পূর্বের প্রকাশের পর…………….
শেয়ারবাজারে কিছু মুহূর্তে চোখ বুজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন আপনি। কখনও কখনও আবার চোখ-কান খোলা না রাখলে সমূহ বিপদ। কখন চোখ বন্ধ রাখবেন, আর কখন খোলা রাখবেন সে বিষয়ে কিছু উপদেশ ঝেড়েছি। আর এ আলোচনায় বিনিয়োগকারীর সাইকোলজি সম্পর্কে বাক্যালাপ অবধারিত। একজন বিনিয়োগকারীর সবচেয়ে বড় শত্রু হলো তার মেজাজ ও মগজ। কথাটি বর্তমান সময়ে আরও বেশি প্রযোজ্য। মন্দা বাজারে রক্ষণশীল ভাব ধরে নিষ্ক্রিয় হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন, তা হবে না। বিনিয়োগ করতে চাইলে ভালো-মন্দ শেয়ার কিনতেই হবে আপনাকে। গায়ে লাগাতেই হবে মন্দা বাজারের উত্তাপ। আমার বিশ্বাস, কারও যদি মোটামুটি চলনসই জ্ঞান-বুদ্ধি থাকে, তিনি যদি আমার কথাগুলো আত্মস্থ করতে সমর্থ হন কাজে আসবে বইটি। সফল বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপযুক্ত মানসিকতা গড়ে তুলতে পারবেন পাঠকরা। আমি কিন্তু বহু সাধারণ বিনিয়োগকারীকে ওয়ালস্ট্রিটে দেখেছি, যারা ফাইন্যান্স, অ্যাকাউন্টিং ও স্টক মার্কেটের ওপর বিশাল ডিগ্রিধারীদের চেয়ে ভালো করেছেন।
শেয়ার বৈচিত্র্যায়ন মার্জিন অব সেফটি নিশ্চিতকরণের সহজতম উপায়
বাকি রইলো বুল মার্কেটে সেফটি মার্জিন পরিস্থিতি ও গ্রোথ স্টকের মার্জিন অব সেফটি নিয়ে আলোচনা। এখানে প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার, গ্রোথ স্টকের বিনিয়োগ দর্শন (ফিলোসফি অব ইনভেস্টমেন্ট) আংশিকভাবে মার্জিন অব সেফটি ধারণার (কনসেপ্ট) সমান্তরালে চলে এবং অংশত এই নীতি মার্জিন অব সেফটি ধারণার বিরোধী। তার কারণ গ্রোথ স্টকের প্রকৃতির মাঝে নিহিত। গ্রোথ স্টকের মূল কথাই হচ্ছে, অতীতে যে আয় ক্ষমতা ছিল, তার তুলনায় স্টকটির ভবিষ্যৎ আয় ক্ষমতা (নিছক আয় নয়) বাড়বে আরও (যেহেতু এর সঙ্গে প্রবৃদ্ধির ইস্যুটি যুক্ত)। এটাই একজন গ্রোথ স্টক বিনিয়োগকারীর নির্ভরতা। এখন তিনি যদি মার্জিন অব সেফটি নীতি প্রয়োগ করতে চান, প্রাক্কলিত ভবিষ্যৎ আয় জানতে হবে তাকে। সেক্ষেত্রে অতীত আয়ের রেকর্ডকে প্রাক্কলিত আয় দ্বারা প্রতিস্থাপন করে নিতে পারেন তিনি। আর এমন কোনো বিনিয়োগ তত্ত্ব নেই, যেটি অতীত আয় রেকর্ডকে গ্রাহ্য করে, অথচ ভবিষ্যৎ প্রাক্কলিত আয়কে করে অবজ্ঞা। তাছাড়া সিকিউরিটি অ্যানালাইসিস সাবজেক্টটাই তো ক্রমাগতভাবে বেশি ঝুঁকছে প্রাক্কলিত আয় থেকে সম্ভাব্য রিটার্ন, মুনাফা প্রভৃতি নির্ণয়ে। এ থেকে অনেকেরই বিশ্বাস জন্মাতে পারে, বন্ডের মার্জিন সেফটি তত্ত্ব গ্রোথ স্টকের ওপরও প্রয়োগ করা সম্ভব। তারা হয়তো এমন শর্তও দেবেন যে, সেক্ষেত্রে সতর্কতার সঙ্গে প্রাক্কলন করা হবে