বেশি সুদের আশায় নিজস্ব তহবিল সরকারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ

রোহান রাজিব: কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আন্তঃব্যাংক (কলমানি) মার্কেট থেকে এখন ধার করে চলছে অনেক ব্যাংক। দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে আগের তুলনায় দ্বিগুণ ধার নিচ্ছে। তবে ব্যাংকগুলো নিজস্ব তহবিলের টাকা সরকারি সিকিউরিটিজ বা বিল-বন্ডে বিনিয়োগে ঝুঁকছে। মূলত সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকগুলো বেশি লাভের আশায় সেখানে বিনিয়োগ করছে, যদিও তা স্বল্পমেয়াদি।

সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিতে অনীহা ব্যাংকগুলোর। তাই চাহিদামতো টাকা না পাওয়ায় এখন শিডিউলের বাইরে ১৪ দিনের অকশন করে ঋণ নিচ্ছে সরকার।

জানা যায়, কয়েক দিন আগেও ট্রেজারি বিলে তিন থেকে পাঁচ শতাংশ সুদে লেনদেন হতো। গত আগস্ট থেকে এ সুদহার বাড়তে শুরু করে। গত ১৯ নভেম্বর সুদ বেড়ে উঠেছে ১০ দশমিক ৬০ শতাংশ, যা গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর গত ২২ নভেম্বর ১০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের সুদহার উঠেছিল ১১ দশমিক ১০ শতাংশ।

বর্তমানে রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হওয়াতেও ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে যাচ্ছে না। আবার অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরাও নতুন বিনিয়োগ করছে না। এর ফলে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধিও ধারাবাহিকভাবে কমছে। তাই ব্যাংকগুলো নিজস্ব তহবিল ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করছে। অপরদিকে ট্রেজারি বিল-বন্ডের বিনিয়োগের সুদহারের চেয়ে রেপোর সুদহার কম হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে দৈনিক চাহিদা মেটাচ্ছে ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, তারল্য সংকটে থাকা বিভিন্ন ব্যাংককে গত বুধবার ২৩ হাজার ৯৪১ কোটি টাকা স্বল্পমেয়াদি ধার দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধারের রেকর্ড। এর আগে ২৫ অক্টোবর রেকর্ড ২৪ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা স্বল্পমেয়াদি ধার দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এদিকে বৃহস্পতিবার আন্তঃব্যাংক ধারের পরিমাণ ছিল চার হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা, গড় সুদ ছিল ৮ দশমিক ১৯ শতাংশ।

তথ্যমতে, গত জুন শেষে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকার ট্রেজারি বিল-বন্ডের মাধ্যমে নেয়া ঋণের স্থিতি ছিল দুই লাখ ৩৬ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা, যা গত ১২ নভেম্বর পর্যন্ত বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৬৩ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ চার মাস ১২ দিনে ব্যাংকের বিনিয়োগ বা সরকারের ঋণ বেড়েছে ২৭ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা। তবে একই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ স্থিতি কমেছে। গত জুন শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ স্থিতি ছিল এক লাখ ৫৭ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা, গত ১২ নভেম্বর পর্যন্ত ২৭ হাজার ২৮২ কোটি টাকা কমে স্থিতি দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩০ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে শোধ করেছে, যার কারণে বাজার থেকে টাকা উঠে আসছে।

জানা যায়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেয়া বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আবার সঞ্চয়পত্র থেকেও কোনো ঋণ পাচ্ছে না সরকার। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের ব্যাংকঋণ এবার বাণিজ্যিক ব্যাংকনির্ভর হয়ে পড়েছে। তবে বেশিরভাগ ব্যাংক তারল্য সংকটে থাকায় সরকারকে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ দিতে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না, আবার দিলেও বেশি সুদ দাবি করছে। এমনটি তিন মাসের বেশি মেয়াদের ঋণেও ব্যাংকগুলো তেমন সাড়া দিচ্ছে না। ফলে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নসহ দৈনন্দিন খরচ মেটাতে শিডিউলের বাইরে গিয়ে আরও কম মেয়াদের ঋণের অকশন করতে বাধ্য হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে স্বল্পমেয়াদি (১৪ দিন) ট্রেজারি বিলের সুদের হারও বাড়ছে।

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার শিডিউলের বাইরে ১৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের অকশন করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে পাঁচ হাজার ৫২৮ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে সরকার। আর এই ঋণের সুদের হার ওঠে ৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ। সবমিলে চলতি অর্থবছরে শিডিউলের বাইরে গিয়ে মোট চার দফা ১৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের অকশন করা হয়েছে। এসব অকশন থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, সর্বশেষ গত বুধবার (২২ নভেম্বর) ১০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের অকশন অনুষ্ঠিত হয়। ওই অকশনে ১০ বছর মেয়াদে আড়াই হাজার কোটি টাকা ঋণ নিতে চেয়েছিল সরকার। কিন্তু ব্যাংকগুলোর অনাগ্রহের কারণে ঋণ নিতে পেরেছে মাত্র এক হাজার ১১৮ কোটি টাকা। এর জন্য সুদ গুনতে হবে ১১ দশমিক ১০ শতাংশ। গত ১৫ নভেম্বর পাঁচ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের অকশন করে সরকার ঋণ নিতে চেয়েছিল তিন হাজার কোটি টাকা। কিন্তু  ব্যাংকগুলোর অনাগ্রহে নিতে পারে মাত্র ৮১৩ কোটি টাকা। সুদের হার ওঠে ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। গত ৮ নভেম্বর দুই বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের অকশন করে ঋণ নিতে চেয়েছিল তিন হাজার ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু নিতে পেরেছে মাত্র এক হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। সুদের হার ওঠে ১০ দশমিক ৯০ শতাংশ। এছাড়া গত ২৫ অক্টোবর ১৫ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের অকশন করে এক হাজার কোটি টাকার ঋণ নিতে চেয়েছিল সরকার। কিন্তু নিতে পেরেছে মাত্র ২১১ কোটি টাকা। সুদের হার ওঠে ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। একই তারিখে ২০ বছর মেয়াদি অকশন করে ৮৫০ কোটি টাকার ঋণ নিতে চেয়েছিল সরকার। কিন্তু নিতে পারে মাত্র ২১৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদি বন্ডের অকশনে ব্যাংকগুলো সেভাবে সাড়া দিচ্ছে না। আর যেটুকু দিচ্ছে তাতে বাড়তি সুদ দাবি করছে। এর বাইরে সর্বোচ্চ মেয়াদের (৩৬৪ দিন) ট্রেজারি বিলের অকশনেও আশানুরূপ সাড়া দিচ্ছে না ব্যাংকগুলো। সর্বশেষ গত ২০ নভেম্বর ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের অকশন অনুষ্ঠিত হয়। ওই অকশনে দুই হাজার কোটি টাকার ঋণের চাহিদা দিয়ে সরকার নিতে পেরেছে মাত্র ৫২৬ কোটি টাকা। আর ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের অকশনে এক হাজার ৩০০ কোটি টাকার ঋণের চাহিদার বিপরীতে পেয়েছে মাত্র ২৮৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে একই তারিখে ৯১ দিন মেয়াদের অকশনে তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ চাহিদার বিপরীতে নিতে সক্ষম হয় তিন হাজার ২২২ কোটি টাকা। অর্থাৎ সংকটের কারণে কম মেয়াদের ঋণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আগ্রহ দেখাচ্ছে। ওইদিন ৩৬৪ দিন বিলের সুদ উঠে ১০ দশমিক ৬০ শতাংশ। আর ১৮২ দিন ও ৯১ দিন মেয়াদি বিলের সুদ ওঠে যথাক্রমে ১০ দশমিক ৪০ ও ১০ দশমিক ২০ শতাংশ।

বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, কিছু ব্যাংক তারল্য সংকট রয়েছে। তবে অনেক ব্যাংকের অবস্থা ভালো। তারা এখন বাইরের বিনিয়োগে যাচ্ছে না। কারণ অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি। তাই এসব ব্যাংক সরকারের স্বল্পমেয়াদি ট্রেজারি বিল বিনিয়োগ করছে। কারণ এখন উচ্চ সুদ রয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ করা হবে। তাই সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিচ্ছে না ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, যেসব ব্যাংকের পরিস্থিতি ভালো তারা সরকারের স্বল্পমেয়াদি ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগ করতে বেশি বেশি অকশন আয়োজন করতে বলে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক শেয়ার বিজকে বলেন, সরকারের বিল ও বন্ডে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ বাড়ছে। আবার ডলার বিক্রির বিপরীত টাকা উঠে আসছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক মানি সাপ্লাই কমাতে পলিসি রেট বাড়িয়েছে, যার কারণে মার্কেটে তারল্য ঘাটতি তৈরি হবে। সেটাই হচ্ছে। এখন যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার না দেয়া হয়, তাহলে সংকট বাড়বে। তাছাড়া একবারে সবদিক দিয়ে সংকোচন করা যায় না, যে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক ধার দেয়া অব্যাহত রেখেছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০