বৈদেশিক ঋণের ৭৭ শতাংশই বিশ্বব্যাংক এডিবি জাইকার

শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার অন্যতম কারণ অনিয়ন্ত্রিত বৈদেশিক ঋণ ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছে শেয়ার বিজ। এতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। এ নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের আজ প্রকাশিত হচ্ছে দ্বিতীয় পর্ব

ইসমাইল আলী ও মাসুম বিল্লাহ: শ্রীলঙ্কার বর্তমান চরম অর্থনৈতিক সংকটের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় কঠিন শর্তের অনিয়ন্ত্রিত বৈদেশিক ঋণ গ্রহণকে। মূলত দ্বিপক্ষীয় উৎস (চীন, ভারত) থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছে দেশটি, যেগুলোর শর্ত ছিল তুলনামূলকভাবে কঠিন। তবে বাংলাদেশের চিত্র এক্ষেত্রে অনেকটাই উল্টো। বাংলাদেশ এখনও বহুপক্ষীয় উৎস (বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা) থেকেই সিংহভাগ ঋণ নিচ্ছে, যা ইতিবাচক মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশের ঋণের প্রায় ৭৭ শতাংশই বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) থেকে নেয়া। এসব ঋণের সুদের হার অনেক কম এবং পরিশোধের শর্তও অনেক সহজ। এছাড়া গত অর্থবছর বাংলাদেশের ছাড়কৃত বৈদেশিক ঋণের কিস্তির প্রায় ৬৪ শতাংশই ছিল এ তিন সংস্থার।

বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, শ্রীলঙ্কার দুরবস্থার অন্যতম কারণ হলো, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে দ্বিপক্ষীয় উৎস থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নেয়া। এতে দেশটির বৈদেশিক ঋণের জন্য উচ্চ হারে সুদ গুনতে হচ্ছে। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের ভাড়িত (ওয়েটেড) গড় সুদহার আট শতাংশের বেশি। অথচ বাংলাদেশের এ সুদহার এক দশমিক ৩৫ শতাংশ। তাই বহুপক্ষীয় উৎস থেকে নেয়া ঋণ বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ৬০ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারে। এর মধ্যে সরকারের ঋণ রয়েছে ৫০ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার। অবশিষ্ট ঋণের মধ্যে রয়েছে আইএমএফের বাজেট সহায়তা ও সরকারি বিভিন্ন সংস্থার ঋণ। আর সরকারের বৈদেশিক ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে এখনও শীর্ষে রয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির আইডিএ তহবিল থেকে নেয়া ঋণের পরিমাণ ১৮ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার, যা সরকারের মোট বৈদেশিক ঋণ স্থিতির ৩৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ।

বাংলাদেশের ঋণ নেয়ার দ্বিতীয় প্রধান উৎস এডিবি। সংস্থাটির কাছে বাংলাদেশের ঋণ রয়েছে ১১ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার, যা মোট বৈদেশিক ঋণের ২২ দশমিক ৯৪ শতাংশ। আর ঋণ নেয়ার তৃতীয় প্রধান উৎস হলো জাইকা। সংস্থাটিতে গত অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের ঋণ স্থিতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৯ দশমিক শূন্য আট বিলিয়ন ডলার, যা মোট বৈদেশিক ঋণের ১৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ।

বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের পরের দুটি উৎস হলো চীন ও রাশিয়া। গত জুন শেষে দেশ দুটি থেকে নেয়া ঋণের স্থিতি ছিল যথাক্রমে তিন দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার এবং তিন দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ মোট ঋণের যথাক্রমে সাত দশমিক ৮২ শতাংশ চীন এবং সাত দশমিক ২৮ শতাংশ রাশিয়া থেকে নেয়া হয়েছে। আর রাশিয়ার ঋণের পুরোটাই মূলত একটি (রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ) প্রকল্পে।

এর বাইরে ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ঋণ নেয়ার পরিমাণ যথাক্রমে শূন্য দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ও শূন্য দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। মোট ঋণের মধ্যে তা এক দশমিক ৪৬ ও এক দশমিক ৩৩ শতাংশ। আর অন্যান্য দেশ বা সংস্থা থেকে নেয়া হয়েছে বাকি দুই দশমিক ৭৩ বিলিয়ন বা পাঁচ দশমিক ৩৬ শতাংশ ঋণ। এর মধ্যে ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ও ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্টের (ইফাদ) ঋণ রয়েছে এক শতাংশের কিছু বেশি হারে।

বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের ধরনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর শেয়ার বিজকে বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশ বহুপক্ষীয় উৎস (বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা ইত্যাদি) থেকেই সিংহভাগ ঋণ নিত। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দ্বিপক্ষীয় (ভারত, চীন, রাশিয়া ইত্যাদি দেশ) উৎস থেকেও ঋণ গ্রহণ বেড়েছে। তবে বাংলাদেশের জন্য এখন পর্যন্ত বহুপক্ষীয় উৎস থেকে ঋণ গ্রহণই শ্রেয়। কারণ এসব ঋণ পরিশোধের জন্য অনেক বেশি সময় পাওয়া যায় এবং নমনীয় (কনসেশনাল) ঋণ গ্রহণের সুযোগ বেশি। কিন্তু দ্বিপক্ষীয় ঋণগুলো সাধারণত অনমনীয় (নন-কনসেশনাল) হয়। এগুলোর পরিশোধের শর্তও বেশ কঠোর। আর শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় উৎসের ঋণই বেশি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজেই বাংলাদেশের বহুপক্ষীয় উৎস থেকে অধিক ঋণ গ্রহণে জোর দেয়া উচিত।’

ইআরডির তথ্যে আরও দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছর বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ছাড়ের পরিমাণ ছিল ৭৪৪ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। এর মধ্যে ১৯২ কোটি ৬৪ লাখ ডলার ছিল জাইকার, ১৫৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার বিশ্বব্যাংকের ও ১২৬ কোটি ১৮ লাখ ডলার এডিবির। অর্থাৎ এ তিন সংস্থার ঋণ ছাড়ের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ, ২১ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ১৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ।

এর বাইরে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের জন্য রাশিয়ার ছাড়কৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১০২ কোটি ৯৬ লাখ ডলার এবং জিটুজি প্রকল্পে চীনের ঋণ ছাড়ের পরিমাণ ছিল ৭৮ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। এছাড়া অন্যান্য উৎস বা দেশ থেকে গৃহীত ঋণ ছাড়ের পরিমাণ ছিল ৮৬ কোটি ৮১ লাখ ডলার।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০