পূর্বের প্রকাশের পর……………
শেয়ারবাজারে কিছু মুহূর্তে চোখ বুজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন আপনি। কখনও কখনও আবার চোখ-কান খোলা না রাখলে সমূহ বিপদ। কখন চোখ বন্ধ রাখবেন, আর কখন খোলা রাখবেন সে বিষয়ে কিছু উপদেশ ঝেড়েছি। আর এ আলোচনায় বিনিয়োগকারীর সাইকোলজি সম্পর্কে বাক্যালাপ অবধারিত। একজন বিনিয়োগকারীর সবচেয়ে বড় শত্রু হলো তার মেজাজ ও মগজ। কথাটি বর্তমান সময়ে আরও বেশি প্রযোজ্য। মন্দা বাজারে রক্ষণশীল ভাব ধরে নিষ্ক্রিয় হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন, তা হবে না। বিনিয়োগ করতে চাইলে ভালো-মন্দ শেয়ার কিনতেই হবে আপনাকে। গায়ে লাগাতেই হবে মন্দা বাজারের উত্তাপ। আমার বিশ্বাস, কারও যদি মোটামুটি চলনসই জ্ঞান-বুদ্ধি থাকে, তিনি যদি আমার কথাগুলো আত্মস্থ করতে সমর্থ হন কাজে আসবে বইটি। সফল বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপযুক্ত মানসিকতা গড়ে তুলতে পারবেন পাঠকরা। আমি কিন্তু বহু সাধারণ বিনিয়োগকারীকে ওয়ালস্ট্রিটে দেখেছি, যারা ফাইন্যান্স, অ্যাকাউন্টিং ও স্টক মার্কেটের ওপর বিশাল ডিগ্রিধারীদের চেয়ে ভালো করেছেন।
ভুল থেকে বিরত থাকার সর্ববৃহৎ
বাধা নিজের বিবেচনা
জোচ্চোরের অভাব নেই পুঁজিবাজারে। এরা সুচ হয়ে ঢুকবে, বেরুবে ফাল হয়ে। সুতরাং পরামর্শদাতা নির্বাচনে প্রথমেই দেখুন ব্যক্তিটি সৎ কি না। যদি সুযোগ থাকে, তাহলে প্রথমেই নির্দিষ্ট কারও কাছে না গিয়ে একসঙ্গে কয়েকজন পেশাদার পরামর্শদাতার ব্যাপারে খোঁজখবর নিন। প্রথমে শুনুন, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানটি সততা অনুশীলন করে কি না; তারপর যাচাই করুন তারা আসলেই সৎ ও যোগ্য কি না। (তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে কাজটি কঠিন নয়। গুগল হোমপেজে যান। উদ্দিষ্ট পরামর্শদাতার নাম প্লাস ‘ফাইন’, ‘কমপ্লায়েন্ট’, ‘ল’ সুইট’, ‘ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন’, ‘সাসপেনশন’ প্রভৃতি লিখে সার্চ দিন। নামকরা কেউ হলে তার সম্পর্কে অনুমান করে নিতে পারবেন সার্চ রেজাল্ট দেখে)। পরামর্শদাতা স্টক বা ইন্স্যুরেন্সের ব্রোকার হলে খোঁজ লাগান কর্মরত প্রতিষ্ঠানে। অ্যাকাউন্ট্যান্ট হলে ব্যাংকে (বা অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে) গিয়ে জানুন, লোকে তার সম্পর্কে কী বলে। যদি এক-দুজন নেতিবাচক মন্তব্য করেন, কানেই তুলবেন না। কিন্তু ওই ব্যক্তি সম্পর্কে যদি বেশিরভাগ মানুষ নেতিবাচক মন্তব্য করে, তাকে পরিহার করাই উত্তম। ‘বাজে পরামর্শক’ আবিষ্কারের এক ব্যতিক্রমী পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন মার্কিন স্টেট অব মেরিল্যান্ডের সিকিউরিটিজ কমিশনার মেলানি সেন্টার লুবন। তিনি বলেছেন, কোনো পরামর্শদাতার মুখে যদি কোনোদিন এই কথাগুলো শোনেন, তাকে সঙ্গে সঙ্গে বাদ দিয়ে দেবেন: ‘সারা জীবনে এমন সুযোগ একবারই আসে’, ‘গ্যারান্টি দিচ্ছি’, ‘শতভাগ নিশ্চিত’, ‘না কিনলে পরে পস্তাবেন’ ‘বিশ্বাস করুন’, ‘মায়ের কসম’, ‘মনে হয় ধনী হওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই আপনার’, ‘মাসে মাসে রিটার্ন’, ‘এক আমি ছাড়া কেউই জানেন না কীভাবে এটা করতে হয়’, ‘ফি’র প্রতি তাকাবেন না, পারফরম্যান্সের ওপর নজর দিন’।
সন্দেহের অবকাশ নেই, পরামর্শদাতা নির্বাচন করতে হবে সতর্কতার সঙ্গে। একবার বিখ্যাত এক ম্যাগাজিনে এসেছিল পরামর্শক নির্বাচনের আগে কোন কোন বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া উচিত:
