ও কোনটির ঝুঁকি বেশি, তা বের করার জন্য অনুসন্ধান ও গবেষণা প্রয়োজন। কিন্তু সে সময় কই? বাইরে বিনিয়োগকারীদের ভিড়! তার ওপর উচ্চ রিটার্নের প্রত্যাশা!
বিনিয়োগ বিনিয়োগ খেলা: কিছু কোম্পানি আছে খুব সতর্ক। এরা পুরোপুরি বাজারে নামার আগে প্রথমে ফান্ডের ডিমে তা দেয়। অর্থাৎ যাকে বলে ইনকিউবেট করে। তার মানে পাবলিকলি (সম্মুখে) নামানোর আগে প্রাইভেটলি (গোপনে) সেগুলোর টেস্ট রান (পরীক্ষামূলক সম্প্রচার) হয়। সাধারণত এই পরীক্ষামূলক সম্প্রচারটি হয় ওই ফান্ডের বা সহযোগী অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মাঝে। তারা এখানে গিনিপিগ। ফান্ড রাখা হয় ছোট। অতঃপর ইনকিউবেটরে নানা রকম ঝুঁকি-কৌশল প্রয়োগ করে বোঝার চেষ্টা করা হয় ফান্ডটি লাভজনক হবে কিনা। বিপত্তি হলো, রাসায়নিক পরীক্ষাগারের বিভিন্ন পরীক্ষা যন্ত্রপাতি পাওয়া সাপেক্ষে অন্যত্রও করা সম্ভব। কিন্তু ওই ছোট ইনকিউবেটরে বিনিয়োগ বিনিয়োগ খেলা নামক পরীক্ষা চালিয়ে বাস্তবে বিস্তৃত শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া প্রায় অসম্ভব। ফলে এ ধরনের ফান্ড ফেল মারে। আরেক ধরনের মিউচুয়াল ফান্ড আছে, যাদের কৌশল হলো শুরুতে ম্যানেজমেন্ট ফি কমিয়ে নির্ধারণ। তাতে রিটার্ন ও বিনিয়োগকারীর আকর্ষণ দুটোই বাড়ে। কিন্তু পরে রিটার্ন একটু বেশি হলেই দেখা যায়, শেয়ারহোল্ডারদের কাছ থেকে অধিক হারে ফি নিচ্ছে এরা। তখনই এদের পতনের সূচনা। একটা কথা না বলে পারছি না। জীবনে বহু নিয়ম দেখেছি। সেসব নিয়মের ব্যতিক্রমও দেখেছি। কিন্তু হাজার হাজার বিনিয়োগকারী লাখ লাখ ডলার ঢালার পরও কোনো ইনকিউবেটেড বা ডিসকাউন্ট মিউচুয়াল ফান্ড মাঝারি মানের ফান্ডে পরিণত হয়নি, এমন ঘটনা একটাও জানা নেই আমার।
ব্যয় বর্ধন: প্রায়ই দেখা যায়, বড় ব্লকে স্টক লেনদেন ব্যয় ছোট ব্লকে শেয়ার লেনদেনের তুলনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেশি হয়। কেননা বৃহৎ ব্লক স্টকের বিক্রেতা কম; ক্রেতাও নগণ্য। ফলে এখানে ক্রেতা-বিক্রেতা মিলিয়ে দেওয়া জটিল ব্যাপার। তদুপরি রয়েছে বাড়তি ব্যয়ের বোঝা। মনে করুন, কোনো এক মিউচুয়াল ফান্ডে রয়েছে ১০০ মিলিয়ন ডলারের সম্পদ। ধরুন, সেটির বার্ষিক ট্রেডিং কস্ট (লেনদেন ব্যয়) মোট সম্পদের ১ শতাংশ। আগের বছর চোখ ধাঁধানো পারফরম্যান্স দেখিয়েছে উচ্চ রিটার্ন দিয়েছিল ফান্ডটি। তাই এ বছর অফিসের দরজার সামনে বিনিয়োগকারীদের ভিড়। তা এড়ানো সম্ভব হলো না এবং ফান্ডের মোট সম্পদমূল্য দাঁড়ালো ১০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। এতে করে বার্ষিক ২ শতাংশে উপনীত হলো ট্রেডিং কস্ট। ১০ বিলিয়নের ২ শতাংশ কিন্তু ১০০ মিলিয়নের ১ শতাংশ থেকে অনেক বেশি। ফলে ১০ বিলিয়নের বেলায় ট্রেডিং কস্ট কাজ করবে অনেকটা ক্ষয়কারী এসিডের মতো। দেখা গেছে, কোনো মিউচুয়াল ফান্ডের ট্রেডিং কস্ট যদি ২ শতাংশ ও পরিচালনব্যয় মোট সম্পদের ১ দশমিক ৫ শতাংশ হয়, শুধু আগের পারফরম্যান্স ধরে রাখতে আগের বছরের চেয়ে অন্তত ৩ দশমিক ৫ শতাংশীয় (পার্সেন্টেজ) পয়েন্ট বেশি গেইন অর্জন করতে হবে ফান্ডটিকে। কাজটি দুরূহ বৈকি।
ভেড়ার মতো আচরণ: সফল হওয়ার পর সাধারণত ভীতি ও ভাবপ্রবণতা ঢুকে পড়ে ফান্ড ম্যানেজারদের মনে। নিজের বেতন বৃদ্ধি ছাড়া এরা তখন বেশি কিছু আর করতে চান না। এমনকি প্রাথমিক অবস্থার উচ্চ রিটার্ন আনার জন্য যেমন ঝুঁকি নিতেন, সেসব গ্রহণেরও অভিরুচি তখন থাকে না তেমন। এসব ম্যানেজারের আচরণ সে সময় হয়ে যায় পেটুক ভেড়ার মতো। অর্থনীতিবিদরা একে ভেড়ার আচরণ বলে চিহ্নিত করেছেন। এ অবস্থায় উন্নীত হলে সব সফল ফান্ড ম্যানেজার তখন একসঙ্গে ‘ব্যা’ ডাকেন এবং একজন যে বেড়া ডিঙায় (বিলি ববের গল্প স্মর্তব্য), সবাই মিলে সেটি ডিঙাতে যান। সিসকো, জেনারেল ইলেকট্রিক, মাইক্রোসফট, ওয়াল-মার্ট, পিফিজার ফার্মাসিউটিক্যালসের অধিক শেয়ার ধারণকারী একাধিক সফল ফান্ডের ম্যানেজাররা উজ্জ্বলভাবে প্রমাণ করেছেন এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বটি।
মোদ্দা কথা, সিংহভাগ মিউচুয়াল ফান্ডের সম্ভাবনাকে গলা টিপে হত্যা করেছে তাদের অধিক ব্যয় ও বাজে আচরণ। প্রশ্ন হলো, সেক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের কী করা উচিত? ওয়ালস্ট্রিটে এক ধরনের ফান্ড রয়েছে, যাদের বলা হয় ইনডেক্স মিউচুয়াল ফান্ড। এগুলো গঠিত হয় কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে বাজারের সব ধরনের স্টক নিয়ে। অবশ্য কোন শেয়ার উৎকৃষ্ট আর কোনটি নিকৃষ্ট, সেসব প্রদর্শিত হয় না এ সূচকে। তবু দীর্ঘ মেয়াদে এদের পারফরম্যান্স অন্যান্য মিউচুয়াল ফান্ডের চেয়ে বেশি। এদের পরিচালন ব্যয় (অপারেশনাল কস্ট) ও ট্রেডিং কস্টও তুলনামূলকভাবে কম; যথাক্রমে বার্ষিক দশমিক ২ শতাংশ ও দশমিক ১ শতাংশের মতো। তবে ইনডেক্স মিউচুয়াল ফান্ডের বড় দুর্বলতা হলো, এগুলো খুবই বিরক্তিকর। কোনো ইনডেক্স ফান্ডে বিনিয়োগ করে কোনোদিন বিনিয়োগকারী বন্ধু-বান্ধবদের গর্ব করে বলতে পারবেন না, দেশের সর্ববৃহৎ ফান্ডে অংশীদারত্ব রয়েছে আপনার; কোনোদিন তৃপ্তি হবে না, বাজারকে পরাজিত করার মোক্ষম অস্ত্র রয়েছে আপনার হাতে। কিন্তু যেহেতু পরিচালন ব্যয় ও ট্রেডিং কস্ট কম, এখানে আরামসে বিনিয়োগ করতে পারবেন ২০ বছর বা তারও বেশি। আর দীর্ঘমেয়াদি ইনডেক্স ফান্ড ব্যবহারকারীরা এগিয়ে থাকেন অন্য বিনিয়োগকারীদের চেয়ে। আর বস্তুনিষ্ঠভাবে দেখলে এ ধরনের ফান্ড ওয়ারেন বাফেটের মতো ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের জন্য অধিক উপযোগী।