ভবিষ্যৎ আয় এবং ভবিষ্যৎ আয়কে সংযুক্ত করা হবে অতীতে পরিশোধিত আয়ের সঙ্গে। কিন্তু আমার মনে হয়, এ হিসাব বিভ্রান্তিকর ও বিপজ্জনক। কেননা গ্রোথ স্টকের ব্যাপারে অতিরঞ্জিত তথ্য পরিবেশনা বাজারের স্বাভাবিক প্রবণতা। ফলে গ্রোথ স্টকের ভবিষ্যৎ আয় প্রাক্কলনে বিনিয়োগকারীরা রক্ষণশীল থাকতে পারেন না কখনোই। সেক্ষেত্রে কেউ কেউ কোম্পানির সুনাম, অতীত রেকর্ডের মতো উপাদানের ওপর গুরুত্বারোপ করে বাড়িয়ে করেন প্রাক্কলন। তবে আরেক গবেষণায় দেখা যায়, গ্রোথ স্টকের ভবিষ্যৎ আয় নির্ধারণের বেলায় অতিরঞ্জনের চেয়ে বেশি ঘটে অবমূল্যায়ন; অর্থাৎ উদ্দিষ্ট গ্রোথ স্টকের ভবিষ্যৎ আয় (ভুল করে) কমিয়ে প্রাক্কলন করেন বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী। এখন লক্ষ করার মতো বিষয় হচ্ছে, একজন বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেবেন স্টকের মার্জিন অব সেফটির ভিত্তিতে। সেফটি মার্জিন দেখে তিনি স্থির করবেন, উদ্দিষ্ট স্টক কেনার জন্য কত মূল্য পরিশোধ করা যায়। ফলে যারা কম মূল্যে গ্রোথ স্টক কিনতে সক্ষম হবেন, তাদের জন্য বেশি হবে মার্জিন অব সেফটি। আবার সেফটি মার্জিন কম হবে উচ্চতর মূল্যের জন্য। মূল্য যদি আরও উচ্চতর হয়, সেক্ষেত্রে কমতে কমতে শূন্য হয়ে যেতে পারে সেফটি মার্জিন। এভাবে এমন যদি ঘটে, বাজারের মূল্যস্তর উঠতে উঠতে এতো বেশি উপরে উঠেছে যে, সেফটি মার্জিন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তখন কিন্তু শেয়ার বৈচিত্রায়নের (ডাইভারসিফিকেশন) মাধ্যমেও পর্যাপ্ত বিনিয়োগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। লক্ষণীয়, এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে বুল মার্কেটে। তখন গ্রোথ স্টক ন্যূনতম সেফটি মার্জিন তো হারায়ই, তদুপরি অন্যান্য বিপুল পরিমাণ শেয়ার হয়ে পড়ে সাময়িক ও কৃত্রিম গ্রোথ স্টক। অবশ্য তেমন পরিস্থিতিতেও অনেক বিনিয়োগকারীকে সফলভাবে সঠিক স্টক নির্বাচন করতে দেখেছি আমি। সেজন্য দূরদৃষ্টি ও ঠাণ্ডা মাথা অপরিহার্য।
এখানে অবশ্যই উল্লেখ করা প্রয়োজন, প্রায় সব বারগেইন ইস্যুতেই মার্জিন অব সেফটির নিয়ম মানা হয় কমবেশি। খেয়াল করবেন, সব বারগেইন ইস্যুই অবমূল্যায়িত স্টক। প্রতিটি বারগেইন ইস্যুর নির্দেশিত ও ক্রয় মূল্যের ভেতরকার ব্যবধান আবার সর্বদা ক্রেতার অনুকূলে। সেজন্য বাজারে যদি গড় ভাগ্যের (এভারেজ লাক) চেয়ে বেশি দুর্ভাগ্য ঘটে যায় কিংবা বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেওয়ার বেলায় বিনিয়োগকারীর হিসাব-নিকাশের ভুলের মাত্রাটা একটু বেশিও হয়, সেই ক্ষতি পূরণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসে বারগেইন