তৈরি পোশাকশিল্পে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’

বেসরকারি কনটেইনার অফডকে ২২% বর্ধিত চার্জ

মোহাম্মদ আলী, চট্টগ্রাম: তৈরি পোশাকশিল্পকে ঘিরে ধরেছে নানামুখী সংকট। বিশ্বব্যাপী পোশাকশিল্প বাজারে সিএম (কাটিং অ্যান্ড মেকিং) চার্জ কমে যাওয়া, বিদেশি ক্রেতাদের নিত্যনতুন শর্তারোপ ও অভ্যন্তরীণ বহুবিধ প্রতিবন্ধকতার কারণে এমনিতে এ শিল্পের ক্রান্তিকাল চলছে। এর ওপর ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে দেখা দিয়েছে বেসরকারি কনটেইনার ডিপোতে (অফডক) ২২ শতাংশ বর্ধিত চার্জ। গত ১ জানুয়ারি এ চার্জ বাড়ানো হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অফডক চার্জ বৃদ্ধির ফলে দেশের সর্ববৃহৎ রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনারের বিপরীতে বেসরকারি কনটেইনার ডিপো কর্তৃক বর্ধিত চার্জ আদায়ে তৈরি পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিযোগী দেশের তুলনায় রপ্তানি সক্ষমতা হারাবে।

গত ১ জানুয়ারি থেকে রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনারের ওপর বিভিন্ন চার্জ ২২ শতাংশ বৃদ্ধি কার্যকর করছে অফডক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশন (বিকডা)। বিকডার চিঠি পেয়ে ২২ শতাংশ বর্ধিত চার্জ স্থগিত চেয়ে গত ৩১ ডিসেম্বর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিলেন পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক। এমন পরিস্থিতিতে সভা ডেকেছে নৌপরিহন মন্ত্রণালয়।

বিকডা কর্তৃক বেসরকারি আইসিডি/ সিএফএসগুলোর ট্যারিফ/মাশুল বৃদ্ধির বিষয়ে এ সভা আগামীকাল সোমবার বিকাল ৪টায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনে (বিআইডবিøউটিসি) অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এতে সভাপতিত্ব করবেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব। এ সভা থেকে একটি চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত অথবা দু’পক্ষের মধ্যে সমঝোতার আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর  আগে এ বিষয়ে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রীর উপস্থিতিতে গত মাসে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই সভা থেকে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, তৈরি পোশাকের কনটেইনারে অফডকে ল্যান্ডিং চার্জ প্রতি টন ১৮০ থেকে বাড়িয়ে ২২০ টাকা এবং কার্টন প্রতি লেবার চার্জ/কার্গো রিসিভিং চার্জ তিন টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে তিন টাকা করেছে বিকডা।

পোশাক রপ্তানিকারকরা জানান, এনবিআরের নির্দেশনা অমান্য করে একতরফাভাবে অফডকে ২২ শতাংশ চার্জ আদায় করছে বিকডা। এতে পোশাকশিল্পের ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, চট্টগ্রাম বন্দর ও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মানে না বিকডা। পোশাকশিল্পের কার্টনপ্রতি লেবার চার্জ/ল্যান্ডিং চার্জ বৃদ্ধির বিষয়ে কোনো কমিটিই কোনো সুপারিশ করেনি। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত বেসরকারি আইসিডি/সিএফএস নীতিমালা ২০১৬-এর শর্ত মানছে না বিকডা। আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাকশিল্প সক্ষমতা হারাচ্ছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ছয় দশমিক ২১ শতাংশ। এরূপ পরিস্থিতিতে বিকডা কর্তৃক বর্ধিত চার্জ আদায় অব্যাহত থাকলে রপ্তানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। পোশাকশিল্পের বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে প্রাইভেট আইসিডিগুলোর বর্ধিত চার্জ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের পক্ষে প্রদান করা সম্ভব নয়।

বিজিএমইএ’র ভাইস প্রেসিডেন্ট এএম চৌধুরী সেলিম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বর্ধিত চার্জ আমরা গ্রহণ করতে পারছি না; কারণ আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা খারাপ। কস্ট অব ডুয়িং বিজনেসটি অনেক বেশি। নতুন পে-স্কেল কার্যকরের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি কমেছে। এ০ মুহূর্তে যেন অফডকে চার্জ বৃদ্ধি করা না হয়। গত জানুয়ারিতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে একটি সভা হয়েছিল। সে সভায় বলা হয়েছিল, ৩ ফেব্রæয়ারির সভায় ফুল অ্যান্ড ফাইনাল সেটেলমেন্টে যাবে।’

বিকডার সচিব মো. রুহুল আমিন সিকদার বিপ্লব শেয়ার বিজকে বলেন, ‘২০১৬ সালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) গঠিত একটি কমিটি প্রতিবেদনে বলেছিল, বেসরকারি আইসিডিতে পরিবহন ও পরিচালন ব্যয় ৪২ শতাংশ বেড়েছে। তখন স্টেকহোল্ডারদের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে ২০ শতাংশ চার্জ বাড়ানো হয়েছিল। চবকের তৎকালীন চেয়ারম্যান আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন, অবশিষ্ট ২২ শতাংশ চার্জ ২০১৭ সালে বৃদ্ধি করা হবে; কিন্তু ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত এটি বৃদ্ধি করা হয়নি। আমাদের দাবি স্টেকহোল্ডারদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার মুখে সব সময় চাপা পড়ে যাচ্ছিল।’

তিনি দাবি করেন, ‘ট্যারিফ কমিটি মুক্তবাজার অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বেসরকারি কোনো সেবা খাতে এখনও পর্যন্ত কোনো ট্যারিফ নির্ধারিত হয়নি। আমাদেরটি কেন হবে? করতে হলে সরকার কর্তৃক নিরপেক্ষ কমিটি দিয়ে করা হোক। যেখানে সেবাগ্রহীতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে, সেই কমিটি কখনও আমাদের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করতে পারবে না।’

জানা যায়, গত বছরের ১ অক্টোবর থেকে ব্যবসায়ীদের আপত্তির মুখেই আমদানি-রপ্তানি পণ্যের কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে সব ধরনের সেবার চার্জ ১০ শতাংশ বাড়িয়েছিল বিকডা। তার আগে গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর দুপুরে বন্দরের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত এক জরুরি বৈঠকে আইসিডিতে আমদানি-রপ্তানি কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ১০ শতাংশ বর্ধিত ট্যারিফ আদায়ের সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন চবক চেয়ারম্যান কমোডর জুলফিকার আজিজ। তারও আগে আলোচনা চলাকালীন সিদ্ধান্ত আসার আগেই হঠাৎ করে গত ১৬ আগস্ট ১২ শতাংশ চার্জ বাড়িয়ে দেয়। পরে ওই সিদ্ধান্তও স্থগিত করে দেয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়।

প্রসঙ্গত, আইসিডিগুলোর বর্ধিত ট্যারিফ/চার্জ গত বছরের ১ আগস্ট থেকে কার্যকরের ঘোষণা দিয়েছিল বিকডা। নতুন করে বিকডা কর্তৃক চার্জ বৃদ্ধির ঘোষণায় আপত্তি জানিয়ে বিজিএমইএ, চট্টগ্রাম চেম্বার, বাফা, বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। এরপর ১ আগস্ট দুপুরে অনুষ্ঠিত বন্দর ব্যবহারকারীদের সঙ্গে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভায় ওই সিদ্ধান্ত স্থগিতের ঘোষণা করা হয়। এর আগেও একবার গত ১ এপ্রিল থেকে চার্জ বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছিল বিকডা। কিন্তু ব্যবসায়ীদের আপত্তির কারণে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সেবারও বিকডার সিদ্ধান্ত স্থগিতে আদেশ দেয়।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমকে সহজ করতে বেসরকারি আইসিডিগুলো স্থাপন করা হয়েছে। চট্টগ্রামে মোট ১৯টি বেসরকারি আইসিডি রয়েছে। সেগুলো থেকে শতভাগ গার্মেন্টপণ্য রপ্তানির পাশাপাশি ৩৭ ধরনের আমদানিপণ্য হ্যান্ডলিং করা হয়। আইসিডিগুলোতে নির্দিষ্ট পরিমাণে চার্জ আদায় করে এসব পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে সব ধরনের সেবা প্রদান করা হয়। এর মধ্যে বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে যাওয়া, পণ্য খালাস, কনটেইনারে বোঝাই করা, ডেলিভারি থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম বেসরকারি আইসিডিগুলো থেকে করা হয়ে থাকে। ১৯টি আইসিডিতে সামগ্রিকভাবে প্রায় আট হাজার ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে, যেখানে প্রায় ৩৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০