বেনজামিন গ্রাহাম: দ্য ইনটেলিজেন্ট ইনভেস্টর

 

পূর্বের প্রকাশের পর…………

শেয়ারবাজারে কিছু মুহূর্তে চোখ বুজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন আপনি। কখনও কখনও আবার চোখ-কান খোলা না রাখলে সমূহ বিপদ। কখন চোখ বন্ধ রাখবেন, আর কখন খোলা রাখবেন সে বিষয়ে কিছু উপদেশ ঝেড়েছি। আর এ আলোচনায় বিনিয়োগকারীর সাইকোলজি সম্পর্কে বাক্যালাপ অবধারিত। একজন বিনিয়োগকারীর সবচেয়ে বড় শত্রু হলো তার মেজাজ ও মগজ। কথাটি বর্তমান সময়ে আরও বেশি প্রযোজ্য। মন্দা বাজারে রক্ষণশীল ভাব ধরে নিষ্ক্রিয় হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন, তা হবে না। বিনিয়োগ করতে চাইলে ভালো-মন্দ শেয়ার কিনতেই হবে আপনাকে। গায়ে লাগাতেই হবে মন্দা বাজারের উত্তাপ। আমার বিশ্বাস, কারও যদি মোটামুটি চলনসই জ্ঞান-বুদ্ধি থাকে, তিনি যদি আমার কথাগুলো আত্মস্থ করতে সমর্থ হন কাজে আসবে বইটি। সফল বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপযুক্ত মানসিকতা গড়ে তুলতে পারবেন পাঠকরা। আমি কিন্তু বহু সাধারণ বিনিয়োগকারীকে ওয়ালস্ট্রিটে দেখেছি, যারা ফাইন্যান্স, অ্যাকাউন্টিং ও স্টক মার্কেটের ওপর বিশাল ডিগ্রিধারীদের চেয়ে ভালো করেছেন।

আপনার পোর্টফোলিও’র সঠিক চিকিৎসা দরকার

লক্ষণীয়, রক্ষণাত্মক বিনিয়োগকারীর পক্ষে তার পরামর্শদাতার সঙ্গে নিষ্ক্রিয় পেশাদার সম্পর্ক রাখা স্বাভাবিক। অপরদিকে উপদেষ্টা বা উপদেষ্টাদের সঙ্গে সক্রিয় সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা একজন আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারীর কর্তব্য। তার আরও দায়িত্ব পরামর্শদাতার কাছ থেকে পরামর্শের ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যাখ্যা তলব। তিনি উপদেষ্টার পরামর্শ শুনে তার ওপর প্রয়োগ করবেন নিজস্ব বিচার-বিবেচনা। উপরন্তু তিনি পরামর্শ নেবেন বিনিয়োগ ঘিরে তার প্রত্যাশা ও বিনিয়োগের প্রকৃতি অনুযায়ী। অতঃপর উপদেষ্টার পরামর্শ ব্যবহার করবেন আত্মলব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা উন্নয়নে। একজন আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারী কি পরামর্শকের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করতে পারবেন না কখনোই? অবশ্যই পারবেন। তবে সেটি হবে ব্যতিক্রমী ঘটনা। যদি কোনো আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারী শতভাগ নিশ্চিত থাকেন যে, তার উপদেষ্টার যোগ্যতা ও সততা সন্দেহাতীত, কোনো প্রশ্ন না তুলে এবং পরামর্শের ব্যাখ্যা না বুঝেও তিনি সরাসরি বাস্তবায়ন করতে পারেন সেই উপদেশ। তবু এখানে স্মরণ করিয়ে দেওয়া জরুরি মনে করছি, নীতি বা মূল্যবোধের ধার ধারেন না পুঁজিবাজারের বহু স্টক সেলসম্যান। আবার কোনো কোনো ব্রোকারেজ হাউজ সাইনবোর্ড-সর্বস্ব। তাই এখানে সৎ ও যোগ্য পরামর্শ পাওয়া অত্যন্ত দুরূহ হলেও অসম্ভব নয়। সেজন্য স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়া উত্তম। তবে প্রতিষ্ঠানটি যদি কোনো ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের মিডলম্যান হয়, পরামর্শ ও লেনদেনের ব্যাপারে দ্বিগুণ সতর্ক থাকুন। দুঃখিত হওয়ার চেয়ে নিরাপদ থাকা ভালো (বেটার সেইফ দ্যান সরি)। দার্শনিক থেলিস বাজার দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় নাকি তার চলতিপথে বড় বড় পাথর ছড়িয়ে রাখতেন মাইলেসিয়ান নামে এক পতিতা। এই নারীর উদ্দেশ্য ছিল নিছক বিনোদন ঊর্ধ্বমুখী থেলিসের হোঁচট খাওয়ার দৃশ্য উপভোগ। মিশেল দু মনতাইন বলছেন, হোঁচট খাওয়া থেকে থেলিস যে শিক্ষালাভ করেন সেটি হলো, সবসময় আকাশের ভরসায় পথ চলো না, আপন পদযুগলের প্রতিও মনোযোগ দাও। অবশ্য পাঠকরা ওভাবে শেয়ারবাজারে ঠেকে ও ঠকে শিখুন, তা এই বই লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমার প্রত্যাশা, বইটি পড়ে আগে থেকেই যেন সতর্ক থাকেন বিনিয়োগকারীরা।

বিনিয়োগ পরামর্শের বাজারজ্ঞান টনটনে। বুল মার্কেটে দেখবেন পরামর্শ ছাড়াই বহু আনাড়ি বিনিয়োগ করছেন এবং একেবারে খারাপ করছেন না। আমার মতে, ওয়ালস্ট্রিটের গবেষণা, পরামর্শ ও লেনদেন অবকাঠামো ব্যয়বহুল। সেখানে স্বাধীনভাবে চিন্তাভাবনা করে কোম্পানি অনুসন্ধান, স্টক বাছাই ও লেনদেন কষ্টসাধ্য। তবে বুল মার্কেটে কষ্টটি অনুভূত হয় না প্রায়ই। কিন্তু নিজের গলদগুলোও বুঝতে পারেন না আনাড়ি বিনিয়োগকারী। দুর্ভাগ্যবশত তাদের এই উপলব্ধি হয় বেয়ার মার্কেটে গিয়ে। তখন লোকসানের শিকার অনেক বিনিয়োগকারী ভাবতে শুরু করেন, নিজে নিজে মাতবরি করার কারণেই এমনটা ঘটেছে আরেকজনের পরামর্শ নিলে দুর্ঘটনা ঘটতো না হয়তো। এ বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকছি এজন্য যে, বহু চালু বিনিয়োগকারীও কিন্তু ক্ষতির শিকার হন বেয়ার মার্কেটে। আসলে একজন বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীর দুটি অভিমত (অপিনিয়ন) থাকা উচিত। তার প্রথমটি তৈরি হবে নিজ অভিজ্ঞতা ও বিচারশক্তি থেকে। আর আর্থিক পরামর্শদাতার উপদেশে গঠিত হবে দ্বিতীয় অভিমত। অনেক সময় নিজ সিদ্ধান্তের বস্তুনিষ্ঠতা ও গুণাগুণ বুঝতে বাইরের একজনের (আউটসাইডার) দরকার হয়, যিনি সময়ে সময়ে আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেবেন যে পরিমাণ আয় তথা মুনাফা অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে আপনি নেমেছেন, তার কতটুকু অর্জিত হলো, বিনিয়োগের রেট অব রিটার্ন সন্তোষজনক কি না, কখন ও কী পরিমাণ খরচ বাঁচাতে হবে কিংবা রেট অব রিটার্ন আশানুরূপ বাড়াতে আরও কী কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার প্রভৃতি। অবশ্য একশ্রেণির ব্যক্তি আরও একটা কারণে আর্থিক উপদেষ্টার শরণাপন্ন হন। সেটি হলো, নিজের দোষ কারও ঘাড়ে চাপানোর লোক মেলে না যখন। আবার অতিসন্দেহপ্রবণ কিছু বিনিয়োগকারী এমনিই যান পরামর্শদাতার কাছে। কেউ কেউ যান অনুপ্রেরণা পেতে। বিষয়টি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার মতো নয়। নিজ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি থাকলে অনেক সময় উপযুক্ত ব্যক্তির উপদেশ মনকে ধীর-শান্ত করে, যা বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন বিনিয়োগের অপরিহার্য শর্ত।

বাজারে অনেক সময় সমালোচনা হয়, “ব্যাটা, বিনিয়োগের ‘ব’ও জানে না, কিছু পয়সা জমেছে, তা-ই নিয়ে নেমেছে পুঁজিবাজারে।” আমি মনে করি, নিজ পোর্টফোলিও ম্যানেজ করতে না পারাটা নিন্দনীয় নয়; যেমনটি দোষণীয় নয় পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্টের ব্যাপারে কারও পরামর্শ গ্রহণ। তবে একজন বিনিয়োগকারীর পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন আছে কি নেই, তা কয়েকটি লক্ষণ থেকে বোঝা যায়; যেমনÑ