১. পর্যবেক্ষণ করুন, আপনার পরামর্শদাতা সত্যি সত্যি আপনার সমস্যা বুঝেছেন কি না। নাকি সমস্যার প্রকারভেদ না বুঝে একই অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে যাচ্ছেন সবাইকে।
২. বিনিয়োগের মৌলিক নীতিমালা স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে এ বইয়ে। তার আলোকে লক্ষ্য করুন তো, আসলেই আপনার মনোনীত পরামর্শক ভদ্রলোক শেয়ারে বিনিয়োগ বোঝেন কি না, নাকি এ বিষয়ে তার জ্ঞান ভাসাভাসা।
৩. নিজে থেকে মূল্যায়ন করুন, যার কাছে পরামর্শ নিতে যাচ্ছেন তিনি শিক্ষা-দীক্ষা, প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতার দিক থেকে আদৌ আপনাকে কোনো সহায়তা জোগাতে পারবেন কি না।
বিনিয়োগকারীর উচিত পরামর্শদাতাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে বা পরোক্ষভাবে আরও কয়েকটি প্রশ্নের জবাব জেনে নেওয়া:
১. পরামর্শদাতা পরামর্শ প্রদানকেই পেশা/ব্যবসা হিসেবে বেছে নিলেন কেন?
২. পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের অভিলক্ষ্য কী?
৩. অ্যালার্ম ক্লক ছাড়া আর কোনো বস্তু পরামর্শদাতার বিছানার পাশে থাকে?
৪. পরামর্শদাতার বিনিয়োগ দর্শন কী?
৫. কোনটি পরামর্শদাতার বেশি প্রিয় কমন স্টক নাকি মিউচুয়াল ফান্ড?
৬. পরামর্শদাতা কি বাজার বিশ্লেষণে প্রাযুক্তিক সহায়তা নেন?
৭. তিনি কি বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেন? (৬ ও ৭ নং প্রশ্নের জবাব ‘হ্যাঁ’ হলে আগ বাড়াবেন না। এ বইটি পড়া থাকলে ভদ্রলোককে আপনার দরকার নেই।)
৮. পরামর্শদাতার ফোকাস কিসে শুধু অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট নাকি আয়কর, রিয়েল এস্টেট, রিটায়ারমেন্ট প্ল্যানিং, বাজেট, ঋণ ব্যবস্থাপনা, বিমা প্রভৃতি ইস্যুতেও পরামর্শ দেন তিনি?
৯. পরামর্শদাতার শিক্ষা-দীক্ষা, অভিজ্ঞতা ও অন্যান্য অর্জন কি বর্তমান পেশার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ? হলে তার কতটুকু আপনার কাজে আসবে বলে বিশ্বাস করেন?
একটি কথা না বললেই নয়। আপনার বিনিয়োজিত অর্থের পরিমাণ ১ লাখ ডলারের কম হলে উপযুক্ত আর্থিক পরামর্শদাতা খুঁজে পাওয়া কঠিন। সেক্ষেত্রে হয়তো পরামর্শের প্রয়োজনও হবে না আপনার। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে যদি দরকার হয় ও পরামর্শ ফি দেওয়ার মতো অর্থ না থাকে, স্বল্পব্যয়ের বৈচিত্র্যপূর্ণ ইনডেক্স ফান্ডের সহায়তা নিতে পারেন। আর এ বইটি যদি আয়ত্তে এসে যায়, তাহলে আরও ভালো।
সফল ও উপযুক্ত আর্থিক পরামর্শক গাছে ধরে না। প্রায়ই দেখবেন পরামর্শদাতার সাফল্য যত বেশি, তার দরজার সামনে গ্রাহকের ভিড়ও তত। সেক্ষেত্রে উল্টো বিনিয়োগকারীকে পরামর্শদাতার কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। যেমনঃ
১. কেন অনুভব করছেন যে আপনার একজন পরামর্শদাতা আবশ্যক?
২. আপনার দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ পরিকল্পনা শুনি।
৩. নিজে থেকে সমাধান করতে গিয়ে কোথায় আটকেছেন? অন্য কারও পরামর্শ নিয়েছিলেন? তাতে কাজ হয়নি?
৪. আপনার বাজেট কী পরিমাণ?
৫. আপনার ব্যয় কি আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ?
৬. মোট সম্পদের কত অংশ প্রতি বছর ব্যয় হয়?
৭. (যদি দায়িত্ব নিই), কোন কোন অর্জন পেলে আপনি খুশি হবেন? আগামী এক বছরে বিনিয়োগ পোর্টফোলিও’তে কেমন উন্নতি দেখতে চান আপনি?
