ইসমাইল আলী: ২০২১ সালের মধ্যে দেশে সরবরাহকৃত বিদ্যুতের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদনের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ‘পাওয়ার সেক্টর মাস্টারপ্ল্যান, ২০১০’-এ। যদিও এ লক্ষ্যমাত্রার এক শতাংশও অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ। তবে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি খাতে কয়েকটি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতে স্থাপিত কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় সরকারি কেন্দ্রের তিন থেকে চারগুণ। আর বিশ্বের অন্যান্য দেশের চিত্র বিবেচনা করলে এ ব্যয় আট থেকে ১০ গুণ।
তথ্যমতে, রাঙ্গামাটির কাপ্তাইয়ে দেশের প্রথম সরকারি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। ২০১৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সাত দশমিক চার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার কেন্দ্রটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। এর পর থেকেই কেন্দ্রটি থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়।
কাপ্তাই প্রকল্পের ভেতর কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান বাঁধসংলগ্ন ২৩ একর জায়গায় সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়েছে। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জেডটিই করপোরেশন বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করে। সরকারি প্রথম এ সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে ২৪ হাজার ১২টি সোলার প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে। গত অর্থবছর কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় ৯৫ লাখ আট হাজার ৪৫০ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে তিন টাকা ৩৯ পয়সা।
এদিকে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় নির্মাণ করা হয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ কেন্দ্রটির সক্ষমতা আট মেগাওয়াট। সিম্পা সোলার নামক এ সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উদ্বোধন করা হয় গত বছরের ১৩ নভেম্বর। তবে প্রতিষ্ঠানটি গত বছরের ২৭ জুলাই থেকেই বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করেছে।
পঞ্চগড়ের জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার মাঝিপাড়া এলাকায় প্যারাগন গ্রুপের প্রতিষ্ঠান অ্যাকুয়া ব্রিডার্স লিমিটেডের মুরগির বাচ্চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ভেতরে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অবস্থান। সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যৌথভাবে নির্মাণ করেছে থাইল্যান্ডের শীর্ষ সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিম্বিয়ার সোলার ও বাংলাদেশের প্যারাগন গ্রুপ। বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে ৩৭ হাজার ৫১২টি সোলার প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে।
গত অর্থবছর কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় এক কোটি ১০ লাখ ২৯ হাজার ৫৮৬ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে ১১ টাকা দুই পয়সা। এ হিসাবে কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পিডিবির কেন্দ্রের তিন দশমিক ২৫ গুণ।
যদিও বেসরকারি খাতে স্থাপিত দেশের সর্ববৃহৎ সোলার পার্ক টেকনাফে। বর্তমানে এর উৎপাদন সক্ষমতা ২০ মেগাওয়াট। ২০১৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যাত্রা শুরুর পর এখান থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সঞ্চালন করা হচ্ছে। সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করেছে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান জুলস পাওয়ার লিমিটেড (জেপিএল)।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে নাফ নদীর তীরে সারি করে বসানো হয়েছে ৮৭ হাজার সৌর প্যানেল। এ প্যানেলগুলোর মাঝখানে রয়েছে পাঁচটি সাবস্টেশন। এ কেন্দ্রটিতে গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় তিন কোটি ৬০ লাখ ২৭ হাজার ৭২৬ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে ১১ টাকা ৭৪ পয়সা। এ হিসাবে কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পিডিবির কেন্দ্রের তিন দশমিক ৪৬ গুণ।
এদিকে জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে স্থাপন করা হয়েছে দেশের প্রথম সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র। ২০১৭ সালের আগস্টে উৎপাদন শুরু করা তিন মেগাওয়াট ক্ষমতার এ সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জমি দিয়েছে পিডিবি। আর বিনিয়োগ করেছে বেসরকারি খাত।
বিনিয়োগকারীদের মধ্যে রয়েছে জার্মানির আইএফই এরিকসেন এজি এবং দেশের কোম্পানি কনকর্ড প্রগতি কনসোর্টিয়াম লিমিটেড ও জুপিটার এনার্জি লিমিটেড। এই তিন প্রতিষ্ঠান মিলে গঠন করেছে যৌথ বিনিয়োগের কোম্পানি ‘আইএফই-সিপিসি-জেইএল কনসোর্টিয়াম’। আট একর জমিতে সাড়ে ১১ হাজার সোলার প্যানেল ব্যবহার করে গড়ে তোলা হয়েছে তিন মেগাওয়াটের এই সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র।
গত অর্থবছর কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় ৩৮ লাখ ৬০ হাজার ১৫ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে ১৬ টাকা আট পয়সা। এ হিসাবে কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পিডিবির কেন্দ্রের চার দশমিক ৭৪ গুণ।
জানতে চাইলে পিডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মূলত নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিতে বেসরকারি খাতে সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। তবে সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন ব্যয় বেশি হওয়ার মূল কারণ হল ক্যাপাসিটি পেমেন্ট। যদিও ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিবেচনায় সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কম। তাই ব্যয় বেশি হলেও এক্ষেত্রে পরিবেশের কথা বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
যদিও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বিবেচনায় বাংলাদেশে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি পড়ছে। এর অন্যতম উদাহরণ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। গত ২৯ সেপ্টেম্বর ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইইএফএ) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ভারত ও বিশ্বের অন্যান্য দেশে ক্রমেই কমছে। ভারতে সম্প্রতি দুই গিগাওয়াট (দুই হাজার মেগাওয়াট) সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে নিলাম করা হয়েছে। এতে দেশটি রেকর্ড কম দামে সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে লাইসেন্স দিয়েছে। এক্ষেত্রে ভারতে প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট ঘণ্টা) সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়বে দুই টাকা ৭৩ পয়সা (দুই দশমিক ৩৬ রুপি)।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, একই সময়ে দুবাইয়েও দুই গিগাওয়াট (দুই হাজার মেগাওয়াট) সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে নিলাম করা হয়েছে। এতে দেশটিতে প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট ঘণ্টা) সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়বে এক টাকা ১৪ পয়সা (০.০১৩৫ ডলার)। যদিও এটি বিশ্বের সবচেয়ে কম ব্যয়ের সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদাহরণ নয়, বরং বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে কম ব্যয়ে সৌর স্থাপনে নিলাম করা হয়েছে পর্তুগালে। দেশটিতে ৭০০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে এ নিলাম অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে দেশটিতে প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট ঘণ্টা) সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়বে এক টাকা ১১ পয়সা (০.০১১৪ ইউরো)। এটি বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে কম ব্যয়ের সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড।