পূর্বের প্রকাশের পর…………….
সফল বিনিয়োগ মানে ঝুঁকির সুব্যবস্থাপনা, ঝুঁকি পরিহার নয়
বিনিয়োগ বনাম ফাটকাবাজি: প্রেক্ষিত মার্জিন অব সেফটি
বিনিয়োগের সংজ্ঞাকে কোনো ধরাবাঁধা নিয়মের আওতায় ফেলা কঠিন। তদুপরি এ বইয়ে আমি দৃষ্টান্ত টেনে বিনিয়োগ ও ফাটকাবাজির মধ্যে এমন কিছু সূক্ষ্ম তারতম্যের প্রতি নির্দেশ করেছি, ভালোভাবে না দেখলে অনেকের মনে হতে পারে আদতে বিনিয়োগ ও ফাটকাবাজির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই এবং কোনটা বিনিয়োগ ও কোনটা ফাটকাবাজি, সেটির সংজ্ঞায়ন তার মানবাধিকারের পর্যায়ে পড়ে। আমি বিশ্বাস করি, এমন ভাবনা অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকারক। উপরন্তু মানুষের মনে উত্তেজনার প্রতি ঝোঁকার যে সহজাত প্রবৃত্তি রয়েছে, সেটিকে প্ররোচিত করে অ-বিশেষজ্ঞ বিনিয়োগকারীকে গতিময় শেয়ারবাজারের বিপজ্জনক প্রান্তের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় তা। অথচ বিনিয়োগ ও ফাটকাবাজির মধ্যে নিষ্পত্তিমূলক ফ্যাক্টর হচ্ছে মার্জিন অব সেফটি। একশ্রেণির বিনিয়োগকারী রয়েছে, যারা বিশ্বাস করেন হারের বিপরীতে জিতের পক্ষে অবধারিতভাবে রয়েছে ভাগ্য। কেউ কেউ অনেক সময় উপলব্ধি করেন, অমুক শেয়ার কেনার এখনই উপযুক্ত সময় কিংবা স্টক নির্বাচনে তার দক্ষতা সাধারণ বিনিয়োগকারীর চেয়ে বেশি অথবা তিনি যে বা যাদের পরামর্শ নিচ্ছেন, তারা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এসবই বিবেচনা বটে। তবে এগুলো ব্যক্তিক বিবেচনা। অথচ পুঁজিবাজার হচ্ছে বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিনিয়োগ ক্ষেত্র। আমি আবারও জোর দিয়ে বলছি, যে বিনিয়োগে বস্তুনিষ্ঠভাবে মার্জিন অব সেফটিকে আমলে নেওয়া হয়নি, সেটা কোনো বিনিয়োগই নয়।
মার্জিন অব সেফটি নিয়ে বহু কথা হলো। এবার প্রচলিত (কনভেনশনাল) ও অপ্রচলিত (আনকনভেনশনাল) পোর্টফোলিওকে একটু স্পর্শ করা যাক। উভয়ের সেফটি মার্জিনের প্রকৃতিগত পার্থক্য বিরাজমান। কেননা এ দুটি পদ্ধতিই ভিন্ন ভিন্ন বিনিয়োগ নীতির ফল; যেমন প্রচলিত পোর্টফোলিওতে বিনিয়োগকারীর প্রচলিত বিনিয়োগ নীতি প্রতিফলিত। আর এই প্রচলিত পোর্টফোলিওতে সাধারণত থাকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিভিন্ন ইস্যু এবং শ্রেণিগত দিক থেকে ফার্স্ট ক্লাস ও ডিভিডেন্ড দেয়, এমন সব কমন স্টক। এ বইয়ের শুরুর দিকেই বলেছিলাম মিউনিসিপ্যাল বন্ডের কথা। যারা করমুক্ত বিনিয়োগ আয় খুঁজছেন, তাদের প্রচলিত পোর্টফোলিওর জন্য মিউনিসিপ্যাল বন্ড উপযুক্ত। হাই-গ্রেড করপোরেট বন্ডও এখানে যুক্ত করা যায়। তবে হাই-গ্রেড করপোরেট বন্ডে তখনই বিনিয়োগ করা উত্তম, যখন বাজারে ইউএস সেভিংস বন্ড বা বিভিন্ন সেভিংস স্কিমের ইল্ড যথেষ্ট কম থাকে। লক্ষণীয়, প্রচলিত পোর্টফোলিও রক্ষণাত্মক বিনিয়োগিকারীর জন্য উপযোগী পদ্ধতি। কিন্তু আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারীরা পছন্দ করেন অপ্রচলিত পোর্টফোলিও। এ ধরনের পোর্টফোলিওর সীমা (রেঞ্জ) বিশাল। সাধারণত এখানে স্থান পায় বিভিন্ন সেকেন্ডারি কোম্পানির অবমূল্যায়িত শেয়ার। সেসব শেয়ার সেগুলোর নির্দেশিত মূল্যের চেয়ে দুই-তৃতীয়াংশ কম দামে (যখন পাওয়া যাবে) কেনা উত্তম। তাছাড়া মন্দা বাজার থেকে প্রেফারড স্টক কিনে রাখতে পারেন আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারীরা। মিডিয়াম-গ্রেড বন্ডও কেনা যেতে পারে; যদি সেগুলো ছাড়কৃত মূল্যে (ডিসকাউন্ট রেট) পাওয়া যায়। তবে এখানে আরেকটি বিষয় স্পষ্টভাবে পুনর্ব্যক্তকরণ প্রয়োজন। সেটি হলো, একজন আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারী অধিক ঝুঁকি বেশি নেন বেশি মুনাফার আশায়। কিন্তু তা কখনোই বেপরোয়া ফাটকাবাজি হওয়া চলবে না, হতে হবে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবা ঝুঁকি। মাঝারি মানের (ভালোও নয়, মন্দও নয়) অনেক বিনিয়োগকারী সেসব ঝুঁকি গ্রহণের মাত্রা দেখে অভিযোগ তুলতে পারেন আরে ওটা তো বিনিয়োগ নয়, ফাটকাবাজি! তখনও আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারীকে ঘাবড়ালে চলবে না। বরং তার সান্ত¡না নেওয়া উচিত এ উপলব্ধি থেকে যে, মাঝারি মানের বিনিয়োগকারীদের অনুভূতি ফার্স্ট কোয়ালিটি রেটিং (সহজে ভালো শেয়ার চিহ্নিতকরণের দক্ষতা) পর্যন্ত পৌঁছা প্রায় অসম্ভব; বরং তারা একে সর্বদা গুলিয়ে ফেলেন বিনিয়োগ প্রতিভার (ইনভেস্টমেন্ট মেরিট) সঙ্গে।
প্রকৃতপক্ষে একজন বিনিয়োগকারী সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে পারেন, যখন পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বিষয়টাকে তিনি একটি স্বতন্ত্র ব্যবসা হিসেবে দেখা শুরু করেন। তবু আমি মাঝেমধ্যে অবাক ও দুঃখিত হই দেখে যে, নিজ ক্ষেত্রে অত্যন্ত সফল একজন কীভাবে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে এসে পড়ে পড়ে মার খাচ্ছেন ওয়ালস্ট্রিটে। তিনি নিজে এক সফল কোম্পানির মালিক। অথচ অন্য যে কোম্পানিতে তার মালিকানা (শেয়ার কেনার মাধ্যমে) স্বার্থ রয়েছে, সেটি দীর্ঘদিন ধরে অকার্যকর। কেন যেন সফল হতে পারছেন না তারা। এখন শেয়ার ব্যবসাকে কীভাবে স্বতন্ত্র ব্যবসা হিসেবে উপলব্ধি করা যায়, সেটি আত্মস্তকরণের চারটি সহজ নীতি নিজে নিজেই বানিয়ে দিই আমি। বিনিয়োগকারীরা চাইলে সেগুলো অনুসরণ করতে পারেন
নীতি এক: শেয়ার বিনিয়োগকে ব্যবসা হিসেবে জানুন। এখানে কে কীভাবে (আপনিসহ) ব্যবসা করছেন, লক্ষ করুন। কিন্তু ভুলেও শেয়ার থেকে ‘বিজনেস প্রফিট’ তোলার চেষ্টা করবেন না। কেননা নিজ দোকানের জিনিস খেয়ে মুনাফা বাড়ানোর চিন্তা করেন না কোনো দোকানিই।
নীতি দুই: কাউকেই আপনারা ব্যবসা পরিচালনা করতে দেবেন না, যদি না
১. আপনার পক্ষে ওই ব্যক্তির পারফরম্যান্স ও কার্যকলাপ পর্যাপ্ত যতেœর সঙ্গে ও বিস্তারিতভাবে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়, অথবা
২. ওই ব্যক্তির সততা ও যোগ্যতার ওপর আস্থা রাখার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী কারণ থাকে। মনে রাখবেন, পয়সা কিন্তু আপনার।
নীতি তিন: যতক্ষণ পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য (হিসাব-নিকাশ) নিশ্চয়তা না আসছে যে, অমুক শেয়ারে যৌক্তিক মুনাফার সুযোগ বিদ্যমান, ওই শেয়ার ছোঁবেন না ততক্ষণ পর্যন্ত। ভালোভাবে যাচাই করুন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন। এদের প্রদত্ত আর্থিক তথ্যাদির নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা ভালো নয়। যেখানে মুনাফা কম অথচ হারানোর ঝুঁকি বেশি, তা থেকে দূরে থাকুন। আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারীদের কাছে অনুরোধ, আশাবাদ নয় যৌক্তিক হিসাব-নিকাশ যেন হয় আপনার সিদ্ধান্তের ভিত্তি এবং কখনোই স্বাস্থ্যকর বিনিয়োগ নীতিকে সোপর্দ করবেন না কামনার কাছে।
নীতি চার: আপন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ওপর সাহস রাখুন। যদি তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের পর মন বলে, হিসাব সঠিক সিদ্ধান্ত নিন। দ্বিধা থাকতে বিরত হোন। যদি দেখেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আপনার মতামতের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করছেন, পাত্তা দেবেন না। কেবল যখন ডেটা ও যুক্তি আপনার মতের বিরোধিতা করে, তখনই সতর্ক হোন।
একদিক থেকে দেখলে পুঁজিবাজার হচ্ছে মাঝারি মানের সাধারণ রক্ষণাত্মক বিনিয়োগকারীদের জন্য সুখের জায়গা। উচ্চাশা দমিয়ে রেখে, হাতেগোনা মৌলিক কয়েকটি নিয়ম মনে রেখেই নিরাপদে তার পক্ষে গড় পারফরম্যান্স দেখানো সম্ভব। ওদিকে আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারীদের জন্য শেয়ারবাজার হলো পরিশ্রমের জায়গা। দিনের পর দিন ওয়ালস্ট্রিটে এ দুই শ্রেণির বিনিয়োগকারীদের দেখে দুটি উপলব্ধি হয়েছে আমার। এক. অধিকাংশ অ-বিশেষজ্ঞ বিনিয়োগকারী যেমন মনে করেন, শেয়ারবাজারে সন্তোষজনক গড়পড়তা পারফরম্যান্স (রক্ষণাত্মক বিনিয়োগকারী) দেখানো সেই ধারণা অপেক্ষা অনেক সহজ। দুই. বাইরে থেকে দেখলে যতটা মনে হয়, মাঝারির চেয়ে একটু ভালো পারফরম্যান্স (আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারী) দেখানো সেই দৃষ্টিভঙ্গি অপেক্ষা অনেক কঠিন।
শেষ কথা
আমার পক্ষে কোনো বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীকেও নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব নয় (যদিও এর সম্ভাব্যতা রয়েছে), তিনি চমকপ্রদ পারফরম্যান্স দেখাবেনই। এ জীবনে কাউকেই কোনোদিন আশ্বাস দিইনি সবাই ধনী হতে পারেন। এর বিপরীতটাও কখনো জোর দিয়ে বলি না। কেননা পুঁজিবাজার আসলে তিন রিংয়ের সার্কাস সম্ভাবনা, অনিশ্চয়তা ও প্রাপ্তি। এখানে মুনাফার সম্ভাবনা বিপুল। আবার মুনাফা প্রাপ্তির পাশাপাশি আনন্দও রয়েছে উদ্যোগী বিনিয়োগকারীদের জন্য; যদিও পুঁজিবাজার কর্তৃক ছড়ানো উত্তেজনার উত্তাপ উপভোগের অধিকার সবার। আর অনিশ্চয়তার ব্যাপারে বলব, সফল বিনিয়োগ মানে ঝুঁকির সুব্যবস্থাপনা, ঝুঁকি পরিহার নয়। ওয়ালস্ট্রিটে ফান্ড ম্যানেজার হিসেবে থাকাকালে পোর্টফোলিও’র মোট ২৫ শতাংশ একটিমাত্র স্টকের পেছনে ঢেলেছিলাম একবার। তখন অনেকের সমালোচনা শুনেছি সারাজীবন বিনিয়োগের কথা বলে এখন দেখি ফাটকাবাজিতে লিপ্ত হলেন গ্রাহাম! পাত্তা দিইনি। আমার কেনা স্টকের কোম্পানি যখন তরলীকৃত হয় এবং আমার ফান্ড বিপুল আয় করে, কেবল তখনই অনেকে বুঝতে শুরু করেন কার্যত আমার ঝুঁকিটি বড় কোনো আর্থিক ঝুঁকি ছিল না, ছিল মানসিক ঝুঁকি।
ইদানীং পত্রপত্রিকা, টিভি বা ইন্টারনেট খুললেই দেখা যায়, দেশি-বিদেশি খবরাখবর ভীতিকর সব তথ্য ও অমীমাংসিত ঝুঁকিতে ভরা। বেয়ার মার্কেট, অর্থ জালিয়াতি, সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি সর্বত্র শুধু ভয় আর আতঙ্ক। কেউ কেউ আবার টিভির সামনে মুখ গোমড়া করে বলেন ‘বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তা পছন্দ করেন না’। আমি তাদের সঙ্গে একমত। একমত শুধু নই, আমি তাদের চেয়ে আরও বেশি একমত। কেননা আমার ধারণা, বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তা পছন্দ করেন না। শুধু তা-ই নয়, অতীতেও বিনিয়োগকারীরা কখনো অনিশ্চয়তা পছন্দ করেননি এবং আগামী দিনেও করবেন না। তবু এ সত্য এড়াই কী করে, এ অনিশ্চয়তাই হচ্ছে বিনিয়োগ পরিবেশের সবচেয়ে মৌলিক, স্থায়ী ও সর্বজনীন উপাদান। এটা সর্বদা ছিল, সর্বদা থাকবে। কারণ বাজারের গভীরতম খাতে বিনিয়োগ ও অনিশ্চয়তা সমার্থক। ভবিষ্যৎ ভালো হবে এ আস্থা যদি না থাকে, কারো পক্ষে কখনো বিনিয়োগে নামা সম্ভব নয়। ফলে বিনিয়োগকারী হতে চাইলে আগামীর দিন ভালো যাবে, এ বিশ্বাস রাখতেই হবে।
Add Comment