৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে জনসংখ্যা ১৮ কোটিরও বেশি। আমাদের এই বৃহৎ জনসংখ্যা অর্থাৎ মানবসম্পদ থাকা এবং বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ার পরও আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। আমাদের বৃহৎ মানবসম্পদ সবচেয়ে বেশি কাজে লাগছে প্রবাসে এবং গার্মেন্ট সেক্টরে। এছাড়া আমাদের বড় কোনো কর্মমাধ্যম নেই। কৃষি খাতে আমাদের ভালো সম্ভাবনা থাকার পরও ধীরে ধীরে কৃষিকাজ হয়ে যাচ্ছে পরীক্ষার ‘অপশনাল সাবজেক্ট কৃষিশিক্ষা’র মতো। আমাদের আবেগ-ঐতিহ্যের সঙ্গে কৃষির একটা দারুণ যোগসূত্র থাকলেও এখন কৃষিকাজ ও কৃষকের কথা শুনলেই আমরা তাচ্ছিল্য করি। কৃষক মানেই গরিব ও মূর্খ, এ ধরনের প্রতিকৃতি আমাদের অহংকারী মানসপটে ভেসে ওঠে। আধুনিকতায় আমরা এতটাই বিভোর হয়ে গেছি যে, কৃষক ও কৃষকের ছেলেকে আমরা ‘ক্ষ্যাত’ বলে আখ্যায়িত করি, ফলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। একজন জাত কৃষক তার ছেলেকে কৃষক বানায় না জজ, ব্যারিস্টার, ডাক্তার কিংবা সরকারি চাকরিজীবী বানাতে চায়। আমাদের এমন মানসিকতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে আমাদের মনোভাব এখন এ রকম‘শিক্ষা গ্রহণ করো, শহরে যাও, চাকরি করো।’ এ অবস্থায় দেশীয় অর্থনীতির প্রাচীন ও প্রধান খাত কৃষি ও কৃষক এখন নিম্নমানের কর্ম ও কর্মক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই যে মানুষের এত আয়-রোজগারের আকাক্সক্ষা, তীব্র চেষ্টাÑসবকিছুই খাবারের জন্য। গ্রামের মুরব্বিরা বলেন, ‘যদি পেটে খাবারের দরকার না হতো, তাহলে মানুষে মানুষে এত হানাহানি, খুনোখুনি হতো না।’ দিনে দিনে বহু মানুষের ভাগ্যের চাকা অর্থনৈতিকভাবে ঘুরলেও খাদ্যকষ্টে ভোগে এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। এছাড়া যারা সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ, তাদের আয়ের তুলনায় নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের মূল্য অধিক। অথচ কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে কৃষিপণ্য সঠিকভাবে উৎপাদন করতে পারলে খাদ্যের ঘাটতি কিংবা মূল্যবৃদ্ধির সমস্যায় পড়তে হতো না আমাদের। পেঁয়াজ, লবণ, তেলসহ প্রায় সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। করোনা মহামারি শুরুর আগে তো পেঁয়াজের মূল্য আকাশ ছুঁয়েছিল। এভাবে নিয়মিত কোনো না কোনো পণ্যের দাম নিয়ে জনগনের সঙ্গে তামাশা চলেই। বর্তমানে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির ফলে দেশে একধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। চাপা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে নাগরিকদের মাঝে।
সম্প্রতি ‘বাংলাদেশের ৫০ বছর, কৃষির রূপান্তর ও অর্জন’ শীর্ষক এক কৃষি সম্মেলনে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘আমরা অনেক বেশি ভাত খাই। যদি ভাতের এই কনজাম্পশন (খাওয়া) কমাতে পারি, তাহলে চালের চাহিদা অনেকটাই কমে যাবে। আমরা একেকজন দিনে প্রায় ৪০০ গ্রাম চাল খাই। পৃথিবীর অনেক দেশে ২০০ গ্রামও খায় না।’ তিনি খাবার কম খেতে বলেননি, ভাত খাওয়া কমিয়ে পুষ্টিকর খাবার খেতে বলেছেন। নাগরিকদের জন্য পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করতে কাজ করছেন বলে জানান তিনি। কৃষিমন্ত্রীর মন্তব্য নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা চললেও বেশি ভাত খাওয়ার মন্তব্যটি অমূলক নয়। মাছে-ভাতে বাঙালি হিসেবে আমরা সাধারণ তিন বেলাই ভাত খাই। ভাতের পুষ্টিগুণ থাকলেও শরীর মুটিয়ে যাওয়ার জন্য ভাত দায়ী। যারা শরীরের মেদ কমাতে চান এবং মুটিয়ে যাওয়া থেকে রেহাই পেতে চান, তাদের প্রতি ডাক্তার কিংবা ফিটনেস ট্রেনারদের অন্যতম নির্দেশনা থাকে ভাত খাওয়া প্রায় ছেড়ে দেয়া। ফলে সুস্বাস্থ্য ও স্বাভাবিক জীবনধারণের জন্য ভাতই একমাত্র আবশ্যিক খাদ্য, এমনটা নয়। পরিশ্রমী শরীরের খাদ্যচাহিদা অধিক হলেও ভাতই একমাত্র খাদ্য না হয়ে পুষ্টিকর খাবারের মাধ্যমেও সে চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
বাংলাদেশে বিগত এক দশক আগেও গম চাষ ছিল প্রচুর। গ্রাম কিংবা শহরের মানুষ আটার রুটি দিয়েই সকালের খাবার সম্পন্ন করত। এখনও শহরে নানরুটি কিংবা তেলে ভাজা পরোটা তৈরি হয় গমের আটা-ময়দা দিয়ে। পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের প্রধান খাদ্য রুটি। রুটিতে চালের চেয়ে বেশি পুষ্টিগুণ আছে, যা স্বীকৃত বিষয়। এছাড়া একসময় মিষ্টিআলুর চাষ হতো প্রচুর, মানুষজন সকাল কিংবা রাতের খাবার সম্পন্ন করত আলু দিয়ে। মিষ্টিআলুর পুষ্টিগুণও ভাতের চেয়ে বেশি। একজন মানুষ যদি সুঠাম দেহের অধিকারী হতে চায়, তাহলে অবশ্যই তাকে ভাত খাওয়া কমিয়ে পুষ্টিকর খাবারে মনোযোগী হতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে একসময় প্রচুর ভাত খেয়ে মোটা হতে চাইতাম, কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই ভাবনায় পরিবর্তন আনতে হয়েছে। মোটা হওয়া নয়, বরং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া জরুরি। সুস্থ স্বাভাবিক শরীরের জন্য বেশি ভাত নয়, প্রয়োজন বেশি পুষ্টিকর খাবার। বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত বলেই চালের দাম বেশি, কিন্তু অধিক পুষ্টিসম্পন্ন আটা-ময়দার দাম চালের তুলনায় অনেক কম।
মানুষ কী খাবে বা না খাবে, এটা সম্পূর্ণ তার নিজস্ব ব্যাপার। তবে ভাত খেয়েই জীবনধারণ করতে হবে, এই ধারণার পরিবর্তন আনাও জরুরি। এছাড়া সবারই কাম্য থাকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া। ফলে সুস্বাস্থ্য ও সুঠাম দেহের জন্য ভাত খাওয়া কমিয়ে দিয়ে রুটি কিংবা পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে গম চাষ ও পুষ্টিকর খাবার উৎপাদনের জন্য কৃষকদের কৃষি প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে দেশকে পুষ্টিকর খাবারে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে পারলে সব নাগরিকের পুষ্টিকর খাবারের চাহিদা পূরণ হবে এবং এর পাশাপাশি নির্দিষ্ট কোনো খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি না পাওয়ায় তা নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে বলেই মনে করছি।
জুবায়ের আহমেদ
শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম
অ্যান্ড ইলেকট্রনিক মিডিয়া (বিজেম), ঢাকা