এক. যদি সিকিউরিটিজ বিনিয়োগ থেকে বিনিয়োগকারী বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির শিকার হন সম্প্রতি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০০০ সালের প্রথম প্রান্তিক থেকে ২০০২ সালের শেষ প্রান্তিক পর্যন্ত যেসব বিনিয়োগকারী তাদের পোর্টফোলিও’র শতকরা ৪০ ভাগ মূল্য হারিয়েছেন, প্রকৃতপক্ষে তাদের হারানো মূল্য গোটা বাজারের হারানো গড় লোকসানের বেশি। আর যাদের কপালে এমন ঘটনা ঘটেছে, তাদের উচিত দেরি না করে অতিদ্রুত বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া। অনেকে মনে করেন, আমি অলস, বেপরোয়া বা দুর্ভাগা সেজন্যই এমন লোকসান। সম্ভবত তা নয়; বরং আপনার পোর্টফোলিও’র সঠিক চিকিৎসা দরকার।

দুই. দীর্ঘদিনের অনিয়ন্ত্রিত বাজেট। যদি দেখেন ‘দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগকারী’ হওয়ার বাসনায় আপনি দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগ করেই যাচ্ছেন কিন্তু ফল নেই; বিনিয়োজিত অর্থ শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে থামছে তারও নেই হদিস; নিয়মিতভাবে অপব্যয় হ্রাসও সম্ভব হচ্ছে না আপনার দ্বারা। তার মানে, এ মুহূর্তে আপনার বিনিয়োগ বাজেট আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এ অবস্থায় বাজেটের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় উপযুক্ত পরামর্শ প্রয়োজন। আপনার দরকার একটি সংক্ষিপ্ত পোর্টফোলিও পরিকল্পনা, যেখানে দিকনির্দেশনা থাকবে কীভাবে এবং কতটুকু ব্যয়, ঋণ, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ করতে হবে প্রভৃতি বিষয়ে।

তিন. অগোছালো পোর্টফোলিও: ১৯৯০’র দশকের শেষভাগে একশ্রেণির বিনিয়োগকারীর ধারণা ছিল (ঝুঁকি হ্রাস ও নিরাপত্তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে), তাদের পোর্টফোলিও বিস্তৃতভাবে বৈচিত্র্যময়; কেননা কমপক্ষে ভিন্ন ভিন্ন ৩৯টি প্রযুক্তি কোম্পানি কিংবা অন্তত সাত রকমের গ্রোথ ফান্ডে বিনিয়োগ রয়েছে তাদের। এটা পোর্টফোলিও বৈচিত্র্যানয়নের অ-সঠিক পদ্ধতি। পোর্টফোলিও’কে ওভাবে সাজানোর মানে হলো বিচিত্র উপাদানের মাঝেও যে সঙ্গতি থাকে, তার ঘাটতি আছে পোর্টফোলিও’র; আপনি ধ্রুপদী সঙ্গীতানুষ্ঠানে গিয়ে হার্ড রক বাজাতে বসেছেন। এখন ওই হার্ড রকের নেপথ্যে তবলা-সরোদ যত ধ্রুপদী বাদ্যযন্ত্রই ব্যবহার করুন না কেন শোরগোল বাড়বে, সংগীত হবে না। পোর্টফোলিও’তে সংগতি না থাকার অর্থ হলো, যুক্তির তোয়াক্কা না করে কখনো আপনার শেয়ারের দাম বেশি বাড়বে, কখনো বেশি কমবে। সমস্যাটি দূরীকরণে পেশাদার কারও কাছ থেকে অ্যাসেট অ্যালোকেশন প্ল্যান নেওয়া উচিত।

চার. পারিবারিক প্রেক্ষাপটে বৃহৎ পরিবর্তন: ধরুন, আপনি কিছুদিন পর অবসরে যাচ্ছেন এবং শেয়ার নিয়ে ভাবনা কমিয়ে এই জীবনটা ভালোমতো উপভোগ করতে চান বা আপনার বৃদ্ধ বাবা-মা কোনো আর্থিক সংকটে পড়েছেন অথবা বাচ্চাদের লেখাপড়ার ব্যয়ভার ক্রমে দুর্বিষহ হয়ে উঠছে; তেমন পরিস্থিতিতে অভিজ্ঞ পরামর্শদাতার সদুপদেশ নিন, মানসিক কষ্ট লাঘবের সঙ্গে সঙ্গে অধিকতর আয়-উন্নতিরও একটা ব্যবস্থা হয়ে যেতে পারে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০