বেনজামিন গ্রাহাম: দ্য ইনটেলিজেন্ট ইনভেস্টর

 

পূর্বের প্রকাশের পর…………

শেয়ারবাজারে কিছু মুহূর্তে চোখ বুজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন আপনি। কখনও কখনও আবার চোখ-কান খোলা না রাখলে সমূহ বিপদ। কখন চোখ বন্ধ রাখবেন, আর কখন খোলা রাখবেন সে বিষয়ে কিছু উপদেশ ঝেড়েছি। আর এ আলোচনায় বিনিয়োগকারীর সাইকোলজি সম্পর্কে বাক্যালাপ অবধারিত। একজন বিনিয়োগকারীর সবচেয়ে বড় শত্রু হলো তার মেজাজ ও মগজ। কথাটি বর্তমান সময়ে আরও বেশি প্রযোজ্য। মন্দা বাজারে রক্ষণশীল ভাব ধরে নিষ্ক্রিয় হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন, তা হবে না। বিনিয়োগ করতে চাইলে ভালো-মন্দ শেয়ার কিনতেই হবে আপনাকে। গায়ে লাগাতেই হবে মন্দা বাজারের উত্তাপ। আমার বিশ্বাস, কারও যদি মোটামুটি চলনসই জ্ঞান-বুদ্ধি থাকে, তিনি যদি আমার কথাগুলো আত্মস্থ করতে সমর্থ হন কাজে আসবে বইটি। সফল বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপযুক্ত মানসিকতা গড়ে তুলতে পারবেন পাঠকরা। আমি কিন্তু বহু সাধারণ বিনিয়োগকারীকে ওয়ালস্ট্রিটে দেখেছি, যারা ফাইন্যান্স, অ্যাকাউন্টিং ও স্টক মার্কেটের ওপর বিশাল ডিগ্রিধারীদের চেয়ে ভালো করেছেন।

 

শেয়ারবাজারে অনেক বিনিয়োগকারী ঘোল দেখলেই পালায় 

লক্ষণীয়, অ্যালকোয়ার ভবিষ্যৎ ব্যয় ও লোকসানেরই ইঙ্গিতবাহী উল্লিখিত প্রতিটি আইটেম। এগুলো কিন্তু ১৯৭০ সালের নিয়মিত পরিচালন ব্যয় (রেগুলার অপারেটিং কস্ট) নয়। সেক্ষেত্রে কোথায় রাখা যেত ওসব ব্যয় ও লোকসান? ব্যয়গুলো কি এতই ‘অসাধারণ’ (এক্সট্রাঅর্ডিনারি) ও ‘আবর্তনহীন’ (নন-রিকারিং) ছিল যে, স্পেশাল চার্জ ছাড়া অন্য কোথাও রাখা যেতো না সেগুলো? অ্যালকোয়া বিশাল প্রতিষ্ঠান। এটির বার্ষিক ব্যবসাই আনুমানিক ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের। নিঃসন্দেহে অনেকগুলো ডিভিশন, ডিপার্টমেন্ট, অ্যাফিলিয়েট (সহযোগী) কিংবা এমন আরও কিছু আছে। আবার পরিবেষ্টনী দেয়াল নির্মাণে আসা যাক। প্রকল্পটি কি এতই যুগান্তকারী যে, সাময়িকভাবে বড় ব্যয় ও ক্ষতি স্বীকার করে হলেও তা সম্পন্ন করতে চায় অ্যালকোয়ার পরিচালনা পর্ষদ? তবে আমি আরেকটি উল্টো প্রশ্ন রাখতে চাই। সেটি হলো, জরুরি মনে করে প্রকল্পটির ব্যয়ভার যদি অ্যালকোয়া কর্তৃপক্ষ প্রাইমারি আর্নিং পার-শেয়ারেই রাখতে চায়, তাতে অসুবিধা কোথায়? একটি কোম্পানি কি শুধু ভালো ভালো দিকই তুলে ধরবে বার্ষিক প্রতিবেদনে? সেখানে চলমান বাস্তবতার প্রতিফলক কোনো ব্যয় বা লোকসান থাকবে না? আমি বিশ্বাস করি, একজন ফাটকাবাজই শুধু কোম্পানির ইতিবাচক দিক অনুসন্ধান করবে। আর বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণের পর ওই কোম্পানির ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই উদ্ভাসিত হবে বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীর সামনে। ব্রিটিশ রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডের মতো কেবল রোদেলা দিন খুঁজবেন না তিনি। অত্যন্ত প্রিয় এক সূর্যঘড়ি ছিল এই রাজার। সম্ভবত এই অনুপ্রেরণা তিনি পান লেখক উইলিয়াম হ্যাজলিটের নিবন্ধ থেকে। ইতালির ভেনিস ভ্রমণ শেষে হ্যাজলিট লেখেন নগরীর অপূর্ব সূর্যঘড়ির কথা; যে ঘড়িটি সৌভাগ্যময় দিনের প্রতীক ও দুর্ভাগ্যের রজনীতে আত্মগোপনকারী। শেয়ারবাজারেও আপনি এমন অনেক বিনিয়োগকারী পাবেন, যারা ননী-মাখন অনুসন্ধান করে কেবল; অথচ ঘোল দেখলেই পালিয়ে যায়। ফলে কোম্পানি ব্যবস্থাপকদের মানসিকতাও হয়েছে এমন যে, তারা কেবল ননীটুকুই (লাভের পরিমাণ) দেখাতে চান, লুকিয়ে রাখেন ঘোলকে (লোকসান)। আর এরাই বৃহৎ লোকসান লুকিয়ে রাখেন ব্যয় তালিকার ‘এক্সট্রাঅর্ডিনারি’ বা ‘নন-রিকারিং’ ক্যাটাগরিতে। দুর্ভাগ্যশবত, ভালোমন্দ উভয় দিনেই বাজারে যেতে হয় আমাদের বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীকে।

অ্যালকোয়ার বার্ষিক প্রতিবেদনের দুটি অসাধারণ দিক দেখুন। এক. তারা হুট করে এক প্রান্তিকে বড় ব্যয় ভবিষ্যৎ লোকসানকে (নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য) সমন্বয় করে ফেললো বর্তমানের সঙ্গে।

ব্যয়টি অবশ্যই ১৯৭০ সালের নয়। কেননা ব্যয়িত বিষয়ে পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি ১৯৭০ সালে। দুই. আগেই যেহেতু ব্যয় দেখানো হয়ে গেছে, সেহেতু প্রকৃতপক্ষে যে বছর ব্যয়টা কার্যকর হবে, সে বছরে বাস্তবে ব্যয় হলেও কার্যত তার কোনো প্রভাব থাকবে না সেই বছরের শেয়ারপ্রতি আয়ে। চমৎকার! অসাধারণ! কিন্তু একই সঙ্গে বোঝার জন্য বিভ্রান্তিকর।

