বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি নিন্মমুখী

রোহান রাজিব: বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি টানা আট মাস ধরে কমছে। গত জুলাই শেষে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ, যা গত ২১ মাসের মধ্যে সর্বনিন্ম। গত ২০২১ সালের অক্টোবর শেষে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ। আর গত জুন শেষে প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ। গত বছরের জুলাই শেষে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ নিন্মুমখী মূলত আমদানি হ্রাস। নানা কড়াকড়ির কারণে আমদানি কমে গেছে। আর ডলার সংকটের কারণে বিনিয়োগ হচ্ছে না। নতুন বিনিয়োগ না হলে ঋণের দরকার হয় না। এছাড়া বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জিং সময় চলছে, যে কারণে ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে না। তাই বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৮৫ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা। গত গত জুনে ছিল ১৪ লাখ ৯৪ লাখ ২৫৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসে ৮ হাজার ৮০৯ কোটি টাকার ঋণ কমেছে, বা শূন্য দশমিক ৫৯ শতাংশ। আর গত বছরের একই সময়ে ঋণ স্থিতি ছিল ১৩ লাখ ৫২ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা। এক বছরের ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা। তবে তার আগের বছরে ঋণ বেড়েছিল ১ লাখ ৬৫ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। ঋণ বাড়ার ফলে গত বছরের জুলাইয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ। 

জানতে চাইলে ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এমরানুল হক শেয়ার বিজকে বলেন, বেসরকারি খাতের ঋণের চাহিদা কমে গেছে। ডলার সংকটের কারণে আমদানি পরবর্তী অর্থায়ন কমে গেছে। অফশোর ব্যাংকিং ঋণ ও ইডিএফ ঋণের চাহিদাও অনেক কমে গেছে। এছাড়া ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ ও কভিড-পরবর্তী অস্থিতরাতার কারণে নতুন প্রকল্প কেউ করতে চাইছে না।  আবার নির্বাচনী বছর হওয়ায় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। ব্যাংকগুলো ঋণ দেখেশুনে দিচ্ছে। তাই বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত অর্থবছর ৬৯ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, যা তার আগের অর্থবছরে ছিল ৮২ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে গত অর্থবছর আমদানি কমেছে ১৩ বিলিয়ন ডলার বা ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) জন্য বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১০ দশমিক ৯ শতাংশ। আর জানুয়ারি-জুন মুদ্রানীতিতে প্রাক্কলন করেছিল ১৪ দশমিক ১ শতাংশ।

জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমার প্রথম কারণ হলো আমদানি কমে যাওয়া। আমদানিতে কড়াকড়ির ফলে অনেকে এলসি খুলতে পারছে না। এলসি খুলতে না পারার কারণে তাদের ঋণ নেয়ার দরকার হচ্ছে না। অপরদিকে বিনিয়োগের চাহিদাও কম। কারণ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের কেনাকাটার সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। যেখানে বিনিয়োগ করার আগ্রহ আছে, কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না ডলার সংকটের কারণে। বিনিয়োগ না করতে পারলে ঋণের চাহিদা থাকে না। তাই প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, বেসরকারি খাতে ঋণ না যাওয়া দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। কারণ মজুরি, কর্মসংস্থান ও উৎপাদন এসব ক্ষেত্রেই বেসরকারি ঋণ দরকার। আমদানি করতে না পারার কারণে মূল্যস্ফীতিও কমছে না। যার ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিনিয়োগ কমছে। আর এসব না হলে কর্মসংস্থান ও মানুষের মজুরি বাড়বে না।

একদিকে অভ্যন্তরীণ ঋণে প্রবৃদ্ধি কমছে। অপরদিকে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণও কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সাল শেষে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণস্থিতি ছিল মাত্র ৮২১ কোটি ডলার। মাত্র আড়াই বছরে তা বেড়ে গত বছরের জুন শেষে ১ হাজার ৭৭৬ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। এরপর থেকে আবার কমছে। গত জুলাই শেষে ১ হাজার ৩৩৮ কোটি ডলারে নেমেছে। আর গত ডিসেম্বর শেষে ছিল ১ হাজার ৬৪২ কোটি ডলার। এর মানে ঋণ যত দ্রুত বেড়েছিল, কমছেও সেভাবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা এখন ঋণ নিতে চাইছেন না। কেননা বছর দুয়েক আগে ২ থেকে ৩ শতাংশ সুদে বিদেশি ঋণ পাওয়া যেত। গত দুই বছরে সুদহার অনেক বেড়ে এখন ৯ শতাংশের ওপরে উঠেছে। এ সময় ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩০ শতাংশের মতো। আগামীতে ডলারের দর বা সুদহার কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা কেউ জানে না। যে কারণে অনেকে ঋণ নিতে চাইছেন না।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০