Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 11:02 am

বেনাপোল ছেড়ে ভোমরা বন্দরে ভিড় করছেন আমদানিকারকরা

মীর কামরুজ্জামান মনি, যশোর: কয়েক মাস বন্ধ থাকার পর দেশের অন্যতম বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল দিয়ে আবারও কমেছে ফল আমদানি। মূলত ওজন স্কেলের কারসাজির কারণে আমদানি কমেছে। এ কারণে এখন বেশিরভাগ আমদানিকারক অনৈতিক লাভের আশায় বেনাপোল ছেড়ে বর্তমানে সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে ফল আমদানি করছেন। ফলে লাভবান হচ্ছেন আমদানিকারক ও বন্দর-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। হঠাৎ করে কেন আমদানিকারকরা আবারও ভোমরা বন্দরের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন এ বিষয়ে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চমকপ্রদ তথ্য।

আমদানিকারকরা বলছেন, বেনাপোল স্থলবন্দরে রয়েছে ডিজিটাল ওয়েট (ওজন) স্কেল; অপরদিকে ভোমরা বন্দরে ব্যবহার করা হচ্ছে ম্যানুয়াল ওজন স্কেল। সেক্ষেত্রে একটা বিরাট তারতম্য ঘটানো সম্ভব হয় ওজন করার ক্ষেত্রে। আর এটি লুফে নেন আমদানিকারকরা। কারণ এই ওজন স্কেলের মাধ্যমে তারা আমদানিকৃত পণ্যের বিরাট অঙ্কের শুল্ক ফাঁকি দিতে সক্ষম হচ্ছেন। আর এসব অনৈতিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত খোদ ভোমরা স্থলবন্দর ও কাস্টমসের কর্মকর্তারা।

গত ১৫ সেপ্টেম্বর ভারত থেকে আপেলভর্তি একটি ট্রাক (পিবি১৩বিটি-২০১১) ঢোকে ভোমরার বিপরীতে ঘোজাডাঙ্গা বন্দরে। সেখান থেকে আরেক ভারতীয় ট্রাকে মাল লোড করা হয়। এরপর সেই ট্রাক ভোমরা বন্দরে ঢোকে ১৮ সেপ্টেম্বর। ট্রাকে থাকা আপেলের ওজন (ক্যারেটসহ) ছিল ২৮ হাজার ৯২০ কেজি। কিন্তু ভোমরা বন্দরের ওজন স্কেলে মাপা হয় ২৭ হাজার ৮২৮ কেজি। অর্থাৎ এখানে ওজন কারচুপি হয়েছে এক হাজার ৯২ কেজি। এই পণ্যের আমদানিকারক ছিলেন সাতক্ষীরার ভোমরা এলাকার মেসার্স পারভেজ ট্রেডার্স। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ভারতের মেসার্স বিশাল ফ্রুটস এজেন্সি। আর এই পণ্যটির খালাসের দায়িত্বে ছিল মেসার্স আল মদিনা। অপরদিকে একই দিন আপেলভর্তি আরেকটি ট্রাক আসে ভারত থেকে। সেখানে ক্যারেটসহ ওজন ছিল ২৭ হাজার ৫৮২ কেজি। ভোমরা বন্দরের ওজন স্কেলে সেটি দেখা যায়, নিট ২১ হাজার কেজি। এই পণ্যটির প্যাকেজের সংখ্যা ছিল তিন হাজার ২৯১।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভারতীয় গাড়িতে নির্ধারিত প্যাকেজের (মালের সঙ্গে থাকা ক্যারেট বা কার্টন) চেয়ে অতিরিক্ত প্যাকেজ দেখালে আমদানিকৃত পণ্যের ওজন কম দেখানো যায়। ভোমরা বন্দরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এই অপকর্মটি করে থাকেন। যেমন ভারত থেকে ট্রাকে আসা আপেল বা টমেটোভর্তি ক্যারেটের সংখ্যা তিন হাজার থেকে তিন হাজার ৫০টির অধিক নয়। কিন্তু সেখানে এই সংখ্যা দেখানো হয় তিন হাজার ২০০ থেকে তিন হাজার ৩০০টি। প্যাকেজের সংখ্যা বাড়ালেও পণ্যের ওজনও কম দেখানো হয়। আর ওজন কমলে সরকারের রাজস্ব কম হয়। বন্দর ব্যবহারকারীরা জানান, চলতি সেপ্টেম্বর মাসে প্রায় প্রতিদিন ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে ৭৫-৮০ ট্রাক পেরিশেবল (পচনশীল) পণ্য আমদানি করা হচ্ছে। অপরদিকে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে মাত্র ২০ থেকে ২৫ ট্রাক পেরিশেবল (পচনশীল) পণ্য আসছে।
আমদানিকারকরা ভোমরা বন্দর ব্যবহারের ফলে ট্রাকপ্রতি দেড় থেকে দুই টনের বেশি শুল্ক ফাঁকির সুযোগ পাচ্ছেন। সে কারণে তারা এই বন্দর ব্যবহারে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। আর সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী বলেন, চলতি মাসে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ফল আমদানি খুবই কম। সুযোগ-সুবিধা পাওয়ায় বেশিরভাগ আমদানিকারক ভোমরা বন্দর ব্যবহার করছেন। এভাবে চলতে থাকলে বেনাপোল বন্দর দিয়ে যে রাজস্ব আদায়ের সুনাম আছে, তা ম্লান হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে ব্যবসায়ীরা শুল্ক গোয়েন্দাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ব্যবসায়ীরা আরও বলেন, ‘ভোমরা বন্দরে যে অনৈতিক কর্মকাণ্ড চলছে, সেগুলো অবিলম্বে বন্ধ করে ডিজিটাল ওজন স্কেল স্থাপন করে সরকারের রাজস্ব আয়ের পথ বিকশিত করতে হবে।’ সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী রিয়েল ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে বলা হয়, ভারতের নির্দিষ্ট কিছু ট্রাক আছে। যেসব ট্রাকের ওজন দেড় থেকে দুই টন কম দেখিয়ে এন্ট্রি করা হয়। এর ফলে মালের পরিমাণ বেশি এনে কম দেখানো এবং শুল্ক পরিশোধে অবৈধ সুযোগ নেয়া যায়। তিনি জানান, আপেল, আনার, কাঁচা মরিচ ইত্যাদির আমদানি এখন ভোমরা বন্দর দিয়ে বেশি হচ্ছে। ওজন স্কেলে ফাঁকি দিতে পারায় আমদানিকারকরা সেদিকেই ঝুঁকছেন। এভাবে চলতে থাকলে বেনাপোল স্থলবন্দর মুখ থুবড়ে পড়বে; সরকারও রাজস্ব হারাবে।

প্রসঙ্গত, চলতি বছরের মার্চ মাসে এরূপ অবস্থার সৃষ্টি হলে দৈনিক শেয়ার বিজসহ স্থানীয় পত্রিকায় এ-সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশের পর পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছিল। বর্তমানে আবারও আগের অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ভোমরা স্থলবন্দরের উপ-পরিচালক রুহুল আমিন বলেন, ইন্ডিয়ান ওজন সিøপের ওপরে আমাদের কোনো ডিপেন্ডেন্সি নেই। আমাদের ওজন স্কেলে যে ওজন হয়, আমরা সেই ওজনই ধরব। ভোমরা বন্দরে ওজনে সামান্যতম কোনো কারচুপি করা হয় না।

এ ব্যাপারে খুলনা কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. আতিকুজ্জামানের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, ওজন স্কেলের কারচুপি নিয়ে যে অভিযোগটি উঠেছে, তা সত্য নয়। ভোমরা বন্দরে ভারত থেকে আমদানিকৃত পণ্যবোঝাই ট্রাক সরকারের বিভিন্ন সরকারি গোয়েন্দা কাস্টমস ও বন্দরের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে শতভাগ পণ্যের ওজন করা হয়। ওজনে কারচুপি করার কোনো সুযোগ নেই।