কৌতূহলোদ্দীপক, ফুটনোটে অ্যালকোয়া একেবারেই লেখেনি ভবিষ্যৎ কর সাশ্রয়ের (ফিউচার ট্যাক্স সেভিং) বিষয়ে। সাধারণত ফুটনোটে স্পেশাল চার্জে কর-পরবর্তী প্রভাবের (আফটার ট্যাক্স ইফেক্ট) কথা উল্লেখ করে থাকে বৃহৎ কোম্পানিগুলো। সেখানে স্পেশাল চার্জ দেখানোই হয় কর কর্তনের পরবর্তী পরিমাণ হিসেবে। আমি নিশ্চিত জানি না, অ্যালকোয়া কর্মটি সম্পাদন করেই স্পেশাল চার্জের পরিমাণ উল্লেখ করেছে কি না। যদি করে থাকে, তাহলে কিন্তু অ্যালকোয়ার শেয়ারপ্রতি ভবিষ্যৎ আয় আরও কমপক্ষে ৫০ শতাংশ বেশি হবে প্রাক্কলিত আয়ের তুলনায়। শতভাগ নিশ্চয়তা দেবো না, কিন্তু এসব দেখে আমার মনে হয় অ্যাকাউন্টিং কারসাজির আশ্রয় নেয়নি অ্যালকোয়া। এখানে বলে রাখা ভালো, কিছু কোম্পানি অতীত লোকসান যুক্ত করে দেয় ‘স্পেশাল আইটম’-এ। তবে এক্ষেত্রে অসুবিধা হলো, সেগুলো কিন্তু পুনরায় আবির্ভূত হবে নিট ইনকাম ফিগারে।

কিন্তু তারপরও কয়েকটি অসংগতির বিষয়ে মনে খচখচানি রয়েই যাচ্ছে। আমার ধারণা, এর ব্যাখ্যা ভিন্ন। খেয়াল করুন, অ্যালকোয়াই শুধু নয়, এর মতো আরও বেশকিছু কোম্পানি ১৯৭০ সালের ব্যালান্স শিটে সব স্পেশাল চার্জ নিয়ে যুক্ত করেছে বছরের শেষ প্রান্তিকে। অর্থাৎ ১৯৭০ সালের প্রথমার্ধে যে বিনিয়োগকারীরা অ্যালকোয়া এবং তেমন কোম্পানিগুলোর সিকিউরিটি অ্যানালাইসিস করেছেন, তাদের আতঙ্কিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। স্পষ্টত ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেদের আর্থিক অবস্থা ‘শোচনীয়’ হিসেবে দেখাতে চাইছেন এরা। সহজে অনুমেয় অথচ কোম্পানিগুলো সম্পর্কে অত্যন্ত ভালো ধারণা পাবেন ১৯৭১ ও ৭২ সালের বিশ্লেষকরা। বলার অপেক্ষা রাখে না, একশ্রেণির কোম্পানি কিন্তু সব শেয়ারবাজারেই আছে যারা আয় বা স্ট্যাটাস ভেদে বিনিয়োগকারী টার্গেট করে না, তাদের টার্গেট কোনো এক সময় তথা বছরের বিনিয়োগকারীরা। কী সুন্দর অ্যাকাউন্টিং আর কী অসাধারণ ব্যবসা নীতি ও ম্যানেজমেন্ট-শেয়ারহোল্ডার সম্পর্ক।

নগণ্য সন্দেহ এখনও আছে আমার। তার পুরোটাই ফুটনোট ঘিরে। আমার পর্যবেক্ষণ, কোম্পানিগুলো বছরের কোনো না কোনো সময় বৈচিত্র্যময় লাভজনক বা অলাভজনক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পড়ে। আর তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে ফুটনোটের ওপর। ফুটনোটগুলো ব্যাখ্যায় বড় হয়ে যায় তখন। নাম বলবো না, নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের এক জায়ান্ট কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদনে একবার দেখলাম ওই বছর স্পেশাল আইটেম বাবদ সাকুল্যে তাদের ব্যয় হয়েছে আনুমানিক ২৩ লাখ ৫৭ হাজার ডলার; যেটি আবার মোট আয়ের (চার্জ বাদে) এক-তৃতীয়াংশ। আর এই স্পেশাল আইটেমের তালিকায় কী কী ছিল শুনবেন যুক্তরাজ্যের এক কোম্পানির কর্মকাণ্ড বন্ধকরণ, শিশুদের প্যান্ট উৎপাদক কোম্পানি ক্রয়, স্প্যানিশ রেন্ট-এ-কার বাবদ ব্যয় ও স্কি-বুট কারখানা বন্ধে লোকসান!

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০