বেনজামিন গ্রাহাম: দ্য ইনটেলিজেন্ট ইনভেস্টর

পূর্বের প্রকাশের পর………..

 

শেয়ারবাজারে কিছু মুহূর্তে চোখ বুজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন আপনি। কখনও কখনও আবার চোখ-কান খোলা না রাখলে সমূহ বিপদ। কখন চোখ বন্ধ রাখবেন, আর কখন খোলা রাখবেন সে বিষয়ে কিছু উপদেশ ঝেড়েছি। আর এ আলোচনায় বিনিয়োগকারীর সাইকোলজি সম্পর্কে বাক্যালাপ অবধারিত। একজন বিনিয়োগকারীর সবচেয়ে বড় শত্রু হলো তার মেজাজ ও মগজ। কথাটি বর্তমান সময়ে আরও বেশি প্রযোজ্য। মন্দা বাজারে রক্ষণশীল ভাব ধরে নিষ্ক্রিয় হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন, তা হবে না। বিনিয়োগ করতে চাইলে ভালো-মন্দ শেয়ার কিনতেই হবে আপনাকে। গায়ে লাগাতেই হবে মন্দা বাজারের উত্তাপ। আমার বিশ্বাস, কারও যদি মোটামুটি চলনসই জ্ঞান-বুদ্ধি থাকে, তিনি যদি আমার কথাগুলো আত্মস্থ করতে সমর্থ হন কাজে আসবে বইটি। সফল বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপযুক্ত মানসিকতা গড়ে তুলতে পারবেন পাঠকরা। আমি কিন্তু বহু সাধারণ বিনিয়োগকারীকে ওয়ালস্ট্রিটে দেখেছি, যারা ফাইন্যান্স, অ্যাকাউন্টিং ও স্টক মার্কেটের ওপর বিশাল ডিগ্রিধারীদের চেয়ে ভালো করেছেন।

 

ছোট কোম্পানির বড় কোম্পানি

অধিগ্রহণ প্রায়ই ইতিবাচক নয়

 

লিং-টেমকো-ভট ইনকরপোরেশন

লিং-টেমকো-ভট ইনকরপোরেশন (এলটিভি) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৫ সালে। এর প্রতিষ্ঠাতা বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের ঠিকাদার জেমস জোসেফ লিং। তিনি নিজেই নিজের ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকারে পরিণত হন টেক্সাস স্টেট ফেয়ারে স্টক বুথ স্থাপন করে। ওই বুথে বিক্রি হয় প্রায় ১ মিলিয়ন ডলারের শেয়ার। ওই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে কয়েক ডজন কোম্পানি অধিগ্রহণ করেন তিনি। সেগুলোর প্রতিটি কেনা হয়েছে এলটিভির শেয়ার বেচা পয়সা দিয়ে। মজার বিষয়, এলটিভি যত বেশি কোম্পানি অধিগ্রহণ করতো, ততোই বাড়তো এর শেয়ারদর। আর এলটিভির শেয়ারদর যতো বেশি হতো, ততোই বাড়তো এর অধিগ্রহণ ক্ষমতা। ১৯৬৯ সালে বৃহৎ মার্কিন করপোরেশনের তালিকা তৈরি করে ফরচুন ৫০০। সেখানে এলটিভির অবস্থান ছিল ১৪ নম্বরে। এর পরই শুরু হয় পতন। আকাশ ছোঁয়ার লক্ষ্য নিয়ে নামা এ কোম্পানি নিমজ্জিত হয় ভয়ংকর লোকসানসহ নানাবিধ আর্থিক ঝামেলায়। অন্যদের অভিজ্ঞতা ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু এলটিভির উত্থান ও পতন আমাকে সতর্ক থাকতে বলে ইয়াং জিনিয়াসদের ব্যাপারে। কেননা এরা প্রথমে দ্রুত এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলে; পরে সেই সাম্রাজ্যের পতন ঘটে আরও দ্রুততার সঙ্গে। এলটিভির পতনের হেতু রয়েছে আয় হিসাব ও একাধিক ব্যালান্স শিট আইটেমে। সেসব খুঁজতে আবার এগোতে হবে ১৯৫৮ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর ধরে ধরে:

এক. নিরবচ্ছিন্ন ছিল না এলটিভির বিস্তারকাল। ১৯৬১ সালে দেখা দেয় এর পরিচালন ঘাটতি। সেই ঘাটতি দূরীকরণে আবার এলটিভি গৃহীত কৌশল ব্যাপক সমালোচিত হয় ১৯৭০ সালে নেতৃস্থানীয় প্রায় সব মার্কিন পত্রপত্রিকায়। কার্যত অ্যাকাউন্টিং কারসাজির মাধ্যমে কোম্পানির পূর্ববর্তী সব লোকসান ও চার্জকে নিয়ে আসে একটি নির্দিষ্ট বছরে। এ অপকৌশলকে বলা হয় অ্যাকাউন্টিং কিচেন সিংক। ১৯৬৯ সালে এলটিভির সামগ্রিক ব্যয় ও লোকসান ছিল আনুমানিক ১৩ মিলিয়ন ডলারের, যা পরবর্তী তিন বছরের (১৯৬৯-৭১ সাল) নিট মুনাফার সমান। আরেকটি সন্দেহজনক বিষয়, এই একই কোম্পানি কিন্তু উদগ্রীব হয়ে ১৯৬২ সালে রেকর্ড আয় দেখায় নিজেদের বার্ষিক প্রতিবেদনে।

দুই. ১৯৬৬ সালে এলটিভির নিট ট্যানজিবল অ্যাসেট (দৃশ্যমান সম্পদ) দেখানো হয় শেয়ারপ্রতি ৭ দশমিক ৬৬ ডলার। প্রকৃতপক্ষে তা সমন্বিত ছিল ২ থেকে ৩ শেয়ার স্ট্রিটের (দুটি শেয়ারকে ভাগ করে তিনটি বানানো) জন্য। ভিত্তিটি ভঙ্গুর নিঃসন্দেহে। অথচ এর ওপর ভর করেই ১৯৬৭ সালে এলটিভির শেয়ার বিক্রি হয় তার সম্পদ মূল্যের (অ্যাসেট ভ্যালু) ২২ গুণ বেশি দামে! এদিকে একই সময়ে কোম্পানির আর্থিক বিবৃতিতে ভেসে ওঠে বন্ড-ডিসকাউন্ট অ্যাসেট। এগুলো হচ্ছে সেই ধরনের বন্ড, এলটিভি যা কিনে নেয় পার ভ্যালুর নিচে এবং পরবর্তী সময়ে ওই ডিসকাউন্টকেই বিবেচনা করতে থাকে অ্যাসেট হিসেবে এ ভিত্তিতে যে, আগামীতে পার ভ্যালুতেই বিক্রি হবে সেসব বন্ড। অথচ যে বন্ড পার ভ্যালুর নিচে কেনাবেচা হয়, সেগুলো সম্পদ নয়Ñদায়।

তিন. ১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেরা দুই ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের কাছে এলটিভি বিক্রি করে ৬ লাখ শেয়ার, প্রতিটি ১১১ ডলারে। এতে করে এলটিভি শেয়ারের মূল্যস্তর উন্নীত হয় ১৬৯ দশমিক ৫০-এ। এরপর মাত্র তিন বছরের মাথায় ৭ দশমিক ১২৫-এ নামে শেয়ারটির দাম।

চার. ১৯৬৭ সাল শেষে ১৬১ মিলিয়ন ডলার স্বল্পমেয়াদি ব্যাংক ঋণ ছিল এলটিভির। ১৯৬৮ সালে ৪১৪ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয় পরিমাণটি। এদিকে এলটিভির ১২৩৭ মিলিয়ন ডলার ছিল দীর্ঘমেয়াদি ঋণ।

পাঁচ. কেবল ১৯৬৯ ও ১৯৭০ সালে এলটিভি যে পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়, সেটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে কোম্পানির অর্জিত মোট মুনাফার তুলনায় অনেক বেশি।

এলটিভির কেস হিস্ট্রি আমাদের প্রাথমিকভাবে শিক্ষা দেয়, প্রতিষ্ঠানের সম্প্রসারণ পর্যায় অতিক্রমকালে বাণিজ্যিক ব্যাংকারদের প্ররোচিত করে কী পরিমাণ ঋণ তুলে নেওয়া সম্ভব বাজার থেকে। সে সময় দুর্বল সম্প্রসারণকে ঝুঁকিপূর্ণ আখ্যা দিয়ে ব্যাংকগুলো যদি অর্থায়ন থেকে বিরত থাকতো, তাহলে হয়তো ছোট কিন্তু শক্তিশালী কোম্পানি হিসেবে টিকে যেতো এলটিভি।

 

এনভিএফের শ্যারন স্টল অধিগ্রহণ

১৯৬৮ সাল শেষে এনভিএফ ছিল ৪ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেওয়া একটি কোম্পানি, যার শেয়ার পুঁজি (স্টক ক্যাপিটাল) ১৭ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার; বিক্রি ৩১ মিলিয়ন ডলার; আর (৩ লাখ ৭৪ হাজার ডলারের বিশেষ ঋণ নেওয়ার আগে) নেট ইনকাম ছিল ৫ লাখ ২ হাজার ডলার। বার্ষিক প্রতিবেদনে এনভিএফের ব্যবসায়িক প্রকৃতি সম্পর্কে লেখা আছে ভ্যালকানাইজড ফাইবার অ্যান্ড প্লাস্টিকস। কী মনে করে একবার এনভিএফের পরিচালনা পর্ষদ সিদ্ধান্ত নেয়, শ্যারন স্টিল করপোরেশনকে কিনবে তারা। এই মতলব আঁটাকালে শ্যারনের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ছিল ৪৩ মিলিয়ন ডলার; স্টক ক্যাপিটাল ১০১ মিলিয়ন ডলার; বিক্রি ২১৯ মিলিয়ন ডলার ও নিট আয় (আর্নিং) ২৯ লাখ ২৯ হাজার ডলার। দেখতেই পাচ্ছেন, এনভিএফ যে কোম্পানিকে অধিগ্রহণ করতে চাইছে, সেটির আকার তার নিজের চাইতে সাতগুণ বড়। অবশেষে ১৯৬৯ সালে শ্যারনের সব শেয়ার কেনার অফার দেয় এনভিএফ। অধিগ্রহণ ঠেকানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে শ্যারন ম্যানেজমেন্ট। তবে লাভ হয়নি। এক অফারেই এনভিএফ কিনে নেয় শ্যারনের ৮৮ শতাংশ শেয়ার। কীভাবে তা সম্ভব হলো, সেটি প্রকাশ পায় পরে। ১৯৭২ সালে একজন ফেডারেল বিচারকের কাছে অন্য মামলায় বিচারাধীন থাকাকালে এনভিএফের চেয়ারম্যান ভিক্টর পজনার বেফাঁস মন্তব্য করেন শেয়ার কেনার জন্য প্রথমেই শ্যারনের পেনশন অ্যাসেটকে অন্যত্র সরিয়ে ফেলেন তিনি এবং তার সঙ্গে শ্যারনের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার যোগসাজশ ছিল। সেজন্য ১৯৭৭ সালে ইউএস সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ফেডারেল আইনের প্রতারণা ধারায় মামলা সাজায় পজনার, এনভিএফ ও শ্যারনের বিরুদ্ধে। পরবর্তী সময়ে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা পূর্ণ তদন্ত শুরু করলে বেরিয়ে আসে ভয়াবহ সব তথ্য। যেমন: ওই সময় নাকি ১ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ করেছিলেন পজনার ও তার পরিবার। আবার এনভিএফ অ্যাকাউন্ট কারসাজির মাধ্যমে শ্যারনের প্রাক-কর আয় দেখায় ১৩ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার, যা ছিল অতিরঞ্জিত। আমাদের আগের কেস হিস্ট্রিতে সব লোকসান এক বছরে জড়ো করেছিল এলটিভি। আর এনভিএফের কারসাজি ছিল, এক বছরের আয় অন্য বছরে নিয়ে যোগ করা এবং ব্যয় হয়তো তার পরের বছর। ফলে এনভিএফের কাজকর্ম বুঝতে শুধু কয়েক বছরের বার্ষিক প্রতিবেদনই যথেষ্ট নয়। একেবারে শুরু থেকে একে অনুসরণ করা জরুরি। ওই ঘটনায় শ্যারন স্টিল এতো বদনাম কামায় যে, ওয়ালস্ট্রিটে অনেক বিনিয়োগকারী বলতেন, ‘শেয়ার অ্যান্ড স্টিল’ (শেয়ার করে চুরি করো)।

 

এনভিএফ বিষয়ে আমার কয়েকটি পর্যবেক্ষণ

এক. আকারগত অনুপাত থেকে একটি ছোট কোম্পানির বড় কোম্পানিকে এভাবে অধিগ্রহণের ঘটনা নিঃসন্দেহে চরম। আর বিশুদ্ধ অর্থায়ন (ফাইন্যান্স) দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা যায়, এনভিএফের কোনো প্রয়োজন ছিল না দীর্ঘমেয়াদি ঋণযুক্ত মাথাভারী শ্যারনকে কেনা। উপরন্তু দর কষাকষির বেলায় অনৈতিকতার চর্চা হয়েছে, যার পরিণামে মুনাফা রূপান্তরিত হয় লোকসানে।

দুই. শ্যারন স্টিল অধিগ্রহণের পর ১৯৬৮ সালে এনভিএফের যে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়, তাতে দেখা যায় শ্যারনের ৫৮,৬০০,০০০ ডলার ঋণ রয়েছে। একে এনভিএফ ফেলে দেয় বিলম্বিত ঋণ ব্যয়ের (ডেফারড ডেট এক্সপেন্স) কাতারে। অথচ এ সংখ্যাটি সব স্টকহোল্ডারের ৪০,২০০,০০০ ডলার ইকুইটির চেয়ে বৃহৎ।

তিন. আবার শেয়ারহোল্ডারদের ইকুইটির মাঝে ঢোকানো হয়েছে ২০,৭০০,০০০ ডলারের ঋণ বিনিয়োগকে। তার মানে, এনভিএফের অনেক ইকুইটিই বাড়তি ব্যয়যুক্ত।

চার. এখন ঋণ ব্যয়কে (একে সম্পদ ভাবতে রাজি নই) অ্যাসেট থেকে বিদায় করে দিয়ে শেয়ারহোল্ডারদের ইকুইটির মধ্যকার নানা রকম আইটেমকে যুক্ত করা হলে এনভিএফ স্টকের ট্যানজিবল ইকুইটি সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা মিলবে। আমি হিসাবটি করেছিলাম এবং দেখেছি, এনভিএফ শেয়ারহোল্ডারদের ধারণ করা ট্যানজিবল ইকুইটির পরিমাণ মাত্র ২,২০০,০০০ ডলার!

পাঁচ. ১৯৭০ সালের শেষ দিকে প্রকাশিত এসঅ্যান্ডপি ‘স্টক গাইড’ অনুসারে, তৎকালে বিক্রীত এনভিএফ শেয়ারের পিই রেশিও হচ্ছে ২, যা ওই ‘স্টক গাইডের’ ৪ হাজার ৫০০ ইস্যুর মধ্যে সর্বনিম্ন। তদুপরি ওই রেশিওতে বৃহৎ ডাইল্যুশন ফ্যাক্টরকে আমলেই নেওয়া হয়নি। অথচ এ ফ্যাক্টরটি থাকায় এনভিএফ পরিচালনা পর্ষদ চাইলেই কর্তৃপক্ষের ওয়ারেন্ট ক্ষমতা ব্যবহারপূর্বক বাড়তি কমন স্টক কিনতে পারতেন। সেজন্য নতুন শেয়ার ছাড়তে হতো কোম্পানিকে। আর পরিণামে বিনিয়োগকারীদের মাঝে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হারে বণ্টিত হতো আয় ও মুনাফা।

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০