৮. কারও সঙ্গে দ্বিমত হলে কীভাবে তার নিরসন করেন?
৯. কোনো মন্দা বাজার পেয়েছিলেন? পেয়ে থাকলে কীভাবে (ইমোশনাল হ্যান্ডলিং) সামলেছিলেন তা?
১০. আপনার সবচেয়ে বড় আর্থিক ভীতি কোনটি?
১১. আর্থিক উচ্চাভিলাষ আছে? থাকলে কোন সীমা পর্যন্ত?
১২. আপনার দৃষ্টিতে চলতি বাজারে কী পরিমাণ রেট অব রিটার্নকে যৌক্তিক বলা যায়?
যদি দেখেন পরামর্শদাতা এসব প্রশ্ন করছেন না, তাহলে হয় আপনার পোর্টফোলিও’র প্রতি তার আগ্রহ কম (কিংবা মাঝারি মানের পরামর্শদাতার বেলায় তার গ্রাহক সংকট চলছে)। অবশ্য পরামর্শদাতার আপনার বিনিয়োগের ব্যাপারে আগ্রহ আছে কি নেই, সেটি তার আচরণ দেখেও বুঝতে পারবেন আপনি। তবে কাক্সিক্ষত পরামর্শদাতা যদি হাতের নাগালে না পান, মন খারাপের কিছু নেই। কেননা সূক্ষ্মভাবে দেখলে, সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের বেলায় একজন পরামর্শদাতার প্রয়োজন হয় প্রধানত যে কোনো বিনিয়োগকারীর সবচেয়ে বড় শত্রু তথা নিজের ভুল সিদ্ধান্ত থেকে সুরক্ষার জন্য। শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ, লেখক নিক মারে একবার বলেছিলেন, ‘বিনিয়োজিত অর্থের ব্যবস্থাপনার জন্য কেউ উপদেষ্টা রাখে না, রাখে নিজেকে সুব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে।’ আরেক ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালিস্ট রবার্ট ভারিস বলতেন, ‘পরামর্শদাতা হচ্ছেন বিনিয়োগকারীর মূর্খতার প্রতি ঝোঁক ও বুদ্ধিমান সিদ্ধান্তের প্রতি আকর্ষণের মধ্যকার দেয়াল।’ তবে ভুল থেকে বিরত রাখার সর্ববৃহৎ প্রতিবন্ধকতা হলো বিনিয়োগকারীর নিজের বিবেচনা। লক্ষ করুন, সিকিউরিটিজসহ যে কোনো বিনিয়োগে তিনটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া জরুরি। এগুলো হচ্ছে :
এক. সংক্ষিপ্ত অথচ সুস্পষ্ট অর্থায়ন তথা বিনিয়োগ পরিকল্পনা: যেখানে উল্লেখ থাকবে বিনিয়োগকারীর আয়ের উৎস ও পরিমাণ এবং সঞ্চয়, ব্যয়, ঋণ ও বিনিয়োগপ্রবণতা প্রভৃতি বিষয়।
দুই. মৌলিক বিনিয়োগ নীতি: এর মধ্য দিয়ে মূলত প্রকাশিত হয় বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ উদ্দেশ্য ও বিনিয়োগ পদ্ধতি।
তিন. অ্যাসেট-অ্যালোকেশন প্ল্যান: প্রত্যেক বিনিয়োগকারীরই অ্যাসেট-অ্যালোকেশন পরিকল্পনা থাকা উচিত। তাতে করে কোন ইনভেস্টমেন্ট ক্যাটাগরিতে কী পরিমাণ অর্থ আছে এবং সংগতি রক্ষার জন্য আসলে কতটা রাখা উচিত, সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা মিলবে।
যে কোনো ভালো বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের জন্য ওই তিন ভিত্তি শক্ত হওয়া জরুরি। সমস্যা হলো, সময়ের অভাবে কিংবা বাজারকে জানার অনাগ্রহ থেকে অথবা নেহাত প্রয়োজনে আলোচ্য তিনটি বিষয়ের প্রতি একসঙ্গে সমানভাবে দৃষ্টি রাখা সম্ভব হয়ে ওঠে না অনেক সময়। সেক্ষেত্রে পরামর্শদাতার উপদেশ শোনা ছাড়া গতি থাকে না বটে। তবু আবারও বলছি, পরামর্শ প্রদানকারীর সততা ও যোগ্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে (এ বইয়ে উল্লিখিত বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীর মৌলিক বৈশিষ্ট্যাবলির আলোকে) কখনোই তার পরামর্শ মোতাবেক ঝাঁপিয়ে পড়বেন না। আবার নিছক ভালো না লাগলে বা মনে সামান্য খটকা লাগলেও সে ফ এড়িয়ে চলুন পরামর্শদাতার সদুপদেশ।
Add Comment