পূর্বে প্রকাশের পর…
বিশ্বখ্যাত কলম্বিয়া বিজনেস স্কুলের শিক্ষক বেনজামিন গ্রাহাম সম্ভবত তার সেরা ছাত্র ওয়ারেন বাফেটের তুলনায় কম পরিচিত। তবে বাফেট বলেছেন, গ্রাহাম লিখিত ‘দ্য ইনটেলিজেন্ট ইনভেস্টর’ বিনিয়োগের ওপর অতুলনীয় শ্রেষ্ঠ বই। আর গ্রাহাম বলেছেন, যেকোনো চমৎকার জিনিসই একই সঙ্গে প্রাপ্তির বেলায় বিরল ও বোঝার জন্য কঠিন। এ বই তার ব্যতিক্রম নয়। তবু কেন পড়বেন? জবাবটা গ্রাহামের মুখেই শুনুনÑ কোনো বিষয়ের দাম ও মূল্য এক নয়। দাম হলো যার বিনিময়ে আপনি কিছু কিনবেন, আর তার পরিবর্তে যা মিলবে, সেটি হলো জিনিসটির মূল্য।
মার্কিন শেয়ারবাজারের ঐতিহাসিক মূল্যায়ন
[হালের পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে কয়েকজন ধারাভাষ্যকারের সহায়তায় গ্রাহাম লিখিত ‘মার্কিন শেয়ারবাজারের ঐতিহাসিক মূল্যায়ন’ অধ্যায়টিকে এখানে চলতি শতাব্দী পর্যন্ত বর্ধিত করা হলো। তাতে তার বক্তব্যের সারাংশ কিংবা বিশ্লেষণ এতটুকুও ক্ষুণœ হয় না। উল্লেখ্য, চলতি সংস্করণের এ অধ্যায়ে একটি সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন গ্রাহাম। সংস্করণটি বেরুনোর দুই বছর পর (১৯৭৩-৭৪ সাল) বেয়ার (ভল্লুক) মার্কেটের ধাক্কায় ওয়ালস্ট্রিটে শেয়ারের মূল্যমান হ্রাস পায় গড়ে ৩৭ শতাংশ হারে। গ্রাহামের নিছক অনুমান ছিল না সেটা। বরং তা ছিল যুক্তি ও বিশ্লেষণনির্ভর ভবিষ্যৎ দর্শন। তখন থেকে এখন পর্যন্ত বিশেষত গ্রাহামের এই অধ্যায়টির মন্ত্রমুগ্ধ অনুরক্ত বহু মার্কেট-গুরু। কেবল এ অধ্যায়টির ওপর ভিত্তি করেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেস্টসেলার বই প্রকাশিত হয়েছে অন্তত কুড়িটি। আমাদের আগ্রহী পাঠককে ওসব বইয়ের কিঞ্চিত রস আস্বাদন করানোর ইচ্ছা থেকেও গ্রাহামের বক্তব্য অবিকৃত রেখে কিছু ক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছে ধারাভাষ্যের সহায়তা।]পুঁজিবাজার দুর্দান্ত ও প্রকাণ্ড প্রতিষ্ঠান। আর একেকজন বিনিয়োগকারী তার অংশগ্রহণের ধরন অনুযায়ী সেই প্রকাণ্ড বৃক্ষের ডালপালা তথা ক্ষুদ্র ব্যবচ্ছেদ। যৌক্তিক পাঠক নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, শেয়ারবাজার নামক এই উত্তাল সমুদ্রে টিকে থেকে সামনে এগোনোর জন্য যৎসামান্য নয়, শেয়ারবাজারের (এখানে মার্কিন শেয়ারবাজার) ইতিহাস সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা থাকা আবশ্যক। তাতে বাজারে মূল্যস্তরের বড় ধরনের ওঠানামা আঁচ করা সহজ হবে; বোঝা যাবে, কোন কোন বিষয়ের ওপর নির্ভর করে শেয়ারের মূল্য। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, অনুকূল ও প্রতিকূল উভয় সময়ে শেয়ার থেকে আয় ও লভ্যাংশের আন্তসম্পর্ক কেমন থাকে এবং পাশাপাশি এ দুটি উপাদানের সঙ্গে গোটা বাজারের আন্তসম্পর্ক নির্ণয়ের জন্য সংক্ষিপ্তাকারে হলেও শেয়ার বাজারের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকগুলো জানা জরুরি। আর এসব ঐতিহাসিক তথ্যাদি বা ব্যাকগ্রাউন্ড যার যত ভালো স্মরণে থাকবে, তার পক্ষে বাজারের কোন পর্যায়ে কোন শেয়ারের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া উচিত ও কোন শেয়ার থেকে তখন দূরে থাকা ভালো প্রভৃতি বিষয়ে নিজস্ব বিচার-বিবেচনা তৈরি হবে দ্রুত। সৌভাগ্য, ১৮৭১ সাল থেকে শুরু করে মার্কিন শেয়ার বাজারের বিভিন্ন শেয়ারের মূল্য, আয় ও লভ্যাংশ বিষয়ক তথ্যাদি আছে আমার কাছে। এর মধ্যে ১৯২৬ সালের আগ পর্যন্ত পাওয়া অনেক তথ্যই নির্ভরযোগ্য বলে মনে হয় না। তবু যেগুলো আছে সেগুলো দ্বারা কাজ চলবে। মোটা দাগে চলমান আলোচনা দুটো ধারায় অগ্রসর হয়েছে: এক. গত শতাব্দীর শেয়ারবাজারের সাধারণ হালচাল এবং দুই. বাজারের সঙ্গে তার গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক উপাদান তথা শেয়ার মূল্য, আয় ও লভ্যাংশের পারস্পরিক সম্পর্ক।
বিস্তারিত আলোচনা শুরুর আগে একটি বিষয় জোর দিয়ে বলা দরকার, এ অধ্যায়ে উপস্থাপিত বিশ্লেষণগুলো হুবহু-মুখস্থ বাজারের ওপর প্রয়োগ করতে যাবেন না। আগে দেখুন, যে ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে আপনি এই সিদ্ধান্ত নিতে চলেছেন, বিদ্যমান বাজার আসলেই তার উপযুক্ত কি না। আসল কথা হলো, কেবলমাত্র (আবারও বলছি কেবলমাত্র) অতীত বিশ্লেষণের ওপর ভর করে একজন বিনিয়োগকারী কখনোই যেন তার বর্তমান বা ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত না নেন। আর ঠিক এই ভুলটাই সংঘটিত হয় নব্বইয়ের দশকে। শেয়ারবাজার ঘিরে যারা ভবিষ্যদ্বাণী করেন, তাদের দুটি গ্রুপ (দল): প্রথম দল শেয়ারবাজারের ক্রমোন্নতির ব্যাপারে অতি-আশাবাদীÑএরা ষাঁড়ের পাণ্ডা (বুলিশ গ্রুপ); দ্বিতীয় দল বেশি-হতাশ এবং ভল্লুকের সহচর (বেয়ার গ্রুপ)। বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে, ওই সতর্কবার্তা ভুলে গিয়ে কেবল অতীত বিশ্লেষণের ওপর ভর করে ঠকেছেন বহু বিনিয়োগকারী। এক সময় ওয়ালস্ট্রিটে বুলিশ গ্রুপের অন্যতম নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন ফাইন্যান্সের অত্যন্ত সম্মানজনক হোয়ার্টন প্রফেসর জেরেমি সিগেল। ১৯৯৪ সালে তার প্রকাশিত বইয়ের নাম ‘স্টকস ফর দ্য লং রান’। একেবারে কাঁচা, বুনো আশাবাদে ভরপুর বইটি। মোটামুটি একই ঘরানার অন্যান্য বিখ্যাত বইয়ের মধ্যে রয়েছে জেমস গ্ল্যাসম্যান এবং কেভিন হাসেটের যৌথভাবে লেখা ‘ডাউ ৩৬০০’, ডেভিড এলায়াসের ‘ডাউ ৪০ হাজার’ এবং চার্লস ক্যাডলেক রচিত ‘ডাউ ১০০ হাজার’। এ বইগুলো প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯৯ সালে। দুর্ভাগ্যবশত ওই লেখকরা পুরোপুরি অতীতনির্ভর বিপজ্জনক পরামর্শ দিয়েছেন বিনিয়োগকারীদের। তাদের লেখা বইয়ের মূল বক্তব্য হলো, যেহেতু (মূল্যস্ফীতি বাদ দিলে) ১৮০২ সাল থেকে শেয়ার থেকে মোটামুটি সাত শতাংশ মুনাফা এসেছে, সেহেতু বিনিয়োগকারীরা সহজে ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এ আশাবাদ রাখতে পারেন যে, আগামীতেও ভালোই মুনাফা মিলবে শেয়ারবাজার থেকে। এ দলভুক্ত আরও কিছু পণ্ডিত মন্তব্য করেছিলেন একেবারে বেড়ে। তাদের যুক্তি, যেহেতু অন্তত ৩০ বছরের পরিসংখ্যান বলেÑপুঁজিবাজারের হাতে পরাস্ত হয়েছে বন্ড বাজার, সেহেতু বন্ড তো ছার, এমনকি ব্যাংকে পয়সা জমানোর চেয়েও কম ঝুঁকিপূর্ণ হলো শেয়ারে বিনিয়োগ। অবশ্যই (যথেষ্ট) দীর্ঘমেয়াদে পরিচালিত শেয়ার থেকে লাভ বৈ লোকসান হয় না। কিন্তু তারপরও, চূড়ান্ত বিচারে যে বস্তু মুনাফা দেবে তার জন্যও, প্রাথমিক অবস্থায় বেশি দামে শেয়ার কেনাটা কোনো বুদ্ধিমানের লক্ষণ নয়।
অনেক পাঠকের মনে থাকতে পারে, ১৯৯৯ ও ২০০০ সালের শুরুর কয়েক মাস ওয়ালস্ট্রিট সরব ছিল এই বুলিশ গ্রুপ প্রচারিত তত্ত্বে। টিভি চ্যানেল সিএনএন অর্থনীতিবিষয়ক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে যার নাম ‘মানি লাইন’। ১৯৯৯ সালের ৭ ডিসেম্বর ‘মানি লাইন’-এ উপস্থিত হন ফার্স্ট হ্যান্ড মিউচুয়াল ফান্ডের পোর্টফোলিও ম্যানেজার ও বুলিশ মার্কেট-গুরু কেভিন ল্যান্ডিস। এক পর্যায়ে উপস্থাপক তাকে বললেন, ‘অনেক বিনিয়োগকারী সম্ভবত ধরেই নিয়েছেন যে টেলিযোগাযোগ খাতের শেয়ার অসীমকাল পর্যন্ত উঠতে থাকবে। তাদের এই অতি-আশাবাদের প্রেক্ষাপটে কিছু শেয়ার অতিমূল্যায়িত (ওভারভ্যালুড) হয়েছে বলে মনে হয়। আপনি কি স্বাভাবিক বলবেন একে?’ মুচকি হেসে তাৎক্ষণিকভাবে ল্যান্ডিস জবাব দেন, ‘এটা পাগলামি নয় মোটেই। বিনিয়োগকারীরা পাগল হয়ে যাননি। আপনি শুধু বাজারের খাঁড়া প্রবৃদ্ধির (আউটরাইট গ্রোথ) দিকে তাকান একবার। দেখবেন, এর পরম মান (অ্যাবসল্যুট ভ্যালু) আসলেই বিশাল।’ আরেক অতি-আশাবাদী ভদ্রলোক কেমপার ফান্ডের চিফ ইনভেস্টমেন্ট স্ট্র্যাটেজিস্ট রবার্ট ফ্রোলিখ আবার ২০০০ সালের ১৮ জানুয়ারি ওয়ালস্ট্রিট জার্নালে মতামত দেন, ‘এ এক নতুন বিশ্বব্যবস্থা। অথচ আমরা দেখছি যে কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা উচিত, সেখানে বিনিয়োগ করছে না প্রচুর সংখ্যক বিনিয়োগকারী; যাদের কথা শুনলে লাভ হবে, শুনছেন না তাদের কথা; এবং আরও মারাত্মক হলো, তারা এক অন্ধ আত্মবিশ্বাসে মত্ত হয়েছেন যেÑতাদের ধারণাই সবচেয়ে সঠিক। আমি মনে করি, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের বেলায় এর চেয়ে নিকৃষ্টতম ভুল আর হতে পারে না।’ একই ভাবধারায় পুষ্ট লেহম্যান ব্রাদার্সের চিফ ইনভেস্টমেন্ট স্ট্র্যাটেজিস্ট জেফরি এম অ্যাপলগেট ২০০০ সালের ১০ এপ্রিল লেখেন ‘বিজনেস উই’কে। তার বক্তব্য, ‘অনেকে দুই বছর আগের তুলনায় বর্তমান শেয়ারবাজারকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করছেন শুধু এজন্য যে, ওই সময়ের তুলনায় বর্তমানে শেয়ারের দাম বেশি। যদি শেয়ারের দাম বৃদ্ধিই তাদের আপত্তির কারণ হয়ে থাকে তাহলে আমি বলবো, ভুল করছেন তারা।’ না, তারা ভুল করেননি। শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি অতীতেও শঙ্কার কারণ ছিল, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। প্রথম সংস্করণের এ অধ্যায়ে আমি লিখেছিলাম, পুঁজিবাজার সবসময়, শেষ পর্যন্ত শাস্তি দেয় মাথামগজহীন সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীকে। প্রবণতাকে দোষ দিচ্ছি না; এটা মানুষের প্রকৃতিগত ঝোঁক। সেটা হলো, মাঝেমধ্যে শেয়ারের দাম যখন দ্রুত উপরে উঠতে থাকে, কিছু বিনিয়োগকারী তখন স্বতঃসিদ্ধ অনুমান করে নেনÑএটা বাজারের ভগবদ্বত্ত অধিকার (ডিভাইন রাইট)। মধ্যযুগের অনেক রাজাই কিন্তু ভাবতেন সিংহাসনে তাদের বসার অধিকারটি ডিভাইন অর্থাৎ তাদের ধরে এনে সেখানে বসিয়েছেন ঈশ্বর। কিছু অতি-আশাবাদীর মনোভাবও অনেকটা ওই রকম। অথচ বাজার হচ্ছে একজন ক্রুদ্ধ রোমান দেবতার মতো, যিনি যারাই ধরে নিয়ে বসে থাকেন যে শেয়ারের দাম উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকবেÑতাদের ওপর হতাশা নামক শাস্তি বর্ষণ করেন। ল্যান্ডিস, ফ্রোলিখ ও অ্যাপলগেটের দেওয়া বক্তব্যগুলোর একটা ফলোআপ হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাতে বোঝা যাবে, আসলে কী ঘটেছিল তাদের আশাবাদের বিপরীতে। ল্যান্ডিসের প্রিয় কোম্পানি ছিল নকিয়া। তিনি বলতেন, বাজারে এর শেয়ারই সবচেয়ে স্থিতিশীল। ২০০০ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে নকিয়া হারায় ৬৭ শতাংশ বাজারমূল্য। ল্যান্ডিসের অন্য ফেভারিট উইনস্টার কমিউনিকেশন মূল্য হারায় আনুমানিক ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশ। ফ্রোলিখ ভাবতেন, শেয়ারবাজারে সিসকো সিস্টেমস ও মটোরোলা অপরাজেয়। অথচ ২০০২ সালের শেষভাগে এই দুই কোম্পানিরই শেয়ারমূল্য পড়ে যায় ৭০ শতাংশের মতো। এক সিসকোর শেয়ারেই বিনিয়োগকারীরা হারান মোট ৪০০ বিলিয়ন ডলার। সংখ্যাটিকে ছোট মনে হচ্ছে? পরিমাণটি কুয়েত, সিঙ্গাপুর, হংকং ও ইসরাইলের যৌথভাবে উৎপাদিত এক বছরের অর্থনৈতিক উৎপাদনের সমান। এদিকে ২০০০ সালের এপ্রিলে অ্যাপলগেট যখন দম্ভোক্তি করছিলেন, তখন ১১ হাজার ১৮৭-তে অবস্থান করছিল ডাউ সূচক (ডাউ জোনস ইন্ডাস্ট্রিয়াল এভারেজ বা ডিজেআইএ); ৪ হাজার ৪৪৬-তে ছিল নাসডাক কম্পোজিট ইনডেক্স। ২০০২ সালের শেষ দিকে অ্যাপলগেটকে দেখতে হয়েছে ডাউ ঘুরপাক খাচ্ছে ৮ হাজার ৩০০-তে; ক্রমাবনতি রোধে কোনো রকমে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে তার পতন। নাসডাকের অবস্থান তখন আরও খারাপ। মন্দা বাজার তাকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে নিয়ে ফেলেছে ১৩০০’র কোঠায়। উল্লেখ্য, নাসডাকের শেষ ছয় বছরের অর্জন পুরোপুরি শেষ হয়ে যায় ওই এক ধাক্কায়।
সুতরাং যারা বলেন, শেয়ারবাজার দীর্ঘমেয়াদে সবসময় বন্ড বাজারকে পরাজিত করেছেÑফাঁক রয়েছে তাদের দেখানো যুক্তি ও বিশ্লেষণে। ১৮৭১ সালের পূর্ববর্তী মার্কিন শেয়ারবাজারের তথ্য নিয়ে সংশয় রয়েছে অনেক। তবে যেসব তথ্য রয়েছে, সেগুলোও যদি বিশ্বাসযোগ্য বলে ধরে নিই, তবু দেখা যাবে ওই সময়ে ভালো রিটার্ন এসেছে মাত্র সাতটি কোম্পানি থেকে! ভাবতে পারেন, গুল মারছি। ১৮০০ সালেই মার্কিন পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ছিল কমপক্ষে ৩০০; এর মধ্যে মাত্র সাতটি কোম্পানি ভালো তা হয় কী করে? প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসনের যুগে আলোচিত ও আকর্ষণীয় শেয়ার ছিল টোল আদায় কেন্দ্র, খাল প্রভৃতি পরিচালনাকারী কোম্পানির। আজকের যুগের ওয়ালস্ট্রিটে গুগল, ফেসবুকের মতো তখনকার দিনে হট-কেকের মতো বিক্রি হয়ে যায় সেগুলো। কিন্তু যদি ভালোমতো খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন, ব্যাপক মুনাফা অর্জনকারী ওসব কোনো কোম্পানিরই নামগন্ধ পাওয়া যায় না ১৮৭১ সালের প্রাপ্ত তথ্যে। তার মানে, একে তো ওই কোম্পানিগুলো এ সময়ের মধ্যে দেউলিয়া হয়েছেই, উপরন্তু কোম্পানির লাল বাতি জ্বলায় মানে মানে কেটে পড়তে হয়েছে বিনিয়োগকারীদের। তাহলে ঐতিহাসিক তথ্যানুযায়ী মোটের ওপর কীভাবে অত ভালো পারফরম্যান্স দেখিয়েছিল পুঁজিবাজার? এর একটা ব্যাখ্যা আছে। যে কোনো পুঁজিবাজার সাধারণত ‘সারভাইভারশিপ বায়াস’-প্রবণ। সংক্ষিপ্তভাবে এর অর্থ হলো, (অতি-দীর্ঘমেয়াদে) শেয়ারবাজারে যে কোম্পানিগুলো ভালো করবে না, সেগুলো স্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবে। কিন্তু যেগুলো টিকে যাবে, সেগুলোর পারফরম্যান্স এতটাই ভালো হয় যে, সেগুলো এককভাবেই বৃহৎ আকারে বাড়িয়ে তোলে সামগ্রিক বাজারের পারফরম্যান্স। সেজন্যই ১৮০২ সালের বহু কোম্পানির হদিস মেলে না ১৮৭১ সালে এসে। ওগুলো ততদিনে বিলুপ্ত। তখন কেবল যেগুলো বাজারের ঝড়-ঝঞ্ঝা গায়ে সইতে পেরেছে, সেগুলো দাঁড়িয়ে গেছে মহীরুহের মতো। অর্থাৎ মার্কিন পুঁজিবাজারের ঊনবিংশ শতাব্দী বিশ্লেষণে পায়ে হেঁটে বাজারে আসা বিনিয়োগকারীরা অনেকটাই অনুপস্থিত। এদের লাভ-লোকসানের খতিয়ান ইতিহাস থেকেই সম্ভবত উবে গেছে। নিশ্চিতভাবেই এসব বিনিয়োগকারীর দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা ছিল। ফলে তারা দেখতে পাননি, কেনার জন্য মাত্র সাতটি কোম্পানির শেয়ারই উপযুক্ত। তবে তাদের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অসঙ্গত হবে। কেননা কয়েক শতাব্দী পরে এসে বুঝে ওঠা কঠিন, আসলে কেমন ছিল ওই সময়কার বিনিয়োগ পরিস্থিতি; তাছাড়া তখন বাজার সম্পর্কিত তথ্যেরও অবাধ যাতায়াত ছিল না। কিন্তু ওই সময়েও যাদের প্রখর ছিল দৃষ্টিশক্তি এবং বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বাজারে বিনিয়োগ করেছেন, তাদের নজর এড়ায়নি যে, এই ১৭৯০’র দশক থেকে বাজারে ভালো মুনাফা দিচ্ছে ব্যাংক অব নিউইয়র্ক ও জেপি মরগ্যান চেজ। অবশ্য এ দুজন লঞ্চ দুর্ঘটনায় অলৌকিকভাবে উদ্ধার পাওয়া যাত্রী। ইতিহাসে এই নগণ্য কয়েকজনের পাশেই কিন্তু শুয়ে আছেন হাজার হাজার ধরাশায়ী বিনিয়োগকারী ও ডিসমাল সোয়াম্প ক্যানাল কোম্পানি, পেনসিলভানিয়া কালটিভেশন অব ভাইনস কোম্পানি কিংবা স্নিকারস গ্যাপ টার্নপাইক কোম্পানির মতো রাঘববোয়ালরা।
বেশকিছু গোঁজামিল আছে প্রফেসর সিগেলের উপাত্ত বিশ্লেষণে। যেমনÑসেগেলের দাবি ১৮০২ থেকে ১৮৭০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর শেয়ার বিনিয়োগে মুনাফা এসেছে ৭ শতাংশ হারে, যেখানে বন্ডে মিলতো ৪ দশমিক ৮ শতাংশ রিটার্ন এবং ব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাব থেকে অর্জিত হতো কমবেশি ৫ দশমিক ১ শতাংশ হারে মুনাফা। লন্ডন বিজনেস স্কুলের ইলোরি ডিমসন ও তার সহকর্মীরা প্রফেসর সিগেলের দেওয়া এই বিশ্লেষণের সঙ্গে একমত নন। তাদের মতে, ওই বিশ্লেষণে প্রতি বছর অন্তত দুই শতাংশীয় পয়েন্ট (পার্সেন্টেজ পয়েন্ট) করে বেশি দেখানো হয় রিটার্ন হার। ১৮৪০ সালের দিককার মার্কিন শেয়ার সূচকের বিস্তৃত তথ্য মেলে। সে সময় আলোচিত ছিল সাতটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ২৭টি রেলওয়ের সংস্থার শেয়ার। জেসন জুইগ দেখান (এ বিষয়ে প্রথম সংস্করণেও ইঙ্গিত ছিল গ্রাহামের) ১৮৭১ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত সারভাইভারশিপ বায়াসের শিকার হয় মার্কিন শেয়ার সূচক। ওই সময়ের মধ্যে অনেকটা রাতারাতি বাজার সূচক থেকে হারিয়ে যায় কয়েকশ অটোমোবাইল, বিমান ও রেডিও কোম্পানি। জুইগের মতে, তখনকার রিটার্নেও ১ থেকে ২ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে প্রতি বছর।
সুতরাং বাস্তবতা বলে, শেয়ারে বিনিয়োগ সবসময় বন্ড বা ব্যাংকে বিনিয়োগ অপেক্ষা ভালো নয়। কিছু ক্ষেত্রে ভালো; আবার কিছু ক্ষেত্রে খারাপ। তারপরও যদি কেউ নিঃশর্তভাবে শেয়ারকে ভালোবেসে থাকেন, তা নির্বুদ্ধিতার শামিল। আর সেটি থেকে মুক্তি পেতে কয়েকটি প্রশ্নের যৌক্তিক ও সঙ্গত প্রত্যুত্তর খুঁজে পেতেই হবে বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীকে: এক. কোন অধিকার, আইন বা ক্ষমতাবলে শেয়ারের ভবিষ্যৎ রিটার্ন সবসময় অতীত রিটার্নের সমান হওয়া উচিত? দুই. আপনি বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, দীর্ঘমেয়াদে মুনাফা উপার্জনের জন্য শেয়ারবাজার একটি গ্যারান্টেড অথরিটি। এখন আপনার পাশের বিনিয়োগকারী ভদ্রলোকও যদি একই রকম ভাবতে শুরু করেন, শেয়ার কি অতিমূল্যায়িত হবে না? তিন. আর তা-ই যদি হয়, সেক্ষেত্রে আপনারা সবাই মিলে বাজারকে অতিমূল্যায়িত করবেন এবং সেখান থেকে প্রচুর মুনাফা উত্তোলনের স্বপ্ন দেখবেন, সেটি কী করে হয়?
কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে একটি বিষয় বোঝার চেষ্টা করুন। যে কোনো বিনিয়োগের মূল্য ওই বিনিয়োগের পেছনে পরিশোধিত অর্থযোগে গঠিত সমীকরণ। এর ওপর নির্ভর করে মুনাফার হার। কেউ যখনই বিনিয়োগের পেছনে অধিক মূল্য ব্যয় করবেন, তখনই কমবে মুনাফা। সহজ হিসাব। চলতি শতাব্দীর শুরুতেই মন্দার শিকার হয় ওয়ালস্ট্রিট। তার কারণ বুঝতে কয়েক বছর আগের বাজার প্রবণতার মূল্যায়ন জরুরি। ১৯৯০ দশকের শেষ দিকে মার্কিন অর্থনীতি থেকে কেটে যাচ্ছিল মূল্যস্ফীতির শঙ্কা। তখন তুলনামূলক শান্তিতে ছিল গোটা বিশ্ব। করপোরেশনগুলোর মুনাফাও হচ্ছিল দেদার। ওই সময় একদল বিনিয়োগকারী ভাবতে শুরু করেনÑব্যস, মুনাফা এখন শুধু বাড়তেই থাকবে লাফিয়ে লাফিয়ে। অথচ সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান বলে, কোনো কোম্পানির পক্ষেই অসীম মুনাফা অর্জন সম্ভব নয় কখনোই। এখন আপনি যে লাভের আশায় ওই কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করছেন, তাদের লাভই যদি অসীম না হয়, আপনার মুনাফা অসীম হবে কীভাবে? আর যে শেয়ার অসীম লাভ দিতে পারে না, সে শেয়ারকে গগনচুম্বী দাম দিয়ে কিনবেন কেন আপনি? এতেও পরিষ্কার না হলে আরেকটি উদাহরণ দিই। মাইকেল জর্ডানকে ধরা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়। এই কিংবদন্তিকে এক নজর দেখতে হাজার হাজার ভক্ত উপস্থিত হতেন শিকাগো স্টেডিয়ামে। কোনো এক বছর, বাস্কেটবল ভক্তরা নেতিবাচকভাবে নেবেন না, শুধু কাঠের মেঝের ওপর চামড়ার বলকে ড্রপ খাওয়ানোর জন্য মাইকেল জর্ডানের সঙ্গে ৩৪ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে শিকাগো বুলস (বাস্কেটবল ক্লাব)। শিকাগো বুলস কি সারা জীবন ৩৪ মিলিয়ন ডলার দিতেই থাকবে মাইকেল জর্ডানকে? যদি দেয়, জর্ডানের ব্যক্তিগত মুনাফা বাড়লেও ক্লাবটির অস্তিত্ব কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
প্রকৃতপক্ষে একসঙ্গে অনেক বিনিয়োগকারী যখন আস্থা রাখা শুরু করেন যে, এখন যেমন রিটা
Add Comment