শওকত আলী: ব্যাংকিং খাতে ধারাবাহিকভাবে খেলাপি ঋণ বাড়লেও বেড়েছে পরিচালন মুনাফা। ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে প্রায় সব ব্যাংকেরই মুনাফা বেড়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত, বেসরকারি ও নতুন ব্যাংকগুলো আগের বছরের চেয়ে বেশি মুনাফা করেছে সদ্য সমাপ্ত বছরটিতে। পাশাপাশি টানা দুই বছর লোকসানে থাকার পরও পরিচালন মুনাফা করেছে বেসিক ব্যাংক লিমিটেড। বিভিন্ন ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুনাফা করেছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। আর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে জনতা ব্যাংক। কিন্তু লোকসান থেকে বেরোতে পারেনি রূপালী ব্যাংক লিমিটেড।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি অবকাঠামো ও বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় ব্যাংকগুলোর ব্যবসা তুলনামূলক ভালো হয়েছে। ঋণের সুদ কমে আসায় তাদের সার্বিক বিনিয়োগ ও ঋণ বিতরণ বেড়েছে। আমদানি-রফতানি বাণিজ্যও ভালো হয়েছে, যা পরিচালন মুনাফা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে বলে জানা গেছে।
টানা দুই বছর লোকসানে থাকার পর পরিচালন মুনাফা করেছে বেসিক ব্যাংক লিমিটেড। প্রায় ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে আসা ব্যাংকটির মুনাফায় আসাটা ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ব্যাংকটির ২০১৬ সালে মুনাফা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮৭ কোটি টাকা। ২০১৫ ও ২০১৪ সালে ব্যাংকটি যথাক্রমে ২৫৬ কোটি ৪২ লাখ এবং ৯৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা লোকসানে ছিল বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন এ মজিদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা জানতাম এ বছর আমাদের কিছুটা পরিচালন মুনাফা হবে। শেষ পর্যন্ত হয়তো নিট মুনাফা থাকবে না। তবে আপাতত পরিচালন মুনাফা হওয়াটাই এ ব্যাংকের জন্য একটি বড় খবর। ব্যাংকটির কর্মকর্তারা প্রচুর কাজ করছেন এবং এতে ভবিষ্যতেও কাজের উৎসাহ পাবেন বলে জানান তিনি।
জানা গেছে, এবার ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফার বড় অংশই এসেছে ঋণের সুদ, কমিশন, সার্ভিস চার্জ, বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসার আয় থেকে। এছাড়া সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন সময়ে দেওয়া ঋণ থেকেও বড় ধরনের আয় আসায় সামগ্রিকভাবে পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। এছাড়া বিদায়ী বছরে ব্যাপক হারে খেলাপি ঋণ নবায়ন ও খেলাপি হওয়ার যোগ্য ঋণকে খেলাপি না করার কারণেও পরিচালন মুনাফা বেড়েছে বলে ব্যাংকের সূত্রগুলো জানিয়েছে।
ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা প্রকৃত মুনাফা নয়। নিট মুনাফাই ব্যাংকের প্রকৃত আয়। পরিচালন মুনাফা থেকে ব্যাংকগুলোকে নিয়মিত ও খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন রাখতে হবে। নিয়মিত ঋণের বিপরীতে প্রভিশন এক থেকে দুই শতাংশ, খেলাপির মধ্যে নি¤œমান ঋণে ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ ঋণে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। এর পরে মূলধন বাড়াতে তহবিলের একটি অংশ নিতে হবে রিজার্ভ তহবিলে। পরিশোধ করতে হবে সাড়ে ৪১ শতাংশ হারে আয়কর। এরপরে যা থাকবে তা ব্যাংকের নিট মুনাফা হিসেবে গণ্য হবে। এ নিট মুনাফা থেকে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেওয়া যাবে।
বিভিন্ন ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবারও সবচেয়ে বেশি মুনাফা করেছে ইসলামী ব্যাংক। বিদায়ী বছরে তারা পরিচালন মুনাফা করেছে প্রায় দুই হাজার তিন কোটি টাকা। আগের বছরে মুনাফা করেছিল এক হাজার ৮০৭ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মান্নান বলেন, ব্যবসার সব সূচকেই আমরা ভালো করতে সক্ষম হয়েছি। সব শাখাই এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। এতে বিনিয়োগ, ঋণ বিতরণ, বৈদেশিক বাণিজ্য, খেলাপি ঋণ আদায় সবই বেড়েছে। ফলে পরিচালন মুনাফাও বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, সম্পদের গুণগত মান বৃদ্ধির পাশাপাশি বিনিয়োগ বহুমুখীকরণ করা হয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ১০১ কোটি টাকা। আগেরবার ব্যাংকটির মুনাফা ছিল ৮৪৮ কোটি টাকা। ব্র্যাক ব্যাংক মুনাফা করেছে ৯২৫ কোটি টাকা। আগেরবার করেছিল ৭৮০ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে ব্র্যাক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আরএফ হুসেইন বলেন, এসএমই ও রিটেইল ব্যাংকিং ভালো করায় তাদের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। শুধু ঢাকা, চট্টগ্রামই নয়, তাদের সব শাখাই ব্যবসায় ভালো করেছে বলেও জানান তিনি।
সাউথইস্ট ব্যাংক বিদায়ী বছরে মুনাফা করেছে ৮৬৩ কোটি টাকা, যা আগের বছরে ছিল ৮৩৪ কোটি টাকা। ৭৬০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে দ্য সিটি ব্যাংক। আগের বছরে ব্যাংকটির মুনাফা ছিল ৬৬৭ কোটি টাকা। এছাড়া আল আরাফাহ্ ব্যাংক এবার পরিচালন মুনাফা করেছে ৭৫৪ কোটি টাকা, আগের বছরে ছিল ৬২৮ কোটি টাকা; এক্সিম ব্যাংক করেছে ৬৯০ কোটি টাকা, আগের বছরে ছিল ৬৫০ কোটি টাকা; ট্রাস্ট ব্যাংক মুনাফা করেছে ৫০১ কোটি টাকা, আগের বছর ছিল ৪৫৪ কোটি টাকা; যমুনা ব্যাংক মুনাফা করেছে ৪৫০ কোটি টাকা; এনসিসি ব্যাংক ৪৭০ কোটি টাকা, আগের বছর ছিল ৪১৯ কোটি টাকা; শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক পরিচালন মুনাফা করেছে ৩১৪ কোটি টাকা, আগের বছরে ছিল ২৭৫ কোটি টাকা; ওয়ান ব্যাংক মুনাফা করেছে ৪৫০ কোটি টাকা; আগেরবার করেছিল ৪২৪ কোটি টাকা; প্রিমিয়ার ব্যাংক মুনাফা করেছে ৩৫০ কোটি টাকা; স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক মুনাফা করেছে ৩৭৫ কোটি টাকা, আগেরবার করেছিল ৩৬১ কোটি টাকা; আইএফআইসি ব্যাংক করেছে ৪৩০ কোটি টাকা, আগের বছর ছিল ৪০৬ কোটি টাকা। তবে ২০১৫ সালে পূবালী ব্যাংক ও ব্যাংক এশিয়ার পরিচালন মুনাফা কমেছে। এবার পূবালী ব্যাংকের অর্জিত মুনাফার পরিমাণ ৭২০ কোটি টাকা, আগেরবার ছিল ৭৮০ কোটি টাকা। গেলো বছর ব্যাংক এশিয়া মুনাফা করেছে ৫৯০ কোটি টাকা, আগের বছর যা ছিল ৬০০ কোটি টাকা।
নতুন ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবার সবচেয়ে বেশি পরিচালন মুনাফা করেছে ইউনিয়ন ব্যাংক। এবার তাদের মুনাফা ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে জানিয়েছে ব্যাংকের একটি সূত্র। ২০১৫ সালে ব্যাংকটি ১১২ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছিল। পরিচালন মুনাফার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক। এবার ব্যাংকটি ১৭২ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। ২০১৫ সালে ব্যাংকটির মুনাফার পরিমাণ ছিল ১০৬ কোটি টাকা। সাউথ বাংলা ব্যাংক পরিচালন মুনাফা করেছে ১৫৪ কোটি টাকা, আগের বছর ছিল ৮৩ কোটি টাকা। এছাড়া মেঘনা ব্যাংক মুনাফা করেছে ১০২ কোটি; আগের বছর ছিল ৬৮ কোটি। মিডল্যান্ড ব্যাংক করেছে ৭২ কোটি; আগের বছর ছিল ১৭ কোটি টাকা। তবে মধুমতি ব্যাংকের মুনাফা কমেছে। এবার ব্যাংকটি মুনাফা করেছে ৯২ কোটি টাকা। আগেরবার ছিল ১০০ কোটি টাকা।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবারও সবচেয়ে বেশি মুনাফা করেছে জনতা ব্যাংক। তবে এর প্রকৃত পরিমাণ জানা যায়নি। গেলবার ব্যাংকটি ১২০০ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মুনাফা করেছে অগ্রণী ব্যাংক। এবার ব্যাংকটির মুনাফা ৫০০ কোটি টাকার বেশি বলে জানা গেছে। ভালো মুনাফা করেছে সোনালী ব্যাংকও। পুরো বছরের তথ্য পাওয়া না গেলেও নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির মুনাফা ৩০০ কোটি টাকার ওপরে ছিল। টানা দুই বছর লোকসানে থাকা বেসিক ব্যাংক এবার মুনাফা করেছে ১৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। আগেরবার ব্যাংকটির ২১৯ কোটি টাকা লোকসান ছিল।
Add Comment