ইস্যুর উদ্বৃত্ত মূল্য। ফলে যেসব বিনিয়োগকারীর মূল ভাবনা হচ্ছে প্রতিকূল সময়েও পোর্টফোলিওর আয় রক্ষা করা, তাদের জন্য বারগেইন ইস্যু বিশেষভাবে সুবিধাজনক। কেননা মার্জিন অব সেফটি ইন-বিল্ট থাকে এ ধরনের ইস্যুর মাঝে। দেখবেন যেসব বিনিয়োগকারীর হাতে প্রচুর বারগেইন ইস্যু রয়েছে, বাজারে কী হচ্ছে না হচ্ছে, কোন কোম্পানি কী করল না করল, সেসব নিয়ে আট-দশজন বিনিয়োগকারীর মতো উত্তেজিত নন তারা। এদের লক্ষ্য মূলত সামনের দিকে। তাই বলে আবার ভাববেন না, আয়-মুনাফায় ফেল মারার দীর্ঘ রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও কম দামে পাচ্ছেন বলেই সেসব শেয়ার কিনতে যাবেন কোনো বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারী। তা নয়। আসল কথা হলো, জেনেশুনে একটি অবমূল্যায়িত শেয়ার কেনার অর্থ হলো বিনিয়োগকারী খুব ভালো করেই জানেন, এই স্টক থেকে ব্যাপকভাবে সন্তোষজনক বা চূড়ান্তভাবে অসন্তোষজনক কোনো ফল পাবেন না তিনি। বরং বারগেইন ইস্যুগুলো মার্জিন অব সেফটি তালিকার মধ্যবিন্দুতে (মিডল পয়েন্ট) অবস্থান করে একরকম। আর কোনো স্টকের বারগেইন মূল্য (প্রাইস) কম হওয়ার অর্থ হচ্ছে একদিকে এর মার্জিন অব সেফটি বাড়বে; অন্যদিকে কমবে রিটার্ন, আয় প্রভৃতি। আবার বারগেইন প্রাইস থেকে শেয়ার মূল্য যত উপরে উঠবে, ততই কমবে মার্জিন অব সেফটি; কিন্তু একই সঙ্গে বাড়বে রিটার্ন, আয়, মুনাফা বেশি হওয়ার সম্ভাবনা। তাই সজাগ থাকা দরকার, মার্জিন অব সেফটি যেন বাড়তে বাড়তে অসীমের দিকে চলে না যায় (তাতে লাভ হবে শূন্য) কিংবা সেফটি মার্জিন যেন কমতে কমতে শূন্যের প্রতি ধাবিত না হয় (সেক্ষেত্রে লোকসান হবে অসীম; গাণিতিকভাবে)।
শেয়ার বৈচিত্রায়ন সম্পর্কে সাধারণ আলোচনা
খানিকক্ষণ আগেই বললাম, বুল মার্কেটে শেয়ারে বৈচিত্র্য এনেও মার্জিন অব সেফটি বাড়ানো যায় না কেন। তবে ওই উদাহরণটি ছিল ব্যতিক্রম। এদিকে নিয়ম (তথা সাধারণ ঘটনা) হলো, শেয়ার বৈচিত্রায়ন (শেয়ার ডাইভারসিফিকেশন) ও সেফটি মার্জিনের মাঝে পারস্পরিক সহ-সম্পর্ক বিদ্যমান। লক্ষ্য করুন, আমলযোগ্য মার্জিন অব সেফটি থাকার পরও বাজে পারফরম্যান্স দেখাতে পারে যে কোনো নির্দিষ্ট শেয়ার। আরও স্মর্তব্য, সেফটি মার্জিন কখনোই বলে না, অমুক শেয়ারে চূড়ান্ত ক্ষতি অসম্ভব। বরং মার্জিন অব সেফটি নির্দেশ করে, ওই শেয়ারে লোকসান অপেক্ষা লাভের সম্ভাবনা এই শেয়ারের চেয়ে বেশি। কিন্তু চূড়ান্ত ক্ষতির শঙ্কা দূর হয় কীভাবে? সূক্ষ্মভাবে নজর দিন, সেফটি মার্জিনের এ প্রতিশ্রুতি শুধু নির্দিষ্ট একটি শেয়ারে আবদ্ধ। কিন্তু কেবল একটিমাত্র শেয়ার কেনার জন্য বাজারে যান না বা শুধু একটি শেয়ার কিনে বসে থাকেন না কোনো বিনিয়োগকারী। এতে করে মার্জিন অব সেফটি থেকে প্রাপ্ত একসঙ্গে অনেকগুলো লাভের প্রতিশ্রুতি যোগ হয় পোর্টফোলিওর পক্ষে আর তাতে দূর হয় চূড়ান্ত ক্ষতির শঙ্কা।
উল্লেখ্য, এ ধারণাটিই বিমা আন্ডার-রাইটিং ব্যবসার ভিত্তি। সেজন্যই সেফটি মার্জিন ও শেয়ার বৈচিত্রায়ন এ দুই রক্ষণশীল হাতিয়ারই (ইন্সট্র–মেন্ট) একে অপরের অপরিহার্য সঙ্গী। একটু ঘুরিয়ে উদাহরণটা দিই। রাশান রুলেটের কথা অনেকে শুনেছেন। আমেরিকান রুলেটও কিন্তু অত্যন্ত জনপ্রিয় জুয়া খেলা। সেখানে কোনো ব্যক্তি যদি সিদ্ধান্ত নেন একক সংখ্যার ওপর ১ ডলার করে বাজি ধরবেন, তাহলে বিজয়ী হলে তিনি পাবেন ৩৫ ডলার মুনাফা। অথচ এই একমাত্র বিজয়ের বিপরীতে তার হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা ৩৭ বার। ফলে এক্ষেত্রে তার মার্জিন অব সেফটি নেতিবাচক এবং এখানে যত বেশিবার তিনি বাজি ধরবেন, ততই কমবে মুনাফা পাওয়ার সম্ভাবনা। এবার বেশি জেদ ধরে (জেতার জন্য বৈচিত্র্য আনতে গিয়ে) তিনি যদি প্রতিটি সøটের প্রতিটি নম্বরের ওপর ১ ডলার করে বাজি ধরেন, হুইল একবার ঘুরলেই জিতলেও প্রতি দানে ২ ডলার করে লোকসান হবে তার। কিন্তু যদি বলা হয় জিতলে ৩৫ নয়, ৩৯ ডলার পাবেন সেক্ষেত্রে কিন্তু বাড়বে মার্জিন অব সেফটি। (আমেরিকান রুলেট নামক জুয়ায় ৩৮টা সøট বা ঘর থাকে; যেখানে ০ ও ০০সহ নম্বর রয়েছে ১ থেকে ৩৬ পর্যন্ত। অধিকাংশ ক্যাসিনোর নিয়ম হচ্ছে, ওই রুলেটে জিতলে বিজয়ীকে ১’র বিপরীতে সর্বোচ্চ ৩৫ গুণ দেওয়া। ধরুন, খুব চালাক কেউ একজন চিন্তা করলেন প্রতিটি নম্বরেই ১ ডলার করে রাখি। হুইল তো কোথাও না কোথাও থামবে। আর আমি নিশ্চয়ই জিতবো। এখন সেই চিন্তা করে যদি কেউ জেতেনও, শর্ত মোতাবেক এক ঘরে জেতার জন্য তিনি পাবেন ৩৫ ডলার। বাকি ৩৭টা ঘরে কিন্তু হেরেছেন তিনি। তার মানে, ভদ্রলোকের নিট লস হয়েছে ২ ডলার। এ ২ ডলারকেই বলা হয় প্রতিষ্ঠানের প্রাধান্য তথা হাউজ অ্যাডভান্টেজ। লক্ষণীয়, পরিমাণটি আপনার মোট ৩৮ ডলার জুয়ার ওপর ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ স্প্রেড। সেজন্য একজন জুয়াড়ি আমেরিকান রুলেটে যত বেশিবার হুইল ঘোরাবেন, তত বেশি লাভ করবে ক্যাসিনো) কথা হলো, পুঁজিবাজার জুয়া নয়। যদি জুয়া হতো তাহলে সাধারণ বৈচিত্রায়নে ক্ষতিগ্রস্ত হতো বিনিয়োগকারী। অথচ সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হলে পুঁজিবাজারের হাউজ অ্যাডভান্টেজ সিংহভাগ সময় যায় (বৈচিত্র্যময় শেয়ার ধারণকারী) বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীর পক্ষে। কেননা তিনি জানেন, সাধারণভাবে শেয়ার বৈচিত্রায়ন হচ্ছে মার্জিন অব সেফটি নিশ্চিতকরণের সবচেয়ে সহজ ও সস্তা উপায়।
Add Comment