নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম বন্দরে বিদ্যমান জেটিতে একসঙ্গে ১৫টি জাহাজ বার্থিং করা গেলেও বে-টার্মিনালে গড়ে প্রায় ৫০টি জাহাজ একইসঙ্গে বার্থিং করা যাবে। বন্দরের জেটির দৈর্ঘ্য চার কিলোমিটার হলেও বে-টার্মিনালের দৈর্ঘ্য হবে ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার। এ বে-টার্মিনাল চট্টগ্রামের গভীর সমুদ্রবন্দরের সক্ষমতা বাড়াবে। বে-টার্মিনালের বহুমুখী সুবিধার কারণে বাড়বে বন্দরের সক্ষমতা ও আয়। এতে পণ্য পরিবহন ব্যয় বহুলাংশে কমে যাবে।
গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) সম্মেলন কক্ষে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে মেগা প্রকল্প বে-টার্মিনালের চূড়ান্ত রিপোর্ট উপস্থাপনকালে এমন সম্ভাবনার কথা তুলে ধরা হয়। এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন চবক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম খালেদ ইকবালসহ বন্দরের শীর্ষ কর্মকর্তা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা গত এক বছর ধরে পরিচালিত সমীক্ষায় বন্দরে জাহাজের আনাগোনা, পণ্য হ্যান্ডলিং প্রবৃদ্ধি, ধরন, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, সাগরের গতি-প্রকৃতি, ভরাটের পরিমাণসহ নানা কিছু বিশ্লেষণ করে তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন তুলে দেন বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে। এ প্রকল্পকে অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এ টার্মিনাল আগামী ১০০ বছর দেশের চাহিদা পূরণ করবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। অপরদিকে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক ও কারিগরি সমীক্ষার ফলাফল ও সুপারিশের ভিত্তিতেই বে-টার্মিনালের ডিটেইলড ড্রইং, ডিজাইন ও ব্যয় প্রাক্কলনের জন্য পরামর্শক নিয়োগ, ডিটেইলড ড্রইং ও ডিজাইনের ভিত্তিতে বিভিন্ন কম্পোনেন্টের জন্য আলাদা আলাদা ডিপিপি প্রণয়ন, অর্থের সংস্থান ও ডিপিপি অনুমোদন, ঠিকাদার নিয়োগের দরপত্র আহ্বান, গ্রহণ, মূল্যায়ন, কার্যাদেশ প্রদান ও চুক্তি স্বাক্ষর এবং সর্বোপরি দ্রুত বাস্তবায়ন কাজ শুরু করতে চায় বন্দর কর্তৃপক্ষ। কেননা ২০১৯ সালের পর চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান অবকাঠামো দিয়ে দেশের চাহিদা মোকাবেলা কঠিন হয়ে উঠবে।
বন্দর সূত্রমতে, ইপিজেড থেকে দক্ষিণ কাট্টলী রাসমনি ঘাট পর্যন্ত সাগরপাড়ের প্রায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার এলাকায় নির্মিত হবে বে-টার্মিনাল। সাগর থেকে জেগে ওঠা এ ভূমিতে গভীর সমুদ্রে যে ড্রাফটের (গভীরতা) জাহাজ ভিড়ে হালিশহর আনন্দবাজার এলাকায় বেড়িবাঁধের বাইরের অংশে সাগর থেকে জেগে ওঠা ভূমিতে সেই ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারবে। এতে জোয়ার-ভাটা, দিন-রাত, বাঁকা চ্যানেল কিংবা ড্রাফটের বিবেচনায় কর্ণফুলী নদীর জেটিতে ভিড়লেও বে-টার্মিনালের ক্ষেত্রে সেই সীমাবদ্ধতা নেই। বর্তমানে কর্ণফুলী নদীর জেটিতে পৌঁছাতে একটি জাহাজকে ১৫ কিলোমিটার ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। কিন্তু বে-টার্মিনাল নির্মাণ করা হলে তা এক কিলোমিটারের মধ্যেই বার্থিং করতে পারবে। বে টার্মিনাল নির্মাণ হলে যে কোনো দৈর্ঘ্য ও যে কোনো ড্রাফটের জাহাজ এখানে ভিড়তে পারবে। বিপরীতে বর্তমান চ্যানেলে মাত্র ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্য ও সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফটের জাহাজ কর্ণফুলীতে প্রবেশ করতে পারে। সেই ক্ষেত্রেও জাহাজকে দুটি বাঁক অতিক্রম করতে হয় এবং দিনের মাত্র চার ঘণ্টা সময় পাওয়া যায়। আর রাতে বন্দর চ্যানেলে কোনো জাহাজ চালানো যায় না। কিন্ত বে-টার্মিনালে ২৪ ঘণ্টা জাহাজ পরিচালনা করা যাবে। বিদ্যমান পোর্ট জেটিতে একসঙ্গে ১৫টি জাহাজ বার্থিং করা গেলেও বে-টার্মিনালে গড়ে প্রায় ৫০টি জাহাজ একই সঙ্গে বার্থিং করা যাবে। বন্দরের জেটির দৈর্ঘ্য চার কিলোমিটার হলেও বে-টার্মিনালের দৈর্ঘ্য হবে ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার। এই বে-টার্মিনাল চট্টগ্রামের গভীর সমুদ্রবন্দরের সক্ষমতা বাড়াবে বলে বন্দর সংশ্লিষ্টদের ধারণা। কেননা বহির্নোঙর থেকে বন্দরের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। বে-টার্মিনালের দূরত্ব হবে মাত্র এক কিলোমিটার। সেখানে চ্যানেলের প্রশস্ততা ৮০০ মিটার থেকে ১২০০ মিটার। আর কর্ণফুলী চ্যানেলের প্রশস্ততা ২৫০ মিটার। বর্তমানে একই সঙ্গে ১৯টি জাহাজ ভিড়ানো সম্ভব এক নম্বর জেটি থেকে এনসিটি পর্যন্ত। প্রস্তাবিত টার্মিনাল প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সেখানে ভিড়তে পারবে ৩৫টি জাহাজ। অর্থনৈতিকভাবে সিদ্ধান্তটি সঠিক হবে কি না ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে সার্ভে করার জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়। গত বছরের ১৭ আগস্ট প্রায় ১০ কোটি টাকার এ সার্ভে কার্যক্রমের চুক্তি করা হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছেÑজার্মানির শেলহর্ন ইঞ্জিনিয়ার গেসেলকাফট এমবিএইচ, জার্মানির হামবুর্গ পোর্ট কনসাল্টিং (এইচপিসি) জিএমবিএইচ এবং দেশীয় প্রতিষ্ঠান কেএস কনসাল্টিং লিমিটেড। প্রস্তাবিত বে-টার্মিনাল নির্মাণের বিস্তারিত কারিগরি, অর্থনৈতিক, পরিবেশগত প্রভাব, অপারেশনাল ও ফিন্যান্সিয়াল এবং ট্রাফিক ইমপেক্ট অ্যাসেসমেন্ট করতে জার্মান প্রতিষ্ঠান শেলহর্নের নেতৃত্বাধীন দেশি-বিদেশি তিনটি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা যৌথ প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
